লিখাটি মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইবস থেকে নেয়া।ইতিহাসে সত্য-মিথ্যা,রটনা- ঘটনা নতুন প্রজর্মকে নিবিড় ভাবে জানানো প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধা ই-আর্কাইবস সে লক্ষে মহতি উদ্যোগ গ্রহন করেছে। ----------------------------------------- রক্তাক্ত নভেম্বর: কী চেয়েছিলেন খালেদ ও তাহের নভেম্ভর ৮, ২০১৫ ============================= (দ্বিতীয় কিস্তি) ড মো আনোয়ার হোসেন রক্তাক্ত নভেম্বর: কী চেয়েছিলেন খালেদ ও তাহের নভেম্ভর ৮, ২০১৫ ============================= ৩. সংসদে জেনারেল খালেদ মোশাররফের কন্যা সংসদ সদস্য মেহজাবিন খালেদের লিখিত বক্তব্য শুনেছি অভিনিবেশ সহকারে। মুক্তিযুদ্ধের তিন বীর সেনানী খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা এবং মেজর হায়দার– যাঁরা ৭ নভেম্বর সিপাহী অভ্যুত্থানের পর নৃশংস হত্যার শিকার হন, তাদের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা খুব জরুরি। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি জিয়াউর রহমানকে দায়ী করছেন। এ বিষয়ে মেহজাবিনের সত্যাশ্রয়ী তথ্য উপস্থাপন আমাকে আশান্বিত করেছে। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ইতিহাসের ধূসরতম অধ্যায়, ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ ঘিরে অত্যন্ত দ্রুতলয়ের ঘটনাবলী– যার অধিকাংশ এখনও অন্ধকারে ঢাকা, রহস্যাবৃত— তার বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান এবং সত্য বের করে আনা খুবই প্রয়োজন। মেহজাবিন সেই দাবি করেছেন। এ প্রসঙ্গে শুরুতেই দুএকটি তথ্য জানিয়ে রাখি। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে নভেম্বরের অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বেঙ্গল ল্যান্সারের (ট্যাংক রেজিমেন্ট) মুক্তিযোদ্ধা অফিসার মেজর নাসির উদ্দিন। ‘গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী’ শীর্ষক একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। ৭ নভম্বের তিন সেনানায়কের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে মেজর নাসির তাঁর পুস্তকে লিখেছেন। ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে কক্ষে ঘাতকরা তাদের হত্যা করে সেই একই কক্ষে একই রাতে মেজর নাসিরকেও আটকে রাখা হয়। অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। তাই নাসিরের বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন: “বিদ্রোহের খবর শুনে তিনি (খালেদ মোশাররফ) বঙ্গভবন ছেড়ে লালমাটিয়ায় তাঁর মামার বাসায় আসেন। সেখান থেকে টেলিফোনে খবর সংগ্রহের চেষ্টা করেন। এরপর সম্ভবত কর্নেল হুদার পীড়াপীড়িতে তিনি শেরে বাংলা নগরে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আসেন। রংপুর থেকে কর্নেল হুদাই দুদিন আগে এই ব্যাটালিয়নটি ঢাকায় নিয়ে আসেন খালেদকে সহায়তা দেওয়ার জন্য। ৭১এ খালেদই ব্যাটালিয়নটি সৃষ্টি করেন তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনে। [...] ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে খালেদের উপস্থিতির কথা জানাজানি হলে কর্নেল তাহের ও মীর শওকত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকদেরকে প্ররোচনা দিয়ে বিদ্রোহের আহ্বান জানান। শেষমেশ ১০ ইস্ট বেঙ্গল বিদ্রোহ করে বসে। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। বিদ্রোহের এক পর্যায়ে সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে এই জলিল ও আসাদই জেনারেল খালেদ, হুদা ও হায়দারকে হত্যা করে।” [নাসিরউদ্দিন, পৃষ্ঠা- ১৫১] উল্লেখ্য, ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত মেজর নাসিরকে ১০ ইস্ট বেঙ্গলে পাঠিয়ে দেন এবং সে রেজিমেন্টের ঘাতক অফিসার মেজর জলিল ও মেজর আসাদ নাসিরকে ঐ কক্ষটিতে পাঠান যেখানে সকাল ১১ টায় তারা হত্যা করেছে তিন সেনানায়ককে। [নাসিরউদ্দিন, পৃষ্ঠা- ১৪৯] এ প্রসঙ্গে সবার বিবেচনার জন্য জানাই, মেজর নাসিরের উক্তি থেকে মনে হতে পারে যে, তাহেরের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে মীর শওকত সহযোগী ছিলেন। তা একেবারেই সত্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের পর কর্নেল তাহের অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল থাকাকালে সেনা অফিসারদের লুণ্ঠিত সম্পদ ফেরত দেবার জন্য যে আদেশ জারি করেছিলেন সেখানে অভিযুক্তদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন মীর শওকত। এ প্রসঙ্গে গোপন আদালতে প্রদত্ত তাহেরের জবানবন্দি দেখব: In the month of April 1972, after all necessary treatment following the amputation was completed, I returned to Bangladesh. I rejoined the Bangladesh Army in the position of Adjutant General. I reinforced discipline in the Army when it was a difficult task. [...] I initiated disciplinary proceedings against certain senior officers, such as Brigadier Mir Sawkat and Major General Safiullah concerning certain illegalities. My position was that everything any officer had illegally acquired must be returned, so that they may stand up as brave and clean men before the nation’s freedom fighters. [Taher’s Last Testament: Bangladesh the Unfinished Revolution, Page: 67] তাহেরের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় মীর শওকতের সঙ্গে তার বৈরিতা শুরু থেকেই। ১৯৭৬ সালে প্রহসনের বিচারে তাহেরের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হওয়ার পর ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত নিজে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করে ফাঁসির মঞ্চ পরীক্ষা করে যান। যদিও এটা কোনোভাবেই তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আগাগোড়া জেনারেল জিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন মীর শওকত। মেজর নাসিরের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, হত্যা করার জন্যই মীর শওকত নাসিরকে ১০ ইস্ট বেঙ্গলে পাঠিয়েছিলেন মেজর জলিল ও মেজর আসাদের হাতে। খালেদসহ তিনজন সেনানায়কের হত্যাকাণ্ডের সময় তাহের নন, ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন জিয়া-মীর শওকত ও তাদের অনুগত অফিসাররা। সবচেয়ে বড় কথা, অভ্যুত্থানী সিপাহীদের হাতে নয়, ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের (খালেদের নিজের হাতে গড়া ব্যাটালিয়ন) দুজন অফিসার মেজর জলিল ও মেজর আসাদের হাতে নিহত হন তিন সেনানায়ক। উল্লেখ্য যে, এই দুজনের কেউই তাহেরের নেততৃাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য ছিলেন না। পরবর্তীতে জানা গেছে, জেনারেল জিয়ার ইঙ্গিতেই তাদের হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিল রচিত ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ পুস্তকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। উল্লেখ্য, কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ৪৬তম ব্রিগেড খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে মূল ভূমিকা পালন করে। শাফায়াত জামিল লিখছেন: “শেষ রাতের দিকে দশম বেঙ্গলের অবস্থানে যান খালেদ। পরদিন সকালে ঐ ব্যাটালিয়নে নাশতাও করেন তিনি। বেলা এগারটার দিকে এল সেই মর্মান্তিক মুহূর্তটি। ফিল্ড রেজিমেন্টে অবস্থানরত কোনো একজন অফিসারের নির্দেশে দশম বেঙ্গলের কয়েকজন অফিসার অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় খালেদ ও তাঁর দুই সঙ্গীকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি আজও। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত বারটার পর ফিল্ড রেজিমেন্টে সদ্যমুক্ত জিয়ার আশপাশে অবস্থানরত অফিসারদের অনেকেই অভিযুক্ত হবেন এ দেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সেনানায়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফকে হত্যার দায়ে। তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের অন্যতম নায়ক কর্নেল তাহের এবং তৎকালীন জাসদ নেতৃবৃন্দও এর দায় এড়াতে পারবেন না।” [শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা: ১৪৪-১৪৫] তাই সংসদে যখন মেহজাবিন খালদে পিতার হত্যাকারী হিসেবে জিয়াকে চিহ্নিত করেন, তখন তিনি সত্য উচ্চারণই করেন। কারণ কর্নেল শাফায়াত জামিলের ভাষ্য অনুযায়ী ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত বারটার পর ফিল্ড রেজিমেন্টে সদ্যমুক্ত জিয়ার আশেপাশে অবস্থানরত একজন অফিসারের নির্দেশে ঐ হত্যাকাণ্ড ঘটে। তাহের সিপাহী অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জাসদ তাতে রাজনৈতিক সহায়তা দিয়েছে, তাই শাফায়াত জামিল, “তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের অন্যতম নায়ক কর্নেল তাহের এবং তৎকালীন জাসদ নেতৃবৃন্দকেও” এই হত্যার দায় থেকে বাদ দেননি। তাহের ও জাসদ সম্পর্কে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন সেনানায়কদের মনোভাব কর্নেল শাফায়াত জামিলের মতোই। কারণ, তারা একের পর এক ষড়যন্ত্র এবং হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে গেছেন সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে থেকে। অন্যদিকে, তাহের ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম ক্যু প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করে সেই ১৯৭২এর সেপ্টেম্বরেই পদত্যাগপত্র পেশ করেন, সেনাবাহিনী ছেড়ে দেন। একমাত্র তাহেরই সেনাবাহিনীর মধ্যকার প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ড চিরতরে বন্ধ ও তার গণবিরোধী চরিত্র বদলের জন্য সেনাবাহিনীর মৌলিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। জয় বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু জয়তু দেশরত্ম শেখ হাসিনা

পরিষ্কার অনুমান করা যায়,প্রথম অবস্থায় যদিও অভ্যুত্থানকারিরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে ইস্যু করে সেনা সদস্যদের সংগঠিত করেছিল,স্বল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে,।চতুর জিয়া দুর্বল মহুর্তের অপেক্ষাই করছিলেন।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন