ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার গনতন্ত্র, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে প্রকৃত ভুমিকা পালন করার সময় এসেছে---- ___________________________________ এমন একটি সময় ছিল যখন পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রোনিক মিডিয়া বলতে- হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা আর বাংলাদেশ টেলিভিশন।তাও আবার বাংলাদেশের সব জায়গায় পত্রিকাও পাওয়া যেতনা টিভিও দেখা যেতনা।তখনকার পরিবেশে গ্রামের মাতব্বরের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হত ব্যাক্তি রাজনীতির ধারনা। আমি বলছি সামন্ততন্ত্রের পরের কথা।সামন্তপ্রথা উচ্ছেদ হয়েছে অনেক আগেই কিন্তু রেশ রয়ে গেছে সামাজিক অনোন্নতির-অনগ্রসরতার কারনে।এখন সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে।পত্রিকার সংখ্য অনেক গুন বেড়েছে, ইলেকট্রোনিক মিডিয়াও আকাংখার চাইতে অনেক গুন বেশি বেড়েছে।একটি টিভি ষ্টেশনের বার ঘন্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে শতশত মিডিয়ার দিন রাত ছব্বিশ ঘন্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার। এক দেড় ঘন্টা বিনোদনের স্থলে ছব্বিশ ঘন্টা বিনোদন মুলক অনুষ্ঠান উপভোগের ব্যবস্থা হয়েছে। ঘরে ঘরে টিভি দেখার সুযোগ হয়েছে।হাতের মধ্যে মেঠোফোনে দুনিয়ার খবর সংরক্ষিত আছে।ইচ্ছে হলেই দেখা যায় পড়া যায়।গুরুত্বপুর্ন তথ্য উপাত্তের জন্য কারো দ্বারস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই- গুগল চার্জ দিলেই পাওয়া যাচ্ছে কাংখিত তথ্য। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনায়নের নীতিহীনতার কারনে সর্বত্র দেখা দিচ্ছে বৈপরিত্ত। সমাজ কাংখীত অগ্রগতি লাভ করছে ঠিকই --নেমে যাচ্ছে নীতি নৈতিকতার মান।বাড়ছে মানুষের সংখ্যা,কাজের পরিধি-নামছে ধর্মীয় চেতনাবোধের সুচক।সমাজ রুপান্তরীত হচ্ছে তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভরতায়-ধর্মে ধারন হচ্ছে অন্ধত্ব, উগ্রতা।জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছে নারী পুরুষ-সমাজে বাড়ছে অবক্ষয়, নগ্নতা।রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন আইন-বাড়ছে হত্যা গুম,নারী নির্য্যাতন। ইত্যকার ইতিবাচক উন্নয়ন অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে নেতিবাচক কর্মের পরিধি।সর্বক্ষেত্রে বিপরীত মুখী, পশ্চাদপদতা, উগ্রতা, অসহনশীলতা, বাগাড়ম্বরতায় সমাজ ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে নেমে আসছে অন্ধকার যুগের আদিম নেশা। দেশের মিডিয়া সমুহ এক্ষেত্রে সমাজ পরিবর্তনের ধারাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যে ভুমিকা পালন করার দরকার ছিল তা পালন করতে পারছে বলে মনে হয়না। এক্ষেত্রে আমি ছোট দু'টা উদাহরন দিতে চাই।কোন নারী ধর্ষিতা হলে ছবি চাপানোর কথা ছিল ধর্ষকের -মিডিয়া ধর্ষিতার ছবিতো চাপেই বরং ধর্ষিতা কোন প্রকৃতির ছিল তাও ব্যাখ্যা করার অপপ্রয়াস চালায়।যে কোন নির্বাচনে দেখা যায় পাঁচটি কেন্দ্রে গোলমাল, মারামারি ইত্যাদি সংঘটিত হয়েছে-মিডিয়া সারা দিনরাত ঐ পাঁছটির চিত্রই দেখাতে থাকে-পঞ্চাশ কেন্দ্রে স্বাভাবিক ভোট প্রক্রিয়া সমাপ্ত হচ্ছে বা স্বাভাবিক ছিল ঘুনাক্ষরেও সেদিকে ক্যামরা যায়না। সাধারন মানুষ এই থেকে যে বার্তাটি পায় তা হচ্ছে মেয়েদের নগ্নতার কারনে মেয়েরা ধর্ষিতা হচ্ছে।ভোট জনগন নিজের পছন্দমত প্রার্থীকে দিতে পারছেনা। সন্ত্রাস নির্ভর ভোটে স্বাভাবিকভাবে মানুষ আস্থা হারিয়ে ভোট প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাবে।এতে গনতন্ত্রের বা নির্বাচন প্রক্রিয়ার পিছনে মিডিয়া ছুরিকাঘাত করছে তা মিডিয়ার জ্ঞানে আসছেনা। মিডিয়া প্রকারান্তরে মেয়েদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রাখার কাজে সাহায্য করছে তাও তাঁদের জ্ঞানে আসছেনা। এক্ষেত্রে মিডিয়া দেশের প্রতিতযষা,জ্ঞানী, গুনী, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে স্ব-স্ব বিষয়ের -অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার প্রয়োজন ছিল।যে বিষয়ের উপর আদৌ কোন জ্ঞান রাখেনা সেই বিষয়ে বলতে দেয়া হয় আনাড়ি কিছু ব্যাক্তি বিশেষকে।ফলত: দেখা যায় উদ্ভট তথ্য উপাত্তের বিরক্তিকর ছড়াছড়ি। ইদানিং রাজনৈতিক দলসমুহের সভা সমাবেশ নেই বললেই চলে।মানুষের রাজনীতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমাদের দেশে আগে থেকেই সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে যুক্ত হয়ে আছে।তাঁর মনের আগ্রহ যেহেতু পুরন করার জন্য দলগুলি কোন ব্যবস্থা নেয়না সংগত কারনে মিডিয়ার রাজনৈতিক 'টকশোর' দিকেই তাঁর মনোযোগ।ফলে গভীররাত পয্যন্ত অপেক্ষা করে হলেও সে টক শো শুনবেই।শহরের লোকদের চাইতে গ্রামের লোকেরাই এই সমস্ত সস্তা আলোচনা শুনতে চায় বেশি। দর্শক শ্রোতাদের এমনতর দুর্বলতার সুযোগে মিডিয়া গভীর রাতে অচেনা অজানা, অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত তৃতীয় শ্রেনীর রাজনীতিবিদদের টিভি সেন্টারে হাজির করে 'সমসাময়িক রাজনীতির' উপর আলোচনার আয়োজন করে।মারমুখি আলোচনা শুনতে মানুষের অবশ্যই ভাল লাগে।ভাল লাগার মাঝে ঐ ব্যক্তিটি যে উদ্ভট,মিথ্যা, অসামঞ্জস্য তথ্য দিয়ে সরল্প্রান গ্রামের দর্শককে বিভ্রান্ত করেছে তা কি মিডিয়া কতৃপক্ষ চিন্তা করেছেন? যদি চিন্তা করে থাকেন-- টকশোর বয়সতো আর কম হয়নি-নিয়ন্ত্রন করতে পারেননি কেন? দেশের রাজনীতির বিষয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষই শুধু নয়, স্বয়ং রাজনীতিবিদরাও নিজেদের ভুল ত্রুটি, সবলতা ও দুর্বলতা বুঝতে পারেন, জানতে পারেন। এছাড়া জাতীয় নানা ইস্যু নিয়েও সে রকম আলোচনা-সমালোচনা হলে সরকার রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমৃদ্ধ হতে পারে। আসল কথা হচ্ছে, আমরা আসলে টকশোকে কীভাবে দেখতে চাই, শেখার জন্য, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য? ইলেকট্রনিক মিডিয়া অত্যন্ত শক্তিশালী গণমাধ্যম। ইচ্ছা যদি সৎ থাকে মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের দেশ ও সমাজের অনেক কিছুই পরিবর্তন করা সম্ভব, আমি মনে করি। এটিকে শিক্ষার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হিসেবেও বিবেচনা করা যায়,হওয়ার কথা ছিলও তাই। মিডিয়া শুধু বিনোদনের মাধ্যমেই নয়- জীবন সম্পর্কে সচেতন, সমাজের বৈশম্য সম্পর্কে সচেতন করার মাধ্যম হিসেবেও এর কোনো তুলনা হয় না। যেহেতু সবকয়টি টিভি চ্যানেলই বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত সেহেতু তাঁদের আয়ের দিকেই নজর থাকবে বেশি। তাদেরকে চলতে হয় বিজ্ঞাপনের প্রাপ্ত আয়ের ওপর নির্ভর করে। সেখানে তারা অনেকটাই হয়তোবা বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। তারপরও সবকটি টিভি চ্যানেলেই যেহেতু 'টকশো' প্রোগ্রাম প্রচারিত হচ্ছে, তাই অনুষ্ঠানগুলোকে দেশ এবং জাতি গঠনে, রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি সচেতন জনগোষ্ঠী গঠনে উপযোগি করে নির্মান করা প্রয়োজন। সরকারও যুগ-উপযোগি সম্প্রচার নীতিমালা করা দরকার-যাতে কোন অবস্থায় টিভি চ্যানেলগুলি অর্থ সংকটের মুখোমুখি না হয়। দুনিয়ার অনেক দেশেই ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টকশো প্রচারিত হচ্ছে-প্রয়োজনে তাঁদের থেকে অভিজ্ঞতা ধার নেয়া যেতে পারে। অনুষ্ঠানের মান, প্রচারের ধরন, সময়, উপস্থিত বক্তার সামাজিক মায্যদা,আলোচিত বিষয়ের উপর তার দক্ষতা আমাদের মিডিয়া বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। জনগনকে শুধু বিভ্রান্ত করা নয় -উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রকল্প গ্রহন করার সময় এসেছে।বস্তাপঁচা অযৌক্তিক বিতর্ক নয়-যৌক্তিক তথ্যভিত্তিক, জ্ঞান সমৃদ্ধ শিক্ষনীয় আলোচনার আয়োজন করার সময় এসেছে। টকশোগুলোকে আরো বেশি জ্ঞানমুখী, সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতিমুখী করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার সময় এসেছে। অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় সবশ্রেনী পেশার জনগনের প্রতি খেয়াল করা দরকার। যাতে রাজনীতিক দল, ব্যাক্তি, সমাজ, সরকার জানতে পারে, সংশোধন হতে পারে, ভুলগুলি চিহ্নিত করে--শোধরানোর রাস্তা পেতে পারে। রাজনীতির আকাল সময়ে গনতন্ত্রকে সচল রাখতে প্রকৃত বিরুধী দলের ভুমিকায় অবতিন্ন হতে হবে মিডিয়া। সার্বক্ষনিক বস্তুনিষ্ট, তথ্য নির্ভর সংবাদ জনগনকে জানানো মিডিয়ার দায়িত্ব।আমাদের দেশের ব্যাংকের টাকা চুরি হয়- ফিলিপাইনের সাংবাদিক খবর পেলেও আমাদের চতুর সাংবাদিকেরা ঘুমে থাকে। আজগুবি খবর প্রকাশে যতটুকু বাহাদুরী দেখায় তার সামান্য মেধা বস্তুনিষ্টতায় খাটালেও দেশ এবং জনগনের অনেক বেশি কল্যান হতে পারে। ________________________________ জয়বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু জয়তু জাতির জনকের কন্যা বঙ্গরত্ম শেখ হাসিনা

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন