জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম রাতে কি ঘটেছিল বত্রিশ নম্বর বাড়
মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভ: মুক্তিযুদ্ধের বই, দলিল, ভিডিও, ডকুমেন্টারী, ফুটেজ, চলচ্চিত্র, অডিও ও ছবির ডিজিটাল লাইব্রেরী
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড: সেই রাতের ঘটনা---
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোররাত। ধানমণ্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে যান।
যে ঘরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তার বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন মো. সেলিম (আব্দুল) ও আব্দুর রহমান শেখ (রমা)।
ওপর থেকেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, “সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতিকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা।” পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মহিতুল গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে চেষ্টা করতে থাকেন।
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করা মাত্রই বাড়িটি লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়।
একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘুম থেকে ওঠে গৃহকর্মী আব্দুল আর রমা। বেগম মুজিবের কথায় রমা নিচে নেমে প্রধান ফটকের বাইরে এসে দেখেন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগুচ্ছে।
রমা বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন।
দোতলায় গিয়ে দেখেন, বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। রমা আর দোতলায় দাঁড়িয়ে না থেকে তিন তলায় চলে যান এবং বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে তোলেন। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পড়ে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল আসেন দোতলায়।
রমা দোতালায় শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে তোলেন। জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান।
ওদিকে গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি ...”। বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি।
একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। কাচের এক টুকরায় মহিতুলের ডান হাতের কনুই জখম হয়। ওই জানালা দিয়ে গুলি আসতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং মহিতুলের হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন।
এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, “এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছো ?” এ কথা বলেই বঙ্গবন্ধু ওপরে চলে যান।
বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, “আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।” এ সময় শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল ইসলাম খান।
ঠিক তখনই মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে। গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডস্ আপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম খান।
কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, “আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি ওদেরকে বলেন।” মহিতুল ঘাতকদের বলেন, “উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।”
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ করে বজলুল হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল। এর মধ্যে একটা গুলি মহিতুলের হাঁটুতে আরেকটা নুরুল ইসলামের পায়ে লাগে।
এ অবস্থাতেই মহিতুলকে টেনে নুরুল ইসলাম তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তারা দেখেন, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। অস্ত্রটা তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে ওই ঘরে ঢুকে বজলুল হুদা সবাইকে বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোর আদেশ দেয়।
নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি দোতলায় তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, “জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।”
তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, “সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।"
জবাবে সফিউল্লাহ বলেন, “আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অফ দ্য হাউজ?”
এদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল জামিল তার ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশে রওনা হন। সঙ্গে ছিলেন নিজের গাড়িচালক আয়েনউদ্দিন মোল্লা। কিন্তু, পথেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। পালিয়ে বেঁচে যান আয়েনউদ্দিন।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে মহিতুল, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন, পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ অন্য সদস্যদের সারি করে দাঁড় করানো হয়। এর মধ্যে ঘাতকদের একজন পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যকে গুলি করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পড়ে যান।
এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে চলে যায়। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?”
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে মহিউদ্দিন ঘাবড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি- বেয়াদবি করছিস কেন?” এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে।
বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। নিথর দেহটা সিঁড়ির মধ্যে পড়ে থাকে। সারা সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে।
বঙ্গবন্ধুর পেছন পেছন রমাও যাচ্ছিলো। কিন্তু, ঘাতকরা তাকে ঘরের মধ্যে চলে যেতে বলে। এর মধ্যে দোতলায় শেখ রেহানার ঘরে থাকা তার চাচা শেখ নাসের ওই কক্ষে যায়। তার হাতে গুলি লাগার ক্ষত ছিলো। রমাই প্রথম বেগম মুজিবকে জানায়, বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা হয়েছে।
এ সময় ওই ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, শেখ নাসের ও রমা। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিচে নেমে এসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
এরপর পরই মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন তাদের সৈন্যসহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসে। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের নিয়ে দোতলায় চলে যায়। তারা বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা দরজায় গুলি করে। তখন বেগম মুজিব দরজা খুলে দেয় এবং ঘরের মধ্যে যারা আছে তাদের না মারার জন্য অনুরোধ করেন।
ঘাতকরা বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসতে থাকে।
সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই বেগম মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং চিৎকার দিয়ে বলেন, “আমি যাবো না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।”
বেগম মুজিব নিচে নামতে অস্বীকৃতি জানান। ঘাতকরা শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যায়। আর, বেগম মুজিবকে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বেগম মুজিবসহ বঙ্গবন্ধুর ঘরে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন।
বেগম মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁ’দিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। আর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে যায় সুলতানা কামালের মুখ।
শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদেরকে সবাইকে সঙ্গে লাইনে দাঁড় করানো হয়। এ সময় শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি তো রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।” ঘাতকরা একে অপরকে বলে, “শেখ মুজিব বেটার দ্যান শেখ নাসের।”
এরপর তারা শেখ নাসেরকে বলে, “ঠিক আছে। আপনাকে কিছু বলবো না। আপনি ওই ঘরে গিয়ে বসেন।” এই বলে তাকে অফিসের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে গুলি করে। এরপর শেখ নাসের ‘পানি পানি’ বলে গোঙাতে থাকেন। তখন শেখ নাসেরের ওপর আরেকবার গুলিবর্ষণ করা হয়।
লাইনে দাঁড়িয়ে শেখ রাসেল প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?”
মহিতুল জবাব দেয়, “না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।” এ সময় শেখ রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা মহিতুলের কাছ থেকে জোর করে তাকে দোতলায় নিয়ে যেতে বলে।
আজিজ পাশার কথা মতো এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রাসেলের চোখ বের হয়ে যায়। আর মাথার পেছনের অংশ থেতলে যায়। রাসেলের দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে।
পুরো ঘরের মেঝেতে মোটা রক্তের আস্তর পড়ে গিয়েছিলো। এর মাঝেই ঘাতকের দল লুটপাট চালায়।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দু'মেয়ে ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ও ছোট মেয়ে শেখ রেহানা সেদিন ছিলেন বেলজিয়ামে। শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন জার্মানি ছিলেন, সেখানেই বোনের কাছে গিয়েছিলেন রেহানা
(মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইবস থেকে সংগৃহিত
মুক্তি যুদ্ধ আর্কাইবসের সদস্য হউন
মুক্তিযুদ্ধকে জানুন,অন্যকেও জানান)
" জয়বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু
জয়তু দেশরত্ম শেখ হাসিনা"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন