মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের পাশাপাশি জনগনের সহযোগিতা এবং বহিবিশ্বে জনমত গঠন করার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়



বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র থেকে বলছি (১৫তম খণ্ড) : অধ্যাপক আজিজুর রহমান মল্লিক।



কম্পাইল করেছেন – এইচএম ইব্রাহিম রাজু


এপ্রিলের মাঝামাঝি রামগড় থেকে আগরতলায় গিয়ে পৌছাই। দেশের মাটি ছাড়ার সময় আমরা যারা চলে যাচ্ছিলাম এবং আমাদের যেসব বন্ধু তখনও দেশে রয়ে গেলেন,সকলেরই চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আনিসুজ্জামানকে তখন বলেছিলাম, মন খারাপ করো না,এই বছর শেষ হবার আগেই আমরা স্বদেশে ফিরে আসব।আমি জানিনা সেই দুরবস্থার সময়ে এ প্রত্যয় কি করে আমার মনে জন্মেছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতে একথা আমি বহুজনকে বহুবার বলেছিলাম। এমনকি জুন মাসেই সিদ্ধার্থ সঙ্কর রায়কে বড়দিন উপলক্ষে চট্টগ্রামে আসার পর অগ্রিম নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।


আগরতলায় একটি পরিত্যক্ত বাসগৃহে আমার ও পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। অদূরে শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কলেজের একটি পরিত্যক্ত হোস্টেলে সৈয়দ আলী আহসান,রশিদুল হক ও কোরেশীর স্থান হয়। পরে এই হোষ্টেলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুল হক,আনিসুজ্জামান,ওসমান জামাল,চা বাগানের আব্দুল আউয়াল এবং মেজর শামসুদ্দিন,  মেজর শওকত ও মেজর শফিউল্লার পরিবার আশ্রয় লাভ করেন। এক-একটি কক্ষে এক-একটি পরিবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।


আগরতলায় আমার অনেক আগেই এসে পৌঁছেছিলেন জনাব এম,আর,সিদ্দীকি ও জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে কর্মপন্থা স্থির করার চেষ্টা করি।কিন্তু তাৎক্ষণিক কিছু করার ছিল না। তখন আমরা সকলেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার অপেক্ষা করছি। স্রোতের মতো  শরণার্থী আসছে। ঢাকা থেকে ও অনেক বন্ধু,  পরিচিত,স্বজন সেখানে এসে পৌঁছচ্ছেন। এখানে একদিনের দুপুরের খাবার এর কথা আমার মনে পড়ে।  অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খাবারের আয়োজন ছিল বেশ উন্নতমানের। আমরা খেতে বসেছিলাম। এই কদিন আমাদের সঙ্গে যেসব ছেলে কাজ করছিল তাদের যে দুরবস্থা আমি দেখেছি তা ভেবে আমার বিবেক নাড়া দিল,আমি খেতে পারলাম না। সৈয়দ আলী আহসান ও অন্যান্য সহযোগীদের বলে আমি এলাম এবং একটি সস্তা হোটেলে গিয়ে রুটি ও নিরামিষ খেলাম। প্রতিরোধ যুদ্ধে  পিছু হটলেও সীমান্তের কাছাকাছি তখনও যুদ্ধ চলছে। মেজর খালেদ মোশাররফ এসে ২/৩ রাত আমাকে যুদ্ধ ক্ষেত্রের কাছে নিয়ে যান। অচিরেই তাঁকে সদলে পিছু হটতে হয়। সঙ্গী অফিসারদের নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর জিয়া আগরতলায় চলে আসেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে আমার আগরতলায় পরিচয় হয়। ট্রান্সমিটার সমেত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রও উঠে আসে আগরতলায়। কিন্তু এর প্রচার শক্তি এত সীমাবদ্ধ ছিল যে,কর্মীদের আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফল ঘরে ঘরে পৌঁছতে পারেনি। পরে ড: ত্রিগুনা সেন যখন আগরতলা সফরে আসেন,তখন তাঁকে আমরা অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমাদের বেতারের জন্য শক্তিশালী ট্রান্সমিটার সরবরাহ করতে।


আগরতলায় থাকতে একদিন দৈনিক'স্টেটসম্যান'পত্রিকায় খবর দেখলাম যে,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারটা ছিল এই যে, এপ্রিল মে মাসে কাঠমুন্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবে আমার প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেবার কথা ছিল।নেপালি কর্তৃপক্ষ তাই পাকিস্তান সরকারকে আমার বিষয়ে লিখেন।  পাকিস্তান সরকার জানান যে,আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাঠমুন্ডুর কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে খবরটা ঐভাবে প্রকাশ পায়। পরে পাকিস্তান সরকার অনেক শরণার্থী সম্পর্কে ভারত সরকারকে লিখেছিলেন যে,দুষ্কৃতকারীরা তাদের ধরে ভারতে নিয়ে গেছে,এসব ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পাকিস্তান সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক। এই তালিকায় অবশ্য আমার নাম ছিল না।


মে মাসের প্রথম দিকে জনাব আব্দুল মালেক উকিল কলকাতা থেকে এক সন্ধ্যায় আগরতলায় আমার বাসায় আসেন। তিনি বললেন,প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন,তাঁর সঙ্গে দিল্লী যাবার জন্য।  উকিল সাহেব আমার কলকাতা যাবার বিমানের টিকিটও নিয়ে এসেছিলেন। পারিবারিক ব্যবস্থা সাঙ্গ করে কলকাতায় পৌছতে আমার দুই দিন বিলম্ব হয়। তাজউদ্দিন সাহেব দিল্লী চলে গিয়েছিলেন,আমার আর তখন যাওয়া হল না। এখানে উল্লেখ করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকালে সপরিবারে আমার ব্যয় নির্বাহের  জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আমাকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু তা আমি গ্রহণ করিনি।দেশের বাইরে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজন,ছাত্র-ছাত্রী ও বন্ধুবান্ধবের নিকট হতে প্রাপ্ত সাহায্যসামগ্রী দিয়েই আমি সংগ্রামের দিনগুলি কাটিয়েছি।


কলকাতা পৌঁছে বাংলাদেশ মিশন অফিসে আমাকে নেয়া হয়। হোসেন আলী তখন বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করে এই মিশনের অস্থায়ী প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন,বিদেশে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীকে টেলিফোনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজে যোগদানের অনুরোধ জানাতে। কলকাতায় তাঁদের ধারনা ছিল,বিচারপতি চৌধুরী এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছেন। টেলিফোন বুক করা হল। কিন্তু লাইন পাওয়া গেল না। শেষে তাঁর কাছে পাঠানোর জন্য আমি ম্যাসেজ রেখে গেলাম যে,আমি এসে গেছি উনি যেন বাংলাদেশের সমর্থনে কাজ করতে নেমে যান।


কলকাতায় এসে আমার প্রথম কাজ হয়Bangladesh Liberation Council of Intelligentsia গঠন করা।  দেশের যেসব বুদ্ধিজীবী,শিল্পী ও অন্যান্য সংস্কৃতিকর্মী ততদিনে কলকাতায় শরণার্থী  হয়েছেন,তাঁদের সংগঠিত করে মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে কাজ করা ছিল এর উদ্দেশ্য। আমি সভাপতি নির্বাচিত হই,জহির রায়হান নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদক।  সৈয়দ আলী আহসান, সারওয়ার মুর্শিদ,ব্রজেন দাশ ফয়েজ আহমদ,কামরুল হাসান প্রমুখ এই কমিটি তে ছিলেন। প্রথম দিকে এই কমিটির কর্মকর্তাদের কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় আমার প্রাক্তন ছাত্রী,সেসময়ে লরেটো কলেজের অধ্যাপিকা ডঃ পি সি ঘোষ এর বাসভবনে। তিনি এবং তাঁর স্বামী কমল ঘোষ ব্যক্তিগতভাবেই কমিটির কর্মকর্তাদের আপ্যায়ন এবং সভার অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচাদির ব্যয়ভার বহন করতেন। এই বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে* নেতাজী রিসার্চ ইন্সটিটিউটে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এখানে আমার দুই মেয়ে এমি ও রানা তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে কাজ করে।বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি,মুক্তিযুদ্ধের গতি,শরণার্থীদের অবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগৃহীত হয়। অরুপ চৌধুরীর অফিসও এই পরিষদের কাজে এবং পরবর্তীতে স্থাপিত শিক্ষক  সমিতির কাজে ব্যবহার করা হয়। পরে বাংলাদেশের শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে সঙ্গীতানুষ্ঠান ও প্রচারমূলক  বক্তৃতাদানের ব্যবস্থাও হয় পরিষদের উদ্যোগে*।এর কাজে কলকাতার মৈত্রেয়ী দেবী,গৌরী আইয়ূব,বিচারপতি মাসুদ এবং অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহেদ মাহমুদ খুব সাহায্য করেছিলেন।


ইতিমধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ সেনকে সভাপতি করে ও দিলীপ চক্রবর্তীকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি। এঁদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করা এবং বাংলাদেশের শরণার্থী শিক্ষকদের নানাভাবে সাহায্য করা। আমি কলকাতা এলে এঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়।  আলাপক্রমে স্থির হয় যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের একটা সংগঠন থাকলে উভয় পক্ষেই কাজের সুবিধা হবে।আমি তখন এই কাজের উদ্যোগ নেই নিই। আনিসুজ্জামানকে আগরতলা থেকে ডেকে পাঠাই এবং কয়েক দিনের প্রস্তুতির পর দ্বারভাঙ্গা  হলে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের এক সভা আহবান করি। কয়েক হাজার শিক্ষক এই এই সভায় যোগদান করেন। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে জনাব কামরুজ্জামানও বক্তৃতা দেন। সভার সভাপতিরুপে আমি যে ভাষণ দিয়েছিলাম তা পরে কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত হয়।  এই সভায় আমাকে সভাপতি ও আনিসুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গঠিত হয়। সহ-সভাপতিদের মধ্যে ছিলেন  সৈয়দ আলী আহসান, সারওয়ার মুর্শিদ ও জনাব কামরুজ্জামান (এমপি)।


'লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া'গঠন করা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। কেউ কেউ সরকারকে এমন ধারণা দিয়েছিলেন যে সরকারী যে উদ্যোগের বাইরে যেভাবে আমরা এই পরিষদ গঠন করেছি তাতে সরকারের সঙ্গে অসহযোগের সম্ভাবনাই বেশী থাকবে। আমাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ এমন ধারনা করেছিলেন যে সরকার এক ধরনের দলীয় নিয়ন্ত্রণ আমাদের ওপরে আরোপ করতে যাচ্ছেন। শিক্ষক  সমিতি গঠনের পূর্বমুহূর্তেও আবার এ ধরনের একটা ভাবের সৃষ্টি হয়। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এমপি ও জনাব কামরুজ্জামান এমপি'র মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এক সন্ধ্যায় আমাকে ও আনিসুজ্জামানকে  ডেকে পাঠান। তিনি বলেন যে,আনিসুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে যুক্ত থাকলে তাঁর কাজে সুবিধা হবে অতএব তাঁকে যেন শিক্ষক সমিতিতে বড় দায়িত্ব না দেয়া হয়। আমিরুল ইসলাম ও একই বক্তব্য সমর্থন করেন। কিন্তু আমরা আগে থেকে যেভাবে ভেবে এসেছিলাম তার ফলে এই প্রস্তাবে সম্মত হইনি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পনা সেল গঠন করলে ডঃ মুজাফফর আহমদ,ডঃ সারোয়ার মুর্শিদ,  ডঃ মোশাররফ হোসেন ও ডঃ স্বদেশ বসুর সঙ্গে ডঃ আনিসুজ্জামানকে তার সদস্য করা হয় তখন আনিসুজ্জামান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ত্যাগ করেন এবং সেই ভার অর্পিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ডঃ অজয় রায়ের ওপরে।


শিক্ষক সমিতির কাজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের শরণার্থী শিক্ষকদের সাহায্য করা,শরণার্থী শিবিরে প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয় চালানো,প্রচার পুস্তিকা প্রণয়ন করা,পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন চেয়ে পত্র লেখা ও পুস্তিকা প্রেরণ করা এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রচারাভিযান চালানো।  বহু শিক্ষককে আমরা সহায়ক সমিতির তহবিল থেকে সাহায্য করতে পেরেছিলাম, শরণার্থী শিবিরে কিছু কিছু বিদ্যালয় খুলে বালক-বালিকাদের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা রাখার ও শিক্ষকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল।কয়েকটি পুস্তিকা আমরা প্রকাশ করেছিলাম ইংরেজিতে তার মধ্যে  'পাকিস্তানবাদ ও বাংলাদেশ' সম্পর্কে ওসমান জামালের লেখা একটি পুস্তিকা এবং বাংলাদেশ গণহত্যা সম্পর্কে একটি সচিত্র পুস্তিকা উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমরা চিঠি  লিখি এবং আশাব্যঞ্জক ও সমর্থনসূচক উত্তর পাই। অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এলো বাসামকে লেখা আমার চিঠি,তিনি আমার অনুমতি নিয়ে সাইক্লোষ্টাইল করে সে দেশের প্রধান মন্ত্রী ম্যাকলম ফ্রেজারসহ অনেক নেতাকে পাঠান এবং আমাদের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ করেন। আমেরিকা ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পরিচিত অধ্যাপকের কাছে লিখা আমার চিঠি মোটামুটি একই ভাবে ব্যবহার করা হয়।


ভারতে আমরা যে প্রচারাভিযান চালাই, তার প্রথম পর্বেও সম্পূর্ণ উদ্যোগ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির। এই সমিতির দিলীপ চক্রবর্তী,সৌরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য,অনিল সরকার* ডঃ অনিরুদ্ধ রায় ও বিষ্ণুকান্ত* শাস্ত্রীকে নিয়ে আমি ও আনিসুজ্জামান এলাহাবাদ,আলীগড়,লক্ষনৌ,আগ্রা ও দিল্লী সফর করি। এসব শহরের বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন ছাড়াও আমরা বিভিন্ন জনসভায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ওপর বক্তৃতা দেই।আমাদের সংগে সুবেদ আলী  (এম,পি,এ) যোগ দেন। তিনি প্রয়োজনমত উর্দুতে আমার ইংরেজি বক্তৃতার অনুবাদ জনসমাবেশে পেশ করতেন। বিষ্ণুকান্ত * বলতেন হিন্দিতে। আনিসও  আমার মতো ইংরেজিতেই  বলতেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু আমাকে বক্তৃতা করতে দেয়া হয়। সেখানকার পরিবেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূল ছিল না। বক্তৃতা করতে ওঠার আগে সে সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম। আমার বক্তৃতার পরে শ্রোতাদের অনেকেই কেঁদে ফেলেছিলেন। বক্তৃতা নাকি মর্মস্পর্শী হয়েছিল,  একথা অনেকে বলেছেন।


দিল্লীতে সাহিত্য একাডেমীর প্রাঙ্গণে অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ভাষণ দিই এবং বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে আনিসুজ্জামান বক্তৃতা দেন।



বক্তৃতা দেওয়া ছাড়াও দিল্লীতে আমরা বেশ কয়েকটি ঘরোয়া আলোচনায় যোগ দেই। কলকাতায় আসার পরে ডক্টর বরুণ দের মাধ্যমে সিদ্ধার্থ রায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা হয়। আমার মনে হয়েছিল,তিনি তখনও আমাদের সংগ্রামের তীব্রতা অনুভব করতে পারেননি। দিল্লীতে আবার তাঁর সঙ্গে এবং শিক্ষামন্ত্রী ডঃ নূরুল হাসানের সঙ্গে শুধু আমার সাক্ষাৎ হয়। তাছাড়া আমরা অশোক মিত্র ( আই,সি,এস) ,ডঃ আশোক মিত্র  পি,এন,ধর ও পি,এন হাকসারের সঙ্গে আলাপ করি। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে একটি কমিটি গঠন করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের বিবেচনা করা উচিত,একথা হাকসার বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন।  তাঁর কথা পরে আমরা আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম।।


দিল্লীতে আমরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সংগে সাক্ষাৎ করি।  তিনি ধৈর্য সহকারে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার বক্তব্য শোনেন এবং ভারতীয় সরকার ও জনগণের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে আমরা মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পারি সে সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মত বিনিময় করেন। পরে মিসেস গান্ধী ও শিক্ষামন্ত্রী ডঃ নূরুল হাসানের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়। এরপরে প্রতিমন্ত্রী কে,আর গণেশ আমাদের এক নৈশভোজে আপ্যায়িত করেন। সেখানে ব্রক্ষানন্দ*রেড্ডী ও নন্দিনী শতপথীর মতো রাজনীতিবিদরা ছিলেন অনেক সাংবাদিকও ছিলেন। প্রধানত: সাংবাদিকরাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বহুবিধ প্রশ্ন করেন,রাজনীতিবিদেরাও কিছু কিছু প্রশ্ন করেছিলেন।আমার উত্তর দেয়া শেষ হলে আমি কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পাই।  আমার প্রশ্ন ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে,তবে আমি তা সাধারণভাবে উত্থাপন করেছিলাম। ঐ আলোচনা থেকে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে,মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ছাড়া শরণার্থী সমস্যার সমাধানের যে কোন সম্ভাবনা নেই একথা ভারতীয় নেতারা বোঝেন। তবে তাঁরা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাবছেন। চীন যে পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করবেনা,এ ধারণাও তাঁদের হয়েছে।  মনে হল তবুও তারা ঐ মুহূর্তে ঝুঁকি নিতে চান না এ বিষয়ে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে,এ সম্পর্কে তাঁরা খুবই সন্দিহান।  সুতরাং  ভালো করে আটঘাট না বেঁধে  তাঁরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কিংবা বাংলাদেশের পক্ষে বড় রকম সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চায় না।


সমস্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমার এবং আমাদের এসব সাক্ষাৎকারের ফলাফল  ও আমার নিজের ধারণা আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন কে কলকাতায় এসে জানাই। এরপর আমি পাটনা,বোম্বাই,নাসিক,পুনা,কেরালা,জয়পুর,আজমীর ও হায়দারাবাদে জনসভায় বক্তৃতা দিতে যাই। পাটনায় যে বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দিতে যাই সে সভায় সভাপতিত্ব করেন জয় প্রকাশ নারায়ণ,এবং অন্যান্যর মধ্যে বক্তৃতা দেন বিহার প্রদেশের গভর্নর ডঃ বড়ুয়া।


বোম্বের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও আমি ছাত্র শিক্ষকদের সমাবেশে বক্তৃতা দিই। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। এখানে বাংলাদেশের দুর্গত শরণার্থীদের সাহায্যে আনুমানিক ষাট/সত্তর হাজার টাকার চেক প্রদান করা হয়। এই সাহায্য এবং একইভাবে ভারতের বিভিন্ন জনসভায় সংগৃহীত অর্থ আমরা দাতাদের পক্ষ থেকে সরাসরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির তহবিলে জমা দেবার ব্যবস্থা করি। কোন অর্থ আমরা নিজ হাতে গ্রহণ করিনি। বিহারে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনসমর্থন যোগানোর ব্যাপারে তৎকালীন বিহার সরকারের বিরোধীদলের নেতা কর্পোরী ঠাকুর* আমাদের সংগে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের সকল রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের ব্যাপারে আমাদের  সঙ্গে ও তাদের সরকারের সংগে সহযোগিতা করেছে। প্রধানমন্ত্রী সবচে' কট্টর বিরোধী নেতা রাজ নারায়ণও আমাদের সমর্থনে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আমার এলাহাবাদ সফরকালে তিনি তার রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এক বিরাট জনসমাবেশের আয়োজন করেন এবং সমাবেশের তোরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিরাট এক প্রতিকৃতি স্থাপন করেন। দলের কর্মকর্তা আর কর্মীদের আগ্রহে আমি ঐ সমাবেশে তাদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেই। সে সময় ভারতে বাংলাদেশের সমর্থনে এমন একটি জোয়ার এসেছিল যাতে করে সব জায়গায়, এমনকি দুর্গাপূজা মণ্ডপের প্রবেশদ্বারেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো দেখেছি।


বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই)অবস্থান কালে মহারাষ্ট্রের গভর্নর নবাব ইয়ার আলী জংগ এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। বাংলাদেশের সমর্থনে আয়োজিত সমাবেশে তিনি উপস্থিত হন এবং আমার বক্তৃতা শোনেন। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রচুর অর্থ,গেরিলাদের জন্য পোশাক পরিচ্ছদ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর আমি যখন দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলাম তখন প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে একদিন হঠাৎ নবাব ইয়ার আলী জংগ আমার বাসায় এসে উপস্থিত হন এবং বলেন যে,“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যের জন্য আমি যে তহবিল খুলেছিলাম তাতে প্রচুর টাকা জমা হয়েছে। যেহেতু এই টাকা আমাদের জনসাধারণ কর্তৃত্ব বাংলাদেশকে দেয়া তাই এটি আপনাকে নিতে হবে”। মহারাষ্ট্রে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। সুতরাং এই বিষয়ে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলি। মহারাষ্ট্রের গভর্নর আমাকে তহবিলের যে চেক প্রদান করেন তা আমি বঙ্গবন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়ে সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতীকী সাহায্য হিসেবে মহারাষ্ট্রের জনগণকে দেবার জন্য পরামর্শ দেই। অতঃপর তাই করা হয়।


শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সৈয়দ আলী আহসান কে একবার বাঙ্গালোরে এবং মাজহারুল ইসলাম কে কেরালাতে বক্তৃতা দিতে পাঠানো হয়। সৈয়দ আলী আহসান,মাজহারুল ইসলাম,আনিসুজ্জামান মাঝে মাঝে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। আমিও দুবার অংশ নিয়েছিলাম।


সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে (১৮ থেকে ২০ তারিখ) দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। “World Meet On Bangladesh” নামে এটি পরিচিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জয়প্রকাশ নারয়ণ। সেখানে ২৪ টি দেশের ১৫০ জন প্রতিনিধি সমবেত হন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতারূপে আমি এই সম্মেলনে যোগ দেই। অন্যান্যদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান,মওদুদ আহমদ ও আজিজুর রহমান প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীও এই উপলক্ষে আয়োজিত হয়। আমি তা উদ্বোধন করি। এই সম্মেলন খুব সফল হয় এবং বিশ্ব জনমত গঠনে আনুকূল্যও সৃষ্টি হয়। এই সম্মেলনের সাফল্যের পিছনে গান্ধী ফাউন্ডেশনের বেশ অবদান আছে। এখানে অমরেশ সেন এর ভূমিকা ও তৎপরতা উল্লেখযোগ্য। এখানে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বি পি কৈরালা,অমরেশ সেন এর বাসায় গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করেন এবিওং আমাদের মুক্তি সংগ্রামে ও যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেন। সেসময় তিনি ভারতে আশ্রিত ছিলেন বলে তার এই প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়,একথা তাকে জানাই। তবে তার এই আগ্রহের কথা আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ কে জানানোর আশ্বাস দেই। পরবর্তীকালে এই কথা তাজউদ্দীন আহমেদকে জানালে তিনি এই ব্যাপারে আমার সঙ্গে ঐক্যমত প্রকাশ করেন যে, ভারতে আশ্রিত কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সহায়তা নেয়া আমাদের উচিত হবেনা।


দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষ করেই আমি নিউ ইয়র্ক  এর পথে রওনা হয়ে যাই। বাংলাদেশের জাতিসংঘ  সদর দপ্তরে প্রচারকার্য চালানো ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার তখন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। আমি এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। শিক্ষকদের মধ্যে রেহমান সোবহানও ছিলেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আবদুস সামাদ আজাদ,এ আর সিদ্দিকী,ফণি মজুমদার,সিরাজুল হক,আর ছিলেন সৈয়দ আবদুস সুলতান,ডাঃ আসহাবুল হক এবং ফকির সাহবুদ্দীনের মত সংসদ সদস্য। এস এ করিম,আব্দুল ফাত্তাহ ও এ এম এ মুহিতের মত বাংলাদেশের প্রতি অনুগত ঘোষণাকারী প্রাক্তন পাকিস্তানী কূটনীতিবিদ। আমাদের এই প্রচেষ্টার সাফল্য সম্পর্কে অনেকেই অবহিত আছেন।


জাতিসংঘের অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি পর্তুগালের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় ও  আমার কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।একদিন আমি জাতিসংঘ ভবনে পর্তুগীজ দূতের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাপ করছি, তাঁকে আমাদের সংগ্রামের পটভূমি বিশদভাবে বোজাচ্ছি ঠিক সে সময় আমাদের সামনে দিয়ে হলের ভিতরে যাচ্ছেন পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের সদস্য শাহ আজিজুর রহমান,মাহমুদ আলী,রাজিয়া ফয়েজ প্রমুখ। এঁরা যাবার সময় পর্তুগীজ দূত আমাকে আঙ্গুলের ইশারায় বললেন,ঐ দেখুন,আপনাদের প্রতিপক্ষরাও যাচ্ছেন। রাজিয়া ফয়েজ আমার পূর্বপরিচিতা ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে আমার কাছে এসে হোটেলে আমার ঠিকানা জানতে চাইলেন এবং রাত দশটার পর আমার সঙ্গে দেখা করবেন,বললেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আমাকে এই বলে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে,আপনার মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ যাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন তাঁদের নেতা হলেন তাজউদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তি। আমি বললাম তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। গণপ্রতিনিধিরা আমার চাইতে বেশী সম্মানের দাবিদার। সব দেশে তাঁরাই সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। আমার বেলায়ও তাই হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত আছি। কে বেশী সম্মানিত কে কম সম্মানিত এ প্রশ্ন এখানে ওঠে না। তাঁকে আমি বলি,আমার দৃঢ় বিশ্বাস,দেশ স্বাধীন হবে এবং তা আর বেশীদিন বাকী নেই। বাংলাদেশের গেরিলাদের হাতে প্রতিদিন যত পাক সৈন্য মারা যাচ্ছে তাদের সংখ্যা পাকিস্তান সরকার গোপন করতে চাইলেও বিদেশী সাংবাদিকরা তাদের হতাহতের যে সংবাদ দিচ্ছেন তাতে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। তখন তিনি ও অধিক হারে পাক সৈন্য ক্ষয়ের কথা স্বীকার করলেন। আমি তাঁকে আবার প্রশ্ন করি, আপনার এই শারীরিক অবস্থায় আপনি কিভাবে এসেছেন ? উল্লেখ্য যে তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তিনি জানান, ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের চাপে আমাকে অনিচ্ছা ও অসুবিধা সত্ত্বেও আসতে হয়েছে। সন্তান ধারণের ৭ মাস অতিবাহনের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট  প্রদান করা সত্ত্বেও আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর অন্যান্যদের সঙ্গে যখন তাঁকেও বাংলাদেশের বিরোধিতা করার কারণে জেলে পাঠানো হয়েছিল তখন তাঁর স্বামী ও তাঁর বোন আমার কাছে আসেন তাঁর মুক্তির ব্যাপারে বলার জন্য। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর সম্পর্কে একথার ওপর জোর দিয়ে বলি যে, তিনি ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন,অতঃপর অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও জেল থেকে মুক্তি পান।


 জাতিসংঘে দায়িত্বপালনের সঙ্গে সঙ্গে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সম্পর্কে শিক্ষক, ছাত্রদের সমাবেশ ও জনসভায় বক্তৃতা করি। প্রসংগতঃ উল্লেখ যে,এ সময়ের ১০ বৎসর পূর্বে আমেরিকার এক বিখ্যাত ও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলাম* এবং তার আগে ও পরে আমেরিকাতে বিভিন্ন সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। এর ফলে ঐ দেশের বহু শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ আমার পরিচিত ছিলেন। অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন উদ্যোগী হয়ে আমার জন্য এ রকম বিশেষ প্রোগ্রাম এর ব্যবস্থা করেন। এতে বাংলাদেশ সরকারের কোন অর্থ ব্যয় হয়নি।  তবে আই, আর, সি নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও এখানে কিছুটা সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিল।


যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত আমার প্রাক্তন ছাত্র জে,আর খান এ- সময়ে আমার সচিবের কাজ করেন। আমি বক্তৃতা দিই নিউইয়র্ক,কলাম্বিয়া,পেনসিলভানিয়া,স্ট্যানফোর্ড,বার্কলে লংবীচ,শিকাগো,বাফেলা,প্রিন্সটন,মিশিগান,নর্থ ক্যারোলাইন,হার্ভার্ড,বষ্টন,ইয়েল প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটিভাবে আমার কর্মসূচি হতো স্থানীয় রেডিও টিভি সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার প্রদান,মধ্যাহ্নের ফ্যাকাল্টি সদস্যদের সমাবেশে বক্তৃতা দেয়া এবং অপরাহ্ণে উন্মুক্ত স্থানে ছাত্র সমাবেশে  বাংলাদেশের ওপর বক্তৃতা দিয়ে সমর্থনের আহবান জানানো। উল্লেখ্য যে,এরূপ অনেক ক্ষেত্রে আমার বক্তৃতার পর শ্রোতারা মার্কিন সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতেন। সেটি আমাদের জন্য একটা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি বলে বিবেচিত হতো। আমার সঙ্গে প্রায়ই থাকতেন ডাঃ আসহাবুল হক। তাছাড়া আমার অনুরোধে ও প্রয়োজনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী,সৈয়দ আবদুস সুলতান,ডাঃ আসহাবুল হক,সিরাজুল হক প্রত্যেকে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। সংসদ সদস্য সিরাজুল হককে আমি পাঠিয়েছিলাম টেক্সাসে।তিনি বক্তৃতা দিয়ে আসার পরপরই সেখানে পাকিস্তানের পক্ষে বক্তৃতা দিতে যান ডক্টর ফাতেমা সাদেক।তারপর সেখানকার বাঙ্গালীরা আমাকে সত্বর টেক্সাসে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তৃতা করার জন্য তাগাদা দেন।আমি ছোট্ট একটি প্রাইভেট বিমানে টেক্সাসে যাই এবং এক ছাত্র শিক্ষক সমাবেশে বক্তৃতা দেই। এখানে অনেক পাকিস্তানী ছিলেন যাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দিতে হয়েছে। আমি যখন বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বর্বরতার নজীরগুলি একের পর এক উল্লেখ করতে থাকি তখনই প্রশ্ন করা বন্ধ হয়ে যায়। এই সভায় ২/৩  জন আমেরিকানও আমাদের সপক্ষে বক্তৃতা দিয়েছিলেন বলে আমার মনে পড়েছে।


ফিলাডেফিয়াতে গভীর ঔৎসুক্য ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে। তার প্রধান কারণ পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক থাকাকালীন আমার যারা ছাত্র বা গুণগ্রাহী ছিলেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় বা ঐ এলাকার বিভিন্ন কলেজ শিক্ষক ছিলেন। আমার সময়কার অনেক অধ্যাপক ও সেখানে তখন কর্মরত ছিলেন। এসব কারনে বাংলাদেশ লবি ওখানে খুবই শক্তিশালী ছিল।ফলে পাকিস্তানের জন্য মার্কিন সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ সেখানে প্রতিবাদকারীরা ঘেরাও করেছিলেন ছোট ছোট স্পীড বোট নিয়ে। এখানে আমার অনেক প্রাক্তন সহকর্মী অধ্যাপকদের সংগে দেখা হয় এবং যোগাযোগ স্থাপিত হয়। যেমন অধ্যাপক নর্মান ব্রাউন,  অধ্যাপক  হোলডেন ফারভার,রিচার্ড ল্যামবার্ট প্রমুখ। হার্ভার্ড ডক্টর কিসিঞ্জারের এক সহকারী আমার বক্তৃতার পর পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে খুব তর্ক করেছিলেন, কিন্তু শ্রোতাদের ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি।  মার্কিন জনমত তখন বাংলাদেশের অনুকূলেই ছিল, যদিও মার্কিন সরকারের মনোভাব ছিল এর উল্টো।বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বক্তৃতায় ছাত্র,শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের লোক উপস্থিত থাকতেন এবং বেতার-টেলিভিশনে তা প্রচারিত হত। তাছাড়া বিভিন্ন শহরে স্থানীয় রেডিও-টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের লোকজন আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কয়েকটি কলেজেও আমি বাংলাদেশ ওপর বক্তৃতা দেই।

সময়সংক্ষেপ করার জন্য আমার যাতায়াত ব্যবস্থা হয় প্রধানত: উড়োজাহাজ।  প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই আমি প্রথমে ফ্যাকাল্টি ক্লাব এবং পরে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশে ভাষণ দিই। উড়োজাহাজে ভ্রমণ সূচী এমনভাবে প্রণীত হয় যে,আমি প্রায় প্রত্যেক দিনই একটা না একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হাজির হতে পেরেছি। এ কর্মসূচী প্রণয়নে জে,আর,খান অত্যন্ত পারদর্শিতার প্রমাণ রেখেছেন।  এসব অনেক প্রোগ্রামে কুষ্টিয়া প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী ডা: আসহাবুল হক আমার সঙ্গে ছিলেন।



নিউইয়র্কে অবস্থানকালে কয়েকজন আইনজ্ঞ ও অস্ত্র ব্যবসায়ী গোপনে আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবিত অস্ত্রশস্ত্রের মূল্য পরে পরিশোধ করলেও চলবে বলে তাঁরা আমাকে জানান। তাঁরা আরো প্রস্তাব দেন যে,অনুমতি দেয়া হলে,তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী কারাগার হতে কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে মুক্ত করার চেষ্টা করবেন। আমার সংশয় ছিল এটি পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের কোন অংশ হতে পারে। যদি তারা তাদের কথায় খাঁটি হয় তাহলেও গোপনভাবে অস্ত্র সরবরাহের সময় অস্ত্র শত্রুর হাতে পড়তে পারে। আর কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে গেলে তাঁর জীবনের ওপরে ঝুঁকি আসার আশংকা অধিক।এসব ভেবে আমি তাদের জানালাম এটি আমার এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়। আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম দরকার হলে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার আপনাদের কাছ থেকে অস্ত্র নেবে।এরপর অল্পকালের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় এ ব্যাপারে আর অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হয়নি।


যেসব মার্কিন সিনেটর বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতেন,আমি তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি। সিনেটর কেনেডির সঙ্গে আমার কলকাতায় সাক্ষাৎ হয়েছিল,তবু আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানাই। সিনেটর স্যক্সবী ও সিনেটর চার্চের সঙ্গেও বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি। স্যাক্সবীর এক ছেলে (স্যাক্সবী জুনিয়র)  আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনের ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।


যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সফররত অবস্থায় আমার সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি ড:ফজলুর রহমান খানেরও শিকাগোতে সাক্ষাৎ হয়। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে সেখানে এক বলিষ্ঠ লবির সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের  পচার কার্যে তার আর্থিক অবদান ও ছিল বিরাট।  আমি এক রাতের জন্য তাঁর অতিথি ছিলাম। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক বন্ধু অধ্যাপক ডিমকও বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রচুর কাজ করেছিলেন।


লংবীচে আমার মনে পড়ে,একটি সমাবেশে ভাষণ দেবার পর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেতার বাদক রবি শঙ্কর-এর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান এবং যে যন্ত্র সংগীতের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলেন তার একটি রেকর্ড আমাকে উপহার দেন।


বস্টন ও হার্ভার্ডে বিমানবন্দরে আমাকে রিসীভ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন আমাদের কয়েকজন সিভিল সার্ভিসের সদস্য। তাঁরা আমার সঙ্গে বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে আমার ঘনিষ্ঠ  পরিচিত জনাব খুরশিদ আলম একটি সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। ডঃ মহিউদ্দীন আলমগীরও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে জনসমর্থনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানের একজন বিশেষ উদ্যোক্তা ছিলেন। আমার জন্য তার সযত্ন আতিথ্যের কথাও আমার মনে আছে।


নভেম্বরের শেষের দিকে নিউইয়র্ক থেকে কলকাতায় ফেরার পথে লন্ডনে বাংলাদেশীদের সমাবেশেও আমি বক্তৃতা দেই। সেখানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রবাসী বাঙ্গালীদের বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার  সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সেখানে বাঙ্গালীরা যথেষ্ট মনোবল নিয়ে কাজ করছিলেন। বস্তুত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র এবং লন্ডনে বাঙ্গালী সমাজের মধ্যে ঐক্যের যে বোধ,সংগ্রামের যে সংকল্প এবং ত্যাগ স্বীকারের যে মনোভাব আমি লক্ষ্য করি,তাতে মুক্তিযুদ্ধের পরিণাম ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলিষ্ঠ আশার সঞ্চার হয়। লন্ডন ছাড়া ব্রিটেনের লিভারপুল, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ ইত্যাদি স্থানে এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে গিয়ে আমার বক্তৃতা দেবার কথা ছিল।  কিন্তু এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, আমরা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি এবং বাংলাদেশ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে পাকিস্তান শীঘ্রই ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের পক্ষে এর একটি কৌশলগত ধারণা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিপন্ন করতে পারলে বাংলাদেশ প্রশ্ন চাপা পড়ে যাবে। পরবর্তীকালে নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টোর বক্তৃতা (হাজার বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের অঙ্গীকার) আমার এই ধারনা যে ঠিক ছিল তার প্রমাণ বহন করে। যাহোক,উপমহাদেশে সর্বাত্মক যুদ্ধ  শুরু হয়ে যাবার আসন্ন অবস্থার দরুন আমার উক্ত সফরসূচী বাতিল করে দিল্লী হয়ে আমি কলকাতা ফিরে আসি।


কলকাতায় ফেরার অল্পকাল  মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় শুরু হয়ে যায়। ঐ সংকট মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার জনসভায় যে বক্তৃতা করেন,তা আমি বেতারে শুনি ঘরে বসে। সত্যি বলতে কি,সে বক্তৃতা শুনে আমি আশাহত হয়েছিলাম। কেননা আমার আশা হয়েছিল যে,ঐ সময় হয়তো বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন। তারপর সেই রাতেই আকস্মিকভাবে  ভারতের ওপর পাকিস্তানী হামলার সংবাদ শোনা গেল। এর পরপরই ভারতীয় সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতি সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল আরো তাড়াতাড়ি এরা ঢাকায় এসে পৌঁছাতে পারছে না কেন। তারপর যেদিন পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের সংবাদ হলো সেদিন দেখলাম বড়দিনের আরো কিছু দেরী আছে। উল্লেখ্য,সিদ্ধার্থ সংকর রায়কে আমি খ্রীষ্টমাসে স্বাধীন বাংলাদেশে আসার অগ্রিম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম গত জুন মাসে।


মুক্তিলাভের এই আনন্দ দ্রুত ম্লান হয়ে গেল ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যার সংবাদে। আমার কত আপনজনই না দেশদ্রোহীদের ষড়যন্ত্রে অকালে শহীদ হয়েছেন।তবু বারবার নিজেকে বলেছি,এত শহীদ,এত আত্মত্যাগীর মর্যাদা যেন আমরা রক্ষা করতে শিখি স্বাধীন বাংলাদেশে।


দখলদার বাহিনীর আত্নসমর্পনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আমাকে বলেন যে,আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদ,  ছাত্র-যুবক,মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই আপনার প্রত্যক্ষ ছাত্র। তারা আপনার কথা শুনবে। বিজয়ের পর প্রত্যেকে যাতে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয় এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা না ঘটে সেজন্য স্বাধীন বাংলা বেতারে আপনি একটা বক্তৃতা দিন। দালাল,রাজাকার এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ যারা করেছে বাংলাদেশ সরকার তাদের শাস্তি প্রদান করবে বিশেষ আদালতে। তাজউদ্দিন সাহেবের এই পরামর্শে উপরোক্ত আহবান জানিয়ে আমি স্বাধীন বাংলা বেতারে বক্তৃতা দেই। এরপর আমি যশোরে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন ভূখণ্ড পরিদর্শন করি। অবশেষে '৭২- এর ৪ ঠা জানুয়ারি আমি সপরিবারে দেশে ফিরে আসি।

          (    শেষ কিস্তি)

ছাত্রলীগের ভাইদের সংগ্রহে রাখার জন্য ক্ষুদ্র প্রয়াস)

মুক্তিযুদ্ধ -ই-আর্কাইবসের সদস্য হন
মুক্তি যুদ্ধ সম্পর্কে জানুন

জয় বাংলা       জয় বংগবন্ধু
জয়তু দেশরত্ম শেখ হাসিনা


                         


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন