"৭৫এর প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন ১০৪ জন।তাঁদের জন্য সংসদে শোক প্রস্তাব পাশ সময়ের দাবি।বিস্তারীত ক্লিক করুন=============== ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সারা দেশে কারফিউ আর সেনা তৎপরতার মুখে যখন টুঁ-শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন একদল দামাল যোদ্ধা অস্ত্র হাতে গর্জে ওঠে। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে তারা কাঁপিয়ে তোলে সীমান্তবর্তী জনপদ। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের অনেকে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে পঁচাত্তরেই দেশি বাহিনীর বুলেটের টার্গেটে পরিণত হন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতিরোধ যুদ্ধের মূল নেতৃত্বে থাকা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জানান, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত চলমান ওই প্রতিরোধ-সংগ্রামে শাহাদাতবরণ করেন ১০৪ জন বীর যোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে তার হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ, গাইবান্ধার মুন্না, দুলাল দে বিপ্লব, বগুড়ার সারিয়াকান্দির আবদুল খালেক খসরু, সাখাওয়াত হোসেন মান্নান, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, আলী আজম আলমগীর, নজিবর রহমান নিহার, রেজাউল করিম, ফনেস সাংমা, অ্যালসিন মারাক, সুধীন মারাকরা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয় মুক্তিবাহিনী ’৭৫ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান যুগল হাশমী জানান, ৮৩ জন শহীদ প্রতিরোধ যোদ্ধার নাম তাদের কাছে রয়েছে। তবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে পঁচাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী ৯১ জন বীর যোদ্ধার নাম-ঠিকানা। প্রতিরোধ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধসহ তিন শতাধিক আহতের তালিকা রয়েছে। গুলিবিদ্ধ শাহ মুস্তাইন বিল্লাহ, ফারুক আহমদ, মো. আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক, গৌরাঙ্গ চন্দ্র পাল, ইসাহাক মারাক, মার্তুস সাংমা, অতুল সাংমা, জিতেন্দ্র ভৌমিক, সুকুমার চন্দ্র, শেখর হাগিদক, কমান্ডার আবদুল হক, কমান্ডার দুলাল চন্দ্র সাহা, সত্যেন চন্দ্র, প্রমোদ, অমল চন্দ্র, বাবুল হক, বিজন মৃ, বিজয় রিছিল, শেলেসটিন রুগা, সাধন পালদের খোঁজও নেয়নি কেউ। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক আটক ও পুশব্যাক হয়ে আসা অনেক যোদ্ধা-কমান্ডারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। যারা আহত অবস্থায় বেঁচে আছেন, তাদের জীবন কাটছে ধুঁকে ধুঁকে। কিন্তু এসব প্রতিরোধ যোদ্ধার বিষয়ে দলীয় বা সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদস্বরূপ সশস্ত্র সংগ্রামের অপরাধে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারে বন্দী থাকতে হয় আরও অন্তত ৮১ জনকে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিবাদী যুবকরা দলে দলে সমবেত হন ভারতের আসাম ও মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা গারো পাহাড় ও দুর্গম বনাঞ্চলে। তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুধুই প্রতীকী মেজাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলা সীমান্তের বিশাল এলাকাজুড়ে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন প্রতিরোধ যোদ্ধারা। সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী পাঁচটি বিডিআর ক্যাম্প ও দুটি থানা দখল করে তা নিজেরাই পরিচালনা করতে থাকেন তারা। সম্মুখযুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও। যুদ্ধকালে শুধু দুর্গাপুর-কলমাকান্দা সীমান্তবর্তী জনপদে অন্তত নয়জন প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং পাঁচজন বিডিআর-পুলিশ সদস্য নিহত হন। ক্রসফায়ারে মারা যান তিন সাধারণ গ্রামবাসী। পাবনার নিশ্চিন্তপুরে যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১২ অক্টোবর প্রতিরোধ যোদ্ধারা ওই চরে অবস্থান করছেন এমন খবর পেয়ে সেনাসদস্যরা হেলিকপ্টার ও জলপথ ঘিরে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু করে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পাল্টা প্রতিরোধে বেশ কিছু সেনাসদস্য নিহত হলে হেলিকপ্টার দল পিছু হটে। দুই দিনের এ তাণ্ডবে শহীদ হন প্রতিরোধ যুদ্ধের কমান্ডার বগুড়ার আবদুল খালেক খসরুসহ চারজন। এ সময় মৃতদেহ দাফন করা সম্ভব হয়নি বলে খসরুসহ শহীদ যোদ্ধাদের মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় যমুনার স্রোতে। এভাবে প্রায় ২২ মাস যুদ্ধ চালিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা টিকে থাকেন বীরত্বের সঙ্গে। একদিকে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সমর্থনের অভাব, অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় প্রতিরোধ যুদ্ধ থেমে যায় অসমাপ্ত অবস্থায়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিরোধ যুদ্ধ ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে শুরু হয়ে স্থায়ী হয় ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত। তবে প্রতিরোধ যুদ্ধের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ও সাব-সেক্টরগুলোয় অবস্থান নেওয়া যোদ্ধাদের শেষ দলটি অস্ত্র ত্যাগ করে ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে। শহীদ হন যারা : বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই সশস্ত্র আন্দোলনে জীবন দেন শতাধিক যোদ্ধা। তাদের ৯১ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন বগুড়ার আবদুুল খালেক খসরু ও নজিবুর রহমান নিহার, গাইবান্ধার ইবনে সাউদ, রেজাউল করিম, মিজানুল হক মুকুল, মোহাম্মদ আলী, আবদুর রাজ্জাক, আলী আযম আলমগীর, মো. বাবুল, মো. সোলায়মান ও আবদুর রহিম আজাদ, কুড়িগ্রামের রেজাউল করিম-২, নূরুল ইসলাম ও নূরুল আমিন, নেত্রকোনার আবদুল খালেক, রাধারমণ রায় ঝন্টু, বামুন সরকার, রজব আলী, আবুল কাশেম, হামিদুল ইসলাম, ফজর আলী, শান্তি বিকাশ সাহা পল্টু, আবদুল হেকিম, মুসলিম উদ্দিন তালুকদার ও সুব্রত, টাঙ্গাইলের সাখাওয়াত হোসেন মান্নান ও সৈয়দ নূরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, কুমিল্লার সুশীল ভৌমিক বেলু, সুনামগঞ্জের নিরানন্দ দাশ, মতিলাল দাশ, আখলমন মাঝি, বলরাম সরকার, শেরপুরের বিপ্লব কুমার দে দুলাল, দুলাল মিয়া, মনোরঞ্জন সরকার, হাবিবুর রহমান, বীরেন্দ্র চন্দ্র পাল, কছর আলী, আলী হোসেন, শওকত আলী, মোতালেব, ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীল, রুস্তম আলী ও মোজাম্মেল হক, জামালপুরের নজরুল ইসলাম ও আলতাফুর রহমান, ময়মনসিংহের আবদুল হামিদ, আবদুল আজিজ, সুশীল চন্দ্র দত্ত, রঞ্জিত কুমার এস, মজিবুর রহমান খান, সুবোধ চন্দ্র ধর, আলকাস উদ্দিন সরকার, দ্বীপাল চন্দ্র দাশ, জোবেদ আলী ও সিরাজুল ইসলাম। শহীদদের ২৫ জন আদিবাসী। তারা হচ্ছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রঞ্জিত সাংমা, অনন্ত বর্মণ, জয়েশ্বর বর্মণ, সপ্রু সাংমা, কাশেম সাংমা, নিরঞ্জন সাংমা, পিটারসন সাংমা, প্রাণবল্লভ বর্মণ, প্রটিন দিও, শ্রীদাম রিছিল ও চিত্তরঞ্জন ডালু, শ্রীবর্দী উপজেলার সম্রাট সাংমা, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ফনেস সাংমা, তপন চাম্বুগং, অ্যালিসন মারাক, গোবিনিক মারাক, সুদর্শন মানকিন, হারু সাংমা, হযরত সাংমা, জবিনাশ তেলসী, অগাস্টিন চিছিম, সুধীন কুবি ও ডমিনিক চাম্বুগং, নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার হেনরি সাংমা এবং ধোবাউড়া উপজেলার পংকজ আজিম। কাদের সিদ্দিকী বলেন : পঁচাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রসঙ্গে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থনের অভাবে আমরা সফল হতে পারিনি। তবু চলতে থাকে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। কিন্তু ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইন্দিরা গান্ধীকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন মোরারজি দেশাই। জিয়াউর রহমান তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে প্রতিরোধ-সংগ্রামীদের প্রতি দেশটির সমর্থন বন্ধের ব্যবস্থা করেন। শুধু তা-ই নয়, ওই সময় মোরারজি দেশাই সরকার অসংখ্য প্রতিরোধ-সংগ্রামীকে ধরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। শুধু আমার প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত পঁচাত্তরে কয়েক হাজার প্রতিরোধ-সংগ্রামীকে করা হয় বঞ্চিত। বোধহয় আমার কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ-সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের জন্য সংসদে শোক প্রস্তাব পর্যন্ত নেওয়া যায়নি।’ (মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইবস থেকে সংগৃহিত)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন