বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী॥১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট। আন্দরকিল্লা থেকে সিরাজউদ্দৌলা রোড ধরে আমার তখনকার বাসা চন্দনপুরার হাদি মনজিলে ফিরছিলাম। সকাল আনুমানিক ১১টা। সঙ্গে দুই বন্ধু মীরসরাই’র আনোয়ার কামাল আর সাতকানিয়ার রফিকুল ইসলাম। দিদার মার্কেটের সামনে আমরা। হঠাৎ একটা মিলিটারি জিপ এসে পেছনে ব্রেক কষে। ড্রাইভারের পাশে বসা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বড় ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ফকার ছেলে নির্দেশ দিল- ‘তুলি ল’। দেখলাম জীপ থেকে নামছে আমাদের ছাত্রলীগের কর্মী ইউসুফ এবং তিনজন অবাঙালি মিলিশিয়া।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ইউসুফ আমাদের সঙ্গে ভারতের আগরতলা গিয়েছিল। সেখানে অবস্থানকালে ট্রেনিংও নিয়েছিল। কিন্তু আগরতলা থেকে দেশে ফিরে আসার পর তার বাবা মুসলিম লীগের কর্মী ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর এক অন্ধভক্ত ইউসুফকে ধরে ফকার হাতে তুলে দিয়ে আসে। ফকা তার মুরিদের ছেলেকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয়। ই্উসুফের দায়িত্ব ছিল আমরা যারা আগরতলা থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করছি তাদেরকে ফকা-সাকা বাহিনীর কাছে চিনিয়ে দেওয়া। সাকা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিপ নিয়ে সারা শহর এবং আশে পাশে ঘুরে বেড়াত। সঙ্গে থাকতো এই ইউসুফ এবং পাকিস্তানি মিলিটারিকে সাহায্যকারী বন্দুকধারী মিলিশিয়া।ইউসুফের এই রূপান্তর আগেই শুনেছি। তাই ফকার ছেলে আর তাকে জিপ নিয়ে থামতে দেখে পিলে চমকে গেল। বুঝে গেলাম টার্গেট আমি, কারণ আমার সঙ্গী দু’জন আগরতলা ফেরত না। পালানোর চেষ্টা করেও লাভ নেই। তাদের হাতে অস্ত্র। আমার দুই বন্ধু দৌড়ে পালাতে সফল হল। শুধু সফল নয়, ওইদিনই নাকি তারা গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। আর শহরে ফেরেনি। এমনকি আমাকে তুলে নেওয়ার খবরটাও আমার বাসায় দিয়ে যায়নি। তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে দেশ স্বাধীনের পর।ইউসুফ বললো, ‘উঠেন আমাদের সঙ্গে।’ কোনও প্রতিবাদের সুযোগ নেই। যারা এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে তারাই অনুধাবন করতে পারবে এমন পরিস্থিতির ভয়াবহতা। শুনেছি যশোরের আওয়ামী লীগ নেতা এমপি মশিউর রহমানকে পায়ে দড়ি দিয়ে জিপের পেছনে বেঁধে টেনে টেনে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা। মিলিশিয়ারা আমাকে নিয়ে জিপের পেছনের সিটে বসলো। অল্প দূরে ছিল ফকা-সাকাদের গুডস হিলের বাসা। তারা একটানে সেখানে নিয়ে আসলো।আমি কোনদিন এর আগে এই পাহাড়ে উঠিনি। উত্তরমুখি একতলা একটি বাড়ি। পশ্চিমপাশে দুটি গাড়ির গ্যারেজ। গ্যারেজের সামনে মাটিতে বসিয়ে রাখলো আমাকে। ইউসুফ, সাকা আমাকে রেখে কোথায় চলে গেছে জানি না। পুরো পাহাড়ে প্রায় ৪০-৫০ জন মিলিশিয়া। কালো ড্রেস, হাতে অস্ত্র। সবাই অবাঙালি। কিছু রাজাকারও আছে। এলাকায় বিল্ডিংটির সামনে ছোট্ট একটি গোল চত্ত্বর। এর মাঝখানে পতাকা উড়ানোর স্ট্যান্ড। এই গোল চত্ত্বরেই একটা যুবকের লাশ পড়ে আছে। চিনি না। কিন্তু লাশ দেখে ভয়ে মৃত্যুর প্রহর গোনা শুরু হল আমার। গ্যারেজ দুটির দরজা বন্ধ। কিন্তু বুঝা যাচ্ছে ভেতরে লোকে ভর্তি। গ্যারেজের ভেতর থেকে কণ্ঠ শুনলাম একটা- ‘বখতিয়ারকেও আনছে।’ গলার স্বর শুনে বুঝিনি সে কে তবে সন্দেহ নেই আমার পরিচিত লোকেরাও আছে। শুনেছি ড. সানাউল্লাহ ব্যরিস্টারের ছেলে সেলিমসহ (বর্তমান পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মামা) অনেককে তুলে এনেছে। মনে মনে চিন্তা করছি তারাই হবে। সেলিমের মামা অবসরপ্রাপ্ত সাব জজ আবুল কাশেম এরমধ্যেই সেলিমকে উদ্ধার করার জন্য ফকার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। সেলিমকে কখনো আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ করতে দেখিনি। তার বাবা ড. সানাউল্লাহ রাজনীতি করতেন। নিখিল ভারত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৪৬ এর সাধারণ নির্বাচনে ড. সানাউল্লাহ হাটহাজারি-ফটিকছড়ি-রাউজান নির্বাচনি কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে বেঙ্গল পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সম্ভবত একই নির্বাচনি কেন্দ্রের লোক হওয়ায় ড. সানাউল্লাহর সঙ্গে ফকার সম্পর্ক কখনও ভালো ছিল না। অবশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ড. সানাউল্লাহ জীবিত ছিলেন না। সেলিমকে হয়তো এনেছিল তার বাবার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। সেলিম মানবতাবিরোধী ট্রাইবুনালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিয়েছে।গ্যারেজের সামনে মাটির ওপর বসে রইলাম দীর্ঘক্ষণ। চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে অত্যাচার আর হত্যার দুটো কেন্দ্র ছিল। জামায়াত এবং ইসলামি ছাত্রসংঘের আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যেত ওল্ড টেলিগ্রাফ রোডের ডালিম হোটেলে। সেখানে মীর কাশেমের নেতৃত্বে আল-বদর বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করতো। আর ফকা-সাকা ও মিলিশিয়ারের ‘কনসেনট্রেইশন ক্যাম্প’ ছিল তাদের বাড়ি এই গুডস হিল। এ যাবত পরিচিত যারা পাক বাহিনী এবং তার দোসরদের হাতে মারা গেছে তাদের কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ে ক’দিন আগে আমার ফুফাতো ভাই আলিমউল্লাহ চৌধুরী ফটিকছড়ির হলদিয়া পাহাড়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে মারা যান। পটিয়ায় রাজাকার আর পাকবাহিনী হত্যা করেছে আমাদের ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা মুরিদুল আলমকে। জুবলি রোডে তারা হত্যা করেছে আমার বন্ধু ছাত্রলীগ নেতা মাহাবুবুল আলমকে। রাঙ্গুনিয়ায় হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর বড় ছেলে এবং আমাদের বন্ধু সাইফ উদ্দিন খালেদ চৌধুরীকে। শুনেছি রাউজানে আত্মগোপন অবস্থা থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে আমার বন্ধু জাহাঙ্গীর ও তার বাবা ছালারেজেলা মোজাফ্ফর আহমেদকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাহিনী পথ থেকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলেছে।মোজাফ্ফর আহমেদ সাহেব ঐতিহাসিক ‘বাংলার পতন’ নাটকের রচয়িতা। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য ছিলেন এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মনে হচ্ছিল গোল চত্ত্বরে পড়ে থাকা যুবকের মতো আমার লাশও কিছুক্ষণ পর সেখানে পড়ে থাকবে। ভাবছি আমার নেতা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমেদ চৌধুরী যে দায়িত্ব দিয়ে আমাকে আগরতলা থেকে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছেন সে দায়িত্ব আমার অবর্তমানে পালন করবে কে!জুনের শেষের দিকে জহুর আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে আগরতলা থেকে চট্টগ্রামে ফেরত এসেছিলাম। সঙ্গে উনার তিনটি চিঠি। চিঠিতে শুধু লেখা ছিল ‘The bearer is my man, Please give him patience hearing’ – Zahur. দেশে এসে তিনটি চিঠি প্রাপকদের হাতে তুলে দেই। আমাকে যা যা বলতে বলেছেন সেটাই তাদেরকে বলেছি। তাদের একজন আশকার দীঘির পাড়ের ডা. সিরাজ, অপর দুইজন ওয়াপদার বিদ্যুত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কে কে আলতাফ হোসেন এবং অপর নির্বাহী প্রকৌশলী শামুসুদ্দীন আহমেদ। পুরো মুক্তিযুদ্ধে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। জহুর চৌধুরীর নির্দেশ অনুসারে মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে সহযোগিতা করেছেন।বাংলাদেশ হওয়ার বহুদিন পর আলতাফ হোসেন ডেসার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। শামসুদ্দিন সাহেব এক সময় চাকরি ছেড়ে ঠিকাদারী করতেন। আর ডা. সিরাজ ১৯৯৯ সালে মারা গেছেন।তিন ঘণ্টা পার হওয়ার পর দেখলাম বাসার বারান্দায় পাতানো ইজি চেয়ারে এসে বসলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। তার পাশে দেওয়ালে ঠেকানো একটা রাইফেল। আমার ডাক পড়লো। রাজাকার কমান্ডার রফিক যাওয়ার আগে বলে দিল- চৌধুরী সাহেবের সামনে করজোড়ে দাঁড়াতে। আমি হুকুম পালন করলাম। ফকা তার ঐতিহাসিক বিদ্রুপাত্মক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোর নাম কী? আমি বললাম- বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী। বরাতে দুঃখ ছিল। মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। পাশের রাইফেলটা হাতে নিয়ে বাট দিয়ে আঘাত করলো আমার বাম চোয়ালে। মারার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রুপ করলো- ‘গোলামের পুত চৌধুরী হইলি কবে?’ ‘চৌধুরী’ টাইটেলটা যে ফকার রেজিস্ট্রি করা কে জানতো! কয়েকটা দাঁত ভেঙে গেল। রক্ত পড়া শুরু হল। ফকা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য মিলিশিয়াদের হুকুম দিয়ে চলে গেলেন।মিলিশিয়াদের একের পর এক আঘাতে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর কিছুই আর মনে নেই। চেতনা যখন ফেরত আসে তখন দেখি রাত। আমি পাহাড়ের নিচে। পিপড়ার কামড়ে শরীর ফুলে গেছে। রক্তাক্ত দেহ। রাজাকার রফিক আমার নাকের ওপর একটা লেবু ধরে আছে। আমি মারা গেছি মনে করে মিলিশিয়ারা নাকি আমাকে গ্যারেজের পেছনের দিকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিল। রফিক আমাকে আস্তে আস্তে বললো, রাত আরও গভীর হলে সে কাঁটাতারের বেড়া ফাঁক করে দিবে। আমি তখন আস্তে আস্তে জামাল খান রোডের দিকে চলে যেতে পারবো।কিছুক্ষণ পর আওয়াজ শুনলাম। আমার এক খালাতো ভাই এক মিলিটারি অফিসার নিয়ে আমাকে খোঁজাখুঁজি করছে। রফিক তাদেরকে নাকি আমার অবস্থান দেখিয়ে দিয়েছিল। আমাকে যেখান থেকে জিপে তুলেছিল সেই দিদার মার্কেটের দিদার চৌধুরীর বড় ছেলে (নামটা এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না দুঃখিত) আমাকে চেনে এবং সাকা বাহিনী আমাকে তুলে নেওয়ার খবর সে-ই আমার মাকে বাসায় বলে এসেছে। আমার খালাতো ভাই আমাকে গাড়িতে তুলে নেন। তিনি এবং মিলিটারির সেই কর্নেল দু’জনই গাড়িতে করে আমাকে আমার খালাতো ভাইয়ের বাসায় নিয়ে আসেন।ইউসুফ স্বাধীনতার আগেই পাকিস্তান পালিয়ে গিয়েছে। আজও আসেনি। তার বিরুদ্ধে বহু খুনের অভিযোগ আছে। আমি ১৬ ডিসেম্বর গুডস হিলে গিয়েছিলাম মনের ক্ষোভ মেটাতে। গিয়ে দেখি আমার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা তছনছ করে দিয়েছে তার বাসভবন। ওরা তাকে পেলে টুকরা টুকরা করে ফেলতো। এরপর ফকা ট্রলারে করে বার্মা পালানোর সময় ধরা পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে পেটানোর সময় ভারতীয় বাহিনী তাকে উদ্ধার করে। সাকা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার আগে আগে। ১৯৭৫ সালের পর দেশে ফিরে আসে। তার ভাইয়েরা অবশ্য দেশে আত্মগোপনে ছিল। তার ছোট ভাই জামাল ছাড়া অপর দুই ভাই সাইফুদ্দিন এবং গিয়াসউদ্দিন তার সঙ্গে অপকর্মে জড়িত ছিল। সাইফুদ্দিন দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে সম্প্রতি মারা গেছে। গিয়াসউদ্দিনেরও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার হওয়া উচিত।আল্লাহ হাকেমুল হাকেমিন। তিনি ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতো দাম্ভিক, খুনি, কুলাঙ্গারের বিচার করেছেন বাংলার মাটিতে। জেলখানায় তার মৃত্যু হয়েছে। মুত্যুর পর ফকাকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেই অভিশপ্ত মুখটা বিভৎস রূপ ধারণ করেছিল। সাকার মতো খুনি, কুলাঙ্গার, জালেম এখন জেলে। তার মৃত্যুদণ্ড দেখার অপেক্ষায় আছি।লেখক: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, চট্টগ্রাম

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন