বিশ্বমানবতার কল্যানে প্রেরিত ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশের হেফাজতে বিভ্রান্ত!!
(রুহুল আমিন মজুমদার)

      হাইকোর্টের সামনে রক্ষিত ন্যায় বিচারের প্রতিক ভাস্কায্যকে হেফাজতে ইসলাম দেবিমূর্তি নাম দিয়ে সরানোর জন্যে সরকারকে টাইমপ্রেম বেঁধে দিয়ে হুমকি দিয়েছেন। অনেকেই হেফাজতের এই হুমকিকে যৌক্তিক আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধ সমালোচনাকে ইসলামের দৃষ্টিতে গুনাহ এবং গহ্যিত কাজ মনে করে প্রকারান্তরে হেফাজতের পক্ষাবলম্বন করেছেন। আমিও ব্যাক্তিগতভাবে তাঁদের সাথে সম্পূর্ণ একমত। আমিও মনে প্রানে বিশ্বাস করি, সত্যিকার অর্থেই মুর্তিস্থাপন মস্তবড় পাঁপ এবং বড় ধরনের গোনাহ।

     আমি আরো মনে করি গনতান্ত্রিক সমাজে বাস করা, গনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া, গনতন্ত্রের অন্যতম বাহন বাকও ব্যাক্তি স্বাধীনতা ভোগ করা, গনতান্ত্রিক অধিকারের  সুযোগ গ্রহন করে আন্দোলন করা, বাক সস্বাধীনতার সুযোগ গ্রহন করে বক্তৃতা বিবৃতি প্রকাশ করা--ইত্যাদি সমস্তই মস্ত বড় বড় গুনাহের কাজ। মুলত: গনতন্ত্রে ভোগ, চাওয়া, পাওয়া, সমস্তই পাপ এবং বড় ধরনের গোনাহ।

      আল্লাহ প্রদত্ত ঐশ্বরিক গ্রন্থ আল কোরানের আলোকে বিশ্বব্রম্মান্ডের মানবজাতির কল্যানে তাঁর প্রেরিত দূত(রাসূল স:) কতৃক প্রবর্তিত ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি অনুসারে  একটি আধুনিক, জন কল্যানকর, সাম্য ও সমতা ভিত্তিক রাষ্ট্র শাষন ব্যবস্থার নাম হচ্ছে "ইসলামি শাষন ব্যবস্থা"। অপরপক্ষে গণতন্ত্র আল্লাহর সৃষ্ট অসংখ্য জীবকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠজীব মানবজাতি কতৃক প্রবর্তিত বিদ্যমান বিশ্বের উন্নত, আধুনিক, বিজ্ঞান ভিত্তিক,  কল্যানকর রাষ্ট্র শাষন ব্যবস্থার আধুনিক নাম হচ্ছে "গনতান্ত্রিক শাষন ব্যবস্থা"। উভয়ের মধ্যে নিশ্চিত আল্লাহর প্রেরিত গ্রন্থের আলোকে এবং তাঁর প্রিয় বন্ধু নবী মোহাম্মদের প্রবর্তিত ও প্রচারিত জীবন বিধান--"নি:সন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে।" ইসলামী জীবন বিধান বা ইসলামী শাষন শ্রেষ্ঠ--ইসলাম ধর্মের অনুসারি সকল মসুলমানকে  অবশ্যই ইহার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।

     ইসলাম ধর্মের অনুসারী যে কোন কাউকে উভয়ের মধ্যে একটিকে যদি বেছে নিতে বলা হয়, তিনি যদি একজন খাঁটি মোমিন হন  "ইসলামী শাষন ব্যবস্থাকে"ই  বেছে নিবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই।

     মানব সৃষ্ট গনতান্ত্রিক শাষনে বহু মত ও পথের অস্তিত্ব বিদ্যমান।গনতন্ত্র আধুনিক ও সৃজনশীলতার পূজারি।অন্যদিকে ইসলামী শাষন ব্যবস্থা এককেন্দ্রিক, একমতের, একপথের। ইসলামী শাষনে কোরান ও হাদিসের আলোকে আইন প্রনয়ন, প্রয়োগ, শাষনকায্য পরিচালনা ইত্যাদি বাধ্যতামূলক।গনতন্ত্রে যুগের চাহিদা অনুযায়ি পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংকোচন, সংযোজন রীতি সিদ্ধ।অন্যদিকে ইসলামী শাষনে যুগের চাহিদা অনুযায়ি নবীজি কতৃক নির্দিষ্টদের দ্বারা পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংকোচন, সংযোজন রীতি সিদ্ধ। তবে অবশ্যই তাহা "পবিত্র কোরান ও হাদিসের" অভ্যন্তরে থেকেই করতে হবে।কোরানের একটি শব্দ, জের, যবর পরিবর্তন করার ক্ষমতা কেয়ামত পয্যন্ত আল্লাহ কাউকে দেননি, এবং কি তাঁর প্রিয় বন্ধু নবীজিকেও নয়। আল্লাহ নিজেই তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ  পবিত্র কিতাব "আল-কোরানে ঘোষনা করেছেন--তিনিই "একমাত্র এবং একমাত্র উক্ত কিতাবের হেফাজতকারি।" কোরান হেফাজতের  অর্থই ইসলাম ধর্মের হেফাজত, কোরানের হেফাজতকারি যেহেতু আল্লাহ স্বয়ং ইসলাম ধর্মের হেফাজতকারীও অবশ্যই স্বয়ং তিনি। এই জন্য নবীজি আল্লাহর হুকুমে তাকাওর বিদায়ি ভাষনে বলে দিয়েছেন--"এর পর আর কোন কিতাব আসবেনা, আর কোন নবীও আসবেনা, আর কোন ধর্মও আসবেনা।" আসেওনি এই পয্যন্ত ভবিষ্যতেও আসবেনা ইহাই সত্য।
 
    আল্লাহ তাঁর নবীর মাধ্যমে মক্কা জয়ের উদাহরন, মক্কা নগরকেন্দ্রিক ইসলামী শাষন ব্যবস্থা প্রবর্তন, নগর রাষ্ট্রকে ইসলামী সাম্রাজ্যে রুপান্তর, ইসলামী রাষ্ট্র শাষন ব্যবস্থার লিখিত নীতি, নবীজির মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় শাষনভার পরিচালনার পদ্ধতি ইত্যকার সমূদয় বিষয়াবলীর প্রত্যক্ষ নজির নবীজির মাধ্যমে  পরবর্তি ইসলাম ধর্মের অনুসারি প্রজম্ম থেকে প্রজম্মান্তরের অনুসরন, অনুকরনের নিমিত্তে স্থাপন করেছেন। নবীজির মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্বস্ত চার সাহাবী ক্রমানুসারে ইসলামী সাম্রাজ্যের খেলাফতের খলিফার দায়িত্ব পালন করার নজির বা উদাহরন প্রজম্মান্তরের জন্য সংরক্ষিত রেখেছেন।
 
    আগেই উল্লেখ করেছি পবিত্র কোরানের সামান্যতম পরিবর্তন করার ক্ষমতা আল্লাহ কাউকে দেননি।নবীজির কথা, কাজ ইত্যাদি হাদিস আকারে পরবর্তি মুসলিম ধর্মালম্বিদের অনুসরন, অনুকরন বাধ্যতামুলক। কোরানের যেমন কোন পরিবর্তন গ্রহনযোগ্য নয় তেমনি হাদিসেরও কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংকোচন, বিয়োজন গ্রহনযোগ্য নয়। তাহলে দেখা যায় নবীজি যেরুপে ইসলাম প্রচার প্রসারে তাঁর কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন, উহাই একমাত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের সঠিক পথ। নবীজি যেইরুপে রাষ্ট্র জয়, শাষন, খলিফা মনোনয়ন, জীবন যাপন ইত্যকার কায্যাদি সম্পন্ন করেছেন--"উহাই ইসলামের সঠিক রীতি এবং নীতি।" সর্বযুগে উক্তরুপ রীতিনীতি অনুসরন, অনুকরন প্রত্যেক মসুলমানের জন্যে অবশ্যই বাধ্যতামূলক এবং কর্তব্য। ব্যাতিক্রমে অবশ্যই বে'দাত, ইসলামের অনুশাষন অমান্যকারি, খোদাদ্রোহি, ইসলামের সাথে সম্পর্ক চিহ্নকারি,  মোনাফেক হিসেবে পরিচিত হবেন।

      এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই---ইসলাম ধর্ম পালন, ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীন আরকাম, আহকাম পালন, পবিত্র কোরান অনুসরন, সেই মতে নিজের জীবন পরিচালনার কথা বার বারই কোরান ও হাদিসে তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্ত্যু এই সমস্ত কায্যাদি সম্পন্ন করার জন্যে অবশ্যই "ইসলামী শাষন ব্যবস্থা কায়েমে"র প্রয়োজন রয়েছে, তেমন কোন তাগিদ আল্লাহ তাঁর কোরান  বা  রাসূল তাঁর হাদিসে দেননি। বরঞ্চ কাফের, বিধর্মী শাষনে ইসলাম ধর্মের অনুসারি মুসলিমদের জীবন যাপন, আল্লাহর এবাদতে মুসলিম কতৃক শাষিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার চেয়ে ভিন্নতর কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।মুসলিমদের যে যেখানেই বসবাস করুক না কেন, সে সেই দেশের আইনকানুন, রীতিনীতি মেনে দেশপ্রেমের উদাহরন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং দেশপ্রেমকে "ঈমানের অঙ্গ" হিসেবে ঘোষনা করেছেন।

ইসলামী শাষন ব্যবস্থা ব্যাতিরেকে ধর্ম পালন যথাযথ নয় এমনটি যদি হতই তাহলে আল্লাহর অনুগ্রহেই বিশ্বব্রম্মান্ডে একাধিক ইসলামী হুকুমতের দেশ পরিলক্ষিত হ'ত।অথবা মরনপন লড়ায়ের মাধ্যমে হলেও ইসলাম ধর্মের অনুসারি কোটি কোটি মুসলিম তৌহিদি জনতা নীজেদের একটি আবাস ভুমি প্রতিষ্ঠা করতেন। তথায় ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ধর্ম পালন করতেন অথবা অন্যভাবে বলা যায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। যেহেতু ইসলামী হুকুমত ব্যাতিরেকে ধর্মকর্ম পালনে শুদ্ধতা আসার অন্যকোন বিকল্প পথ সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাখেননি। তদ্রুপ কি হয়েছে বা  ঘটেছে?

আল্লাহ এক হুকুমে সারা জাহান সৃষ্টি করেছেন, আর এক হুকুমে আদম (অ:) এবং বিবি হাওয়া (রা:)কে সৃষ্টি করেছেন। একলক্ষ বা দুইলক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন--তাঁদের মাধ্যমে একশত চারটি আসমানী পবিত্র কিতাব পাঠিয়েছেন। তাঁর দুনিয়ায় সৃষ্ট মানবজাতিকে সু-পথে আনার জন্যে, তাঁর এবাদত করার জন্যে।আর একটি হুকুমে কি তাঁর প্রিয় ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের জন্যে আলাদা একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে পারতেন না? বা সমুদয় মানব জাতিকে ইসলাম ধর্মে উদ্ভোদ্ধ করতে পারতেন না ? কেন করেন নি?
   
     নবী (স:) যখন সদলবলে মক্কা জয় করেন তখনও মক্কা শরিফের ভিতরে তিনশত ষাটটি মূর্তি রক্ষিত ছিল।তিনি সব গুলী মুর্তি ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কথিত আছে একটামাত্র মুর্তির অস্তিত্ব রেখে দেয়া হয়েছিল আগামী প্রজম্মের নিকট উদাহরন হিসেবে তুলে ধরার নিমিত্তে। অর্থাৎ বিজিত মক্কা নগরীতে আর কোন মুর্তির অস্তিত্ব ছিল না। সম্পুর্ণ মক্কা ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের বাসস্থানে পরিণত হয়েছিল। তারপরেই মক্কা নগরীকে "পবিত্র নগরি" ঘোষনা করেছিলেন নবীজি (স:)--তাঁর আগে নয়।


   পাঠক বন্ধুরা, সাধারন মুসলিম পরিবারে জম্মগ্রহন করার কারনে আমিও ইসলাম ধর্মের অনুসারি হিসেবে, বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে শ্রবন করা বক্তব্যের আলোকে নিজের ধর্মের সঙ্গে বর্তমানের ইসলাম ধর্ম প্রচারকারি, প্রতিষ্ঠাকারী, ধারক, বাহকদের বৈপরিত্য সম্পর্কে কিঞ্চিত সঞ্চিত জ্ঞানের আলোকে আলোচনা করতে পারি।কিন্ত্যু তাঁদের চেষ্টা  কোন অবস্থায় সম্পূর্ণ বা আংশিক সঠিক নয় বলতে পারিনা। পাঠক গনের উপলব্দিতে যাঁর যেমনটি আসে তাঁর তেমনটি বোধগম্যতা জাগিয়ে সঠিক সত্য, বেদাত, মিথ্যা যাছাইয়ের সুযোগ হতে পারে চিন্তা থেকেই আলোচনার সুত্রপাত।কারন ধর্মীয় জ্ঞান ধারন করার ক্ষমতা আল্লাহ আমি এবং আমার ন্যায় কোটি কোটি জম্মগ্রহনেই ইসলাম ধর্ম অনুসারীকে দেয়নি।

উল্লেখিত আলোচনায় প্রকাশ পেয়েছে ইসলামের হেফাজতকারী একমাত্র আল্লাহ। অন্য কেহ ইহার দাবীদার হ'তে পারেনা। তদ্রুপ যদি কেহ বা কোন মহল দাবীদার অনুমেয় হয়, তবে নিশ্চিত ধরে নেয়া যায়, তিনি বা তাঁরা খোদায়ী দাবীকারক? খোদায়ী দাবীকারক নি:সন্দেহে শিরকের সামিল।সুতারাং হেফাজতে ইসলামের নামের মধ্যেই অর্থ্যাৎ অংকুরেই শীরকের গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। ইসলামী শাষন ব্যবস্থা প্রবর্তনের আন্দোলন ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে সমর্থন যোগ্য এবং অবশ্যই সঠিক।হেফাজতে ইসলাম "ইসলামী শাষন ব্যবস্থা" কায়েমের লক্ষে আন্দোলনরত:,নাকি 'ইসলামের হেফাজত' করার আন্দোলনরত:? তাঁরা প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে একাধিকবার বলেছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লোভ তাঁদের মধ্যে কারো নেই। অন্যদিকে ইসলামের হেফাজতকারীর অধিকার আল্লাহপাক নীজের কাছেই রক্ষিত রেখেছেন, তিনি তাঁর কোরানেই স্পষ্টভাবে ঘোষনা করেছেন। ইসলামের হেফাজতকারীর ভুমিকায় অবতীর্ন হয়ে "হেফাজতে ইসলাম" আল্লাহর সমকক্ষ দাবীদারের ভুমিকায় অবতির্ন হয়েছেন কিনা--"প্রকৃত আলেম, ওলামা, ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারিগন অবশ্যই ভেবে দেখার সময় হয়েছে।"

দ্বিতীয়ত আলোচনায় এসেছে, নবী (স:) মক্কা জয় করার পর কাবা ঘরের সকল মূর্তি ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হেফাজতে ইসলাম সহ অপরাপর ইসলামী দল সমূহ বাংলাদেশের আনাছে কানাছে অসংখ্য তথাকথিত মূর্তির অবস্থান অক্ষুন্ন রেখে, শুধুমাত্র হাইকোর্টের সামনের কথিত 'দেবিমূর্তি' সরানোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। তাঁরা কি ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বা অন্যকোন নগরী জয় করে ইসলামী হুকুমত কায়েম করেছেন? কোন নগর, বন্দরে ইসলামী ঝান্ডা স্থাপন ব্যাতিত ইসলামের দৃষ্টিতে "বাতিল গনতান্ত্রিক শাষন ব্যাবস্থা" এবং এর সরকারের সঙ্গে তাঁরা কি জোর জবরদস্তি মূলক ফ্যাসাদে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টারত: হননি? ইসলামী শাষন ব্যাতিত তদ্রুপ ফ্যাসাদ সৃষ্টি ইসলাম ধর্ম কি অনুমোদন করে?

    আমাদের দেশের ইসলামের ধারক বাহক "হেফাজতে ইসলাম" সহ অন্যান্ন ইসলামী দল সমূহ সারাদেশে লক্ষ লক্ষ কথিত মুর্তি উচ্ছেদ, সরানো, ভাঙ্গার আন্দোলনে সম্পৃত্ত নয়। মূর্তি স্থাপন  না করার সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজন "ইসলামী হুকুমতের সরকার প্রতিষ্ঠা।" একক ইসলামী শাষন ব্যবস্থা কায়েমের  লক্ষে জনমত সংগঠিত হওয়া পয্যন্ত অপেক্ষা না করে, গনতান্ত্রিক সরকারের নিকট মূর্তি সরানোর আবেদন বা দাবী, ইসলাম কি অনুমোদন করে?নবীজি কি মক্কা জয় করা পয্যন্ত কাফেরদের নিকট 'কাবাঘরে' রক্ষিত মুর্তি সরানোর আবেদন করেছিলেন? একটি মাত্র মুর্তি সরানো বা ভাঙ্গার আন্দোলনের অর্থ কি বাতিল "গনতান্ত্রিক সরকারের" সাথে ফ্যাসাদে জড়ানো নয়? ফ্যাসাদ সৃষ্টি বা ফ্যাসাদে লিপ্ত হওয়া ইসলাম কি অনুমোদন করে?

   বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গনতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র সমূহ পরিচালিত হচ্ছে। একক ইসলামি অনুশাষনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না।কোন কোন ইসলামী রাষ্ট্র আংশিক গনতন্ত্রের মধ্যে থেকে সকল ধর্মের অনুসারি গন নিজ নিজ ধর্মকর্ম,  উৎসব, আনন্দ উপভোগরত: রয়েছে। ইসলামের পিতৃভূমি আরব দেশ সহ অন্যান্ন সকল মুসলিম প্রধান দেশেই স্ব-স্ব জাতির জনকের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। সকল রাষ্ট্রেই মুসলিম জাতির জনক হযরত ইব্রাহিম (অ:) এবং নিজস্ব জাতির সত্বার জনকের বিভাজন রেখে, জাতি সত্বার উম্মেষকারির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করার রীতি চালু রেখেছেন।
গনতন্ত্রের সৃজনশীলতার অংশ হিসেবে সকল দেশেই তাঁদের নিজস্ব জাতি গোষ্টির শিল্প সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি চর্চা কমবেশি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ধর্মকর্মও যথারীতি ভাবগাম্ভিয্য নিয়ে পালিত হচ্ছে--কোথাও কোন মুসলিম প্রধান দেশেই আলেম ওলামাদের কোনরুপ সমস্যা হচ্ছে, তেমনটি শুনা যায়না।শুধু মাত্র বাংলাদেশে বাঙ্গালী জাতির পিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বর্তমান সময়ে হাইকোর্টের সামনে রক্ষিত ন্যায় বিচারের প্রতিক ভাস্কায্যে সমস্যা হচ্ছে--"তথাকথিত হেফাজতে ইসলাম সহ কতিপয় ধর্মীয় দলের।"

       অথচ সৌদি আরবের জেদ্দাতেই আছে দুই দুইটি মূর্তি! একটি উটের ‘মূর্তি’, আরেকটি মুষ্টিবদ্ধ হাত সদৃশ ‘মূর্তি’। এসব নিয়ে সেই দেশের আলেম সমাজের মধ্যে কোনো সমস্যা হয় না। বর্তমান সৌদী বাদশাহর সর্ব বৃহৎ মূর্তি প্রতিস্থাপিত হয়েছে এই সেই দিন। আলেম ওলামাদের মধ্যে কোনরুপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি।

পারস্যের কবি শেখ সাদীর নাম আমরা সবাই শুনেছি,বাংলাদেশের আলেম ওলামাগন তাঁর রচিত হামদ ও নাৎ মধুর স্বরে কন্ঠে ধারন করে শ্রোতামন্ডলিকে বিমুগ্ধ করে রাখেন।’-এ দেশের ধর্মপ্রাণ সাধারন মুসলমানেরা মিলাদে সব সময় পাঠ করে থাকেন--‘বালাগাল উলা বি কামালিহি কাশাফাদ্দুজা বি জামালিহি।’ বাংলাদেশের তথাকতিথ "হেফাজতে ইসলাম" কি জানেনা, শেখ সাদীর মাজারের সামনেই তার একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য আছে। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা তা কখনো  ভাঙেনি বা ভাঙ্গার আন্দোলনও করেনি।

ইসলামি রাষ্ট্র ইরানে অবস্থিত কবি ওমর খৈয়াম ও মহাকবি ফেরদৌসির ‘মূর্তি’  স্থাপন করা আছে।সেই দেশের আলেম ওলামাদের উক্ত মুর্তি সরানোর আন্দোলন করতে শুনা যায়নি।তাছাড়া সেখানে ক্ষমতায় রয়েছে ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারি আলেম সমাজ,তাঁরা ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তেহরানে অজস্র মানুষের প্রতিকৃতি সম্বলিত ‘মূর্তি’ নিয়ে সে দেশের ক্ষমতাসীন আলেমদের সরকারের কোন সমস্যা হয়েছে বলে শুনা যায়নি।  সিরিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে থাকা ‘মূর্তি’ নিয়েও সেই দেশের আলেম ওলামাদের কোন সমস্যা হয়েছে এ পয্যন্তও শুনা যায়নি।

একটিমাত্র মূর্তি নিয়ে বাংলাদেশে কেন সমস্যা হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের?
অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের জবাবে পরিস্কার বলেছেন,‘এটা  মূর্তি নয়। এটা স্কাল্পচার (ভাস্কর্য)।  উক্ত ভাস্কায্যের মধ্যে দেখানো হয়েছে তিনটি জিনিস। একটি হলো দাঁড়িপাল্লা---"ন্যায়বিচারের সূচক। হাতে একটি তলোয়ার---"দণ্ড বা শাস্তির সূচক"। তৃতীয়টি চোখ বাঁধা-- অর্থাৎ নিরপেক্ষ বিচার বা বিচারকের চোখ অন্ধ অর্থে। তিনি আরো বলেছেন-- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বিচারের নিরপেক্ষতা তুলে ধরা হয় এই স্কাল্পচার  বা ভাস্কায্য দিয়েই।’ তদোপরিও আমাদের তথাকথিত ইসলামের হেফাজতকারিরা মানতে নারাজ, মুর্তি সরাতেই হবে।

     উক্ত বিষয়ে উপসংহারে বলতে পারি--সূদুর অতীতকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের একশ্রেনীর আলেম ওলেমা, ইসলাম ধর্মজ্ঞান শুন্য ব্যাক্তি ও দল, আরবি জ্ঞানার্জনের ধারে কাছে না যাওয়া তথাকথিত আলেম ওলামা, বর্তমান সময়ে উপমহাদেশে নতুন অবির্ভুত ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন আলেম ওলেমা কতৃক গঠিত 'ইসলামের হেফাজতকারি' পবিত্র ধর্ম ইসলামকে যত্রতত্র ব্যবহার করে সাধারন ধর্মপ্রান মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় ব্রতি ছিলেন, আছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতেও প্রক্রিয়াটি আরো শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে জোরালো ভাবেই অব্যাহত রাখবেন।
অতীতে যতবারই সাধারনের ধারনায় "আল্লাহ ও তাঁর নবী বিরুদ্ধ ধর্মাশ্রয়িগন" শক্তি সঞ্চয় করে সাধারনের উপর চড়াও হয়েছেন, বা হওয়ার চেষ্টা করেছেন, ততবারই নাজেহাল, নিয্যাতীত, লানতের ভাগিদার হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। ইহা কি ধর্মদ্রোহিতার কারনে স্বয়ং আল্লাহর পরোক্ষ প্রত্যক্ষ হুকুমে তাঁর নির্দেশিত লানতের নজির নয়?

      বর্তমানেও সারা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ট ইসলাম ধর্ম অনুসারি দেশ সমূহের আলেম ওলামাদের বিপরীতে বাংলাদেশের আলেম ওলামাদের অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোনপ্রকার মন্তব্য না করে শুধুমাত্র বলা যায়--হয় বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ অথবা হেফাজতে ইসলাম ধর্মদ্রোহি, মোনাফেক--নয়তো সারা বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত দেশের নাগরিক অথবা আলেম সমাজ ধর্মদ্রোহী, মোনাফেক।
যেহেতু বিশ্বমানবতার কল্যানে প্রেরীত ইসলাম ধর্মের বিভিন্নদেশে বিভিন্নরুপ হওয়ার কোন সুযোগ অতীতেও ছিলনা, বর্তমানেও থাকার কথা নয়, ভবিষ্যত সে তো সুদুরপরাহত।
        ruhulaminmujumder27@gmail.com
   
    

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন