সালা উদ্দিন কাদের চৌধুরীর দম্ভোক্তি :----- ================================= (মুক্তি যুদ্ধ আর্কাইবসের সংরক্ষিত রায়ের বাংলা অনুবাদের অনুবাদকের  ভুমিকা থেকে পেষ্ট কপি) ------------------------------------ মানবতাবিরোধী মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে হুমকি দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দম্ভোক্তি করেছিলেন, ‘চোখ রাঙাবেন না। আমি রাজাকার। আমার বাপ রাজাকার। এখন কে কী করতে পারেন, করেন।’ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এই দম্ভের কথা তাঁর বিচারের পূর্ণাঙ্গ রায়তেও লিখে রেখেছেন বিচারকেরা। সেখানে বলা হয়েছে, “বিচারের কোনো পর্যায়েই তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য অনুশোচনা এবং অনুতাপ দেখান নি, বরং এই আদালতের বিচারকাজকে অবমাননা এবং উপেক্ষা করেছেন। তাঁর হাবভাবকে ট্রাইব্যুনাল দম্ভ হিসাবে দেখেছে এবং বার বার সতর্ক করার পরেও তিনি পুরো বিচার প্রক্রিয়া চলার সময়েই চিৎকার-চেচামেচি করে ট্রাইব্যুনালের সৌষ্ঠবকে নষ্ট করেছেন। ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তাদের প্রতি কোনো সম্মান তিনি প্রদর্শন করেন নি এবং ট্রাইব্যুনালের কর্তৃত্বকে অমান্য করে গিয়েছেন প্রতিনিয়ত।“ এই দম্ভ এবং অমান্য করার ইতিহাস সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের বহু পুরোনো। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ, জামাত-ই-ইসলামি এগুলোর মতো ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা দিয়েছিলো। এরা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রাজাকার, আল-শামস, শান্তি বাহিনী এবং অন্যান সশস্ত্র দলগুলোকে সুসংগঠিত করেছিলো এবং নির্বিচারে হত্যা লুণ্ঠন, জ্বালাও, পোড়াও নীতি নিয়েছিলো স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপরে। এই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি রাজাকার এবং আল-শামসের জন্য স্থানীয় তরুণদের নিয়োগ করতো এবং সাধারণ মানুষ, হিন্দু ধর্মালম্বী এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকদের নির্বিচারে হত্যা করতো। এদের সহযোগিতা ছাড়া, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের পক্ষে খুন, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অপরাধসমূহ করা সম্ভবপর ছিলো না। ফজলুল কাদের চৌধুরী কনভেনশনাল মুসলীম লীগের অন্যতম প্রধান একজন নেতা ছিলেন। আইয়ূব খানের মৃত্যুর পর এক সময় তিনি কনভেনশনাল মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টও হন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, ন্যাশনাল এসেম্বলির স্পিকার হিসাবে কাজ করেছেন এবং পাকিস্তানের সাময়িকভাবে স্থলাভিষিক্ত প্রেসিডেন্টও ছিলেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার শক্তির বিপক্ষে লড়াইয়ে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেই সময়ে তাঁর বয়স ছিলো প্রায় ২২ বছর। ফজলুল কাদের চৌধুরীর একমাত্র সাবালক ছেলে ছিলেন তিনি। বাবার রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন সালাউদ্দিন এই মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপক্ষে অবস্থান নেন তিনি। নির্বিচারে হত্যা, গণহত্যা এবং অন্যান্য মানবতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হয়ে যান। তাঁদের পারিবারিক বাসস্থান ‘গুডস হিল’ থেকে স্বাধীনতা বিরোধী সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। গুডস হিল হিন্দু জনগোষ্ঠী ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকদের অত্যাচার এবং নির্যাতনের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশে একক পরিবার হিসেবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নৃশংস অত্যাচার চালানোর অভিযোগ রয়েছে কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরীর পরিবারের বিরুদ্ধে। ফজলুল কাদের চৌধুরী আর তাঁর ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীই সে সময় পাকবাহিনীর সহায়তায় তার অন্য অনুচরদের নিয়ে সমগ্র রাউজান ও চট্টগ্রাম শহরে ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। হত্যা, নির্যাতন, লুট-তরাজ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী চালিয়ে যান একাত্তরের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই। এই অত্যাচার বন্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ছোট দল তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনাও করেছিলো তাঁরা। সেই অনুযায়ী এক বৃষ্টিমুখর রাতে তাঁরা হামলা চালান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়ির উপরে। খবর ছিলো যে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গাড়ির সামনের সীটে থাকবেন। পরিকল্পনা মতো হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু সালাউদ্দিন ছিলেন গাড়ির পেছনের সীটে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করলে ড্রাইভার নিহত হয়। পায়ে গুলি লাগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। আহত অবস্থা পালিয়ে যান তিনি। এর পর পরই তাঁর বাবা তাঁকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। এগুলো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর একাত্তরের অপকর্মের সামান্য কিছু অংশ মাত্র। তাঁর রায়ের পূর্ণ বিবরণীতে তাঁর কুকীর্তির প্রায় সবকিছুই বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা আছে। অথচ এই ব্যক্তিটি স্বাধীনতার পরে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন সদম্ভে, সাড়ম্বরে। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে রাজনীতির পথে পা বাড়ান সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী। ৭৯ সালে মুসলিম লীগের হয়ে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়িতে নির্বাচন করেন তিনি। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া দু’টি সংসদীয় আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাঙ্গুনিয়া আসনটি রেখে রাউজান আসনটি ছেড়ে দেন সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী। পরে যোগ দেন জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে। জায়গা পান স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের মন্ত্রিপরিষদে। দায়িত্ব পালন করেছেন ত্রান মন্ত্রনালয়, গণপুর্ত মন্ত্রনালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের।পরে জাতীয় পার্টি ছেড়ে নিজেই গঠন করেন এনডিপি(ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক পার্টি)। এক পার্টি, এক নেতা ও এক আসন(রাউজান-চট্টগ্রাম) নিয়ে জাতীয় সংসদে তিনি এনডিপির নেতা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। ৯০-এর দশকে এসে যোগ দেন বিএনপিতে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী। ২০০৯ সালের ৬ই ডিসেম্বর বিএনপি’র পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।          

  বহি:শত্রুর সাহস পেয়ে সাকা চৌধুরী দেশের প্রচলিত আইনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।রাষ্ট্রকে ৭২'-৭৫সালের অবস্থানে চিন্তা করে দম্ভোক্তি করতেও কুন্ঠাবোধ করেননি।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন