মুক্তি যুদ্ধের প্রারম্ভে চট্রগ্রামের যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং স্বাধীনতার ঘোষনা সম্প্রচার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র থেকে বলছি (১৫তম খণ্ড) : অধ্যাপক আজিজুর রহমান।
কম্পাইল করেছেন – এইচএম ইব্রাহিম রাজু
গতকালের পর
(দ্বিতীয় কিস্তি)
২৬ শে মার্চ সকালে এ খবর আসার পর আওয়ামী লীগের জনাব এম,আর,সিদ্দিকী ও জনাব এম,এ,হান্নানের সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এর পরিস্থিতি সম্বন্ধে আরও খবর জানতে পারি। কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন রফিক সি,আর,বির টিলায় অবস্থান নিয়েছিলেন। আনিসুজ্জামান এর সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কথা হয় এবং পারস্পরিক এলাকার সংবাদ বিনিময় হয়। চট্টগ্রাম ডাকবাংলোতে অথবা রেলওয়ে রেস্ট হাউসে সংগ্রাম পরিষদের একটি অফিস কাজ করছিল। সেখান থেকে একজন টেলিফোন করে আনিসুজ্জামানকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে শোনান এবং তা লিখে নিয়ে সবাইকে জানাতে বলেন। এরপর চট্টগ্রামের বেতার তরঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শুনতে পাই। জনাব এম,এ,হান্নান বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করেন এবং পরে সকলকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লালদীঘি ময়দানে জমায়েত হতে নির্দেশ দেন। আমি টেলিফোন করে কালুরঘাটে এবং ডাকবাংলোতে বলি যে,এই ঘোষণা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা দরকার,কেননা,ওরকম জমায়েতের ওপর বিমান থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা আছে। পরে তাঁরা এই সমাবেশ বাতিল করার ঘোষণা দেন। এ ব্যাপারে আমার যে আশঙ্কা ছিল পরবর্তী সময়ে তা সত্যে পরিণত হয়। পাকিস্তানের কয়েকটি জঙ্গি বিমান চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করার পর কালুরঘাটে বোমা বর্ষণ করে।
২৬ শে মার্চ সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটি থেকে জিলা প্রশাসক জনাব হাসান তৌফিক ইমাম টেলিফোনে আমাকে জানান যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তর চট্টগ্রাম থেকে ইপিআর -এর জওয়ানদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমি যেন তাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি। রাতে প্রায় আড়াইশ জওয়ান ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছান। আমরা তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আলাওল হল ও এ,এফ,রহমান হলে থাকবার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তখন থেকে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব আমরা শিক্ষক ও অফিসারদের মধ্যে ভাগ করে দেই।যেমন কেউ খাবারের তত্ত্বাবধান করেন,যানবাহনের দায়িত্ব নেন কেউ,পেট্রোলের জন্য পাম্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্লিপ দেবার দায়িত্ব দেয়া হয় কাউকে,ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবার নেতৃত্ব নেন কেউ। আমি অফিসে থাকি এবং আমাকে সর্বক্ষণ সহায়তার ভার দেয়া হয় আনিসুজ্জামানকে।
ই, পি, আর- এর জওয়ানদের প্রতিরোধ কার্যক্রমে তাৎক্ষনিকভাবে নেতৃত্ব দেবার জন্য পেয়েছিলাম সুবেদার আব্দুল গণিকে। সেই রাতেই আমার অফিস থেকে সি,এস,আই,আর-এ ড: হাইকে ফোন করে ক্যান্টনমেন্টের যতটুকু খবর আঁচ করা সম্ভব,তা জেনে নিই এবং ই,পি,আর -এর জওয়ানদের দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর দিক (হাটহাজারী রাস্তার পূর্বদিকের এলাকা) ঘিরে রাখার কৌশল স্থির করা হয়। ক্যান্টনমেন্টের উত্তরাঞ্চলে ছিল পাহাড় ও জংগল এবং সামান্য জনগোষ্ঠীর বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাপগ্রাফিক ম্যাপ ছিল। আমার অফিসে বসে ম্যাপ দেখে ট্রেঞ্চ কাটার জায়গা নির্দিষ্ট হয় এবং ক্যাম্পাসে কনট্রাকটরদের শ্রমিক দিয়ে রাত্রেই পরিখা খনন করা হয়। পরদিন জওয়ানদের নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং তাদের প্রত্যেককে প্যাকেট লাঞ্চ দেয়া হয়। এ ব্যাপারে গ্রাম্য জনসাধারণ আমাদের আবেদনে সাড়া দেন এবং যথেষ্ট সাহায্য করেন। তাঁরা সাধ্যমত চাল-ডাল-তরকারী,আটা,ময়দা,গরু,ছাগল,মুরগী আমাদের কাছে পৌঁছে দেন দান হিসেবে। তবে তাঁদের কাছ থেকে কোন অর্থ আমরা গ্রহণ করিনি। সৈন্যদের পথ দেখানোর কাজেও তাঁরা যথেষ্ট সাহায্য করেন। উল্লেখ্য যে, ই,পি,আর-দের সাহায্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এক মাইল দূরে রেল লাইনের পূর্ব দিকে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের জন্য ওয়ারলেস সেট স্থাপন করা হয়েছিল।
২৭ শে মার্চ বেতারে মেজর জিয়ার প্রথম ঘোষণা প্রচারিত হয়। তা শুনেই আমি হান্নান সাহেবকে টেলিফোনে বলি যে, ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর নাম যোগ করা আবশ্যক। নইলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয় বিবেচিত হবে না। মেজর জিয়া পরবর্তী ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধুর নাম করে,তাঁর পক্ষ থেকে।
২৭শে ও ২৮শে মার্চ ই,পি,আর-এর আরও কিছু জওয়ান এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আত্মরক্ষা করে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত এদের সংখ্যা দাঁড়ায় চারশো’র বেশী। কিন্তু ই,পি,আর ও ই,বি,আর-এর জওয়ানদের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়। এস,পি,শামসুল হক, মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার সঙ্গে আমার টেলিফোনে যোগাযোগ ছিলো। পরস্পরের কাছে পরিচিত হবার জন্য আমরা ভিন্ন কিন্তু নির্দিষ্ট নাম ব্যবহার করতাম। আমাকে দেয়া নাম ছিল ‘ডানিয়েল’। যোগাযোগ করা ক্রমশ: কঠিন হয়ে উঠছিলো, কেননা ক্রমেই তাঁদের অবস্থান এমন জায়গায় হচ্ছিল যেখানে টেলিফোনে কথা বলা যাচ্ছিল না। যাহোক,বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থানরত জওয়ানদের যুদ্ধ ব্যাপারে নেতৃত্ব দেবার জন্য আমি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ক্যাপ্টেন রফিক-এর মারফত চেয়ে পাঠাই। তাঁরা পাঠান একজনকে। (পরে দেখি তিনি আমার পূর্ব পরিচিত ও আমার বড় ছেলের বন্ধু)। তাকে নিয়ে একটা ভুল বুঝা-বুঝি হয়। তিনি সরাসরি আমার অফিসে এসে জওয়ানদের দায়িত্ব গ্রহণ না করে,ক্যাম্পাসে আমার সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র দেখে আরও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য বর্ডারে যাবার কথা বলেন এবং এ ব্যাপারে কর্তব্যরত অধ্যাপকের কাছে একটি গাড়ী চান। অধ্যাপক একথা আমাকে ফোনে জানান। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া কিংবা মেজর জিয়া যে তাকে পাঠিয়েছেন তা তিনি জানালেও আমরা সরাসরি কোন খবর কালুরঘাট থেকে পাইনি বলে উক্ত অফিসার সম্বন্ধে আমাদের সন্দেহের উদ্রেক হয়। তখন তাকে আমি আমার অফিসে ডেকে পাঠাই এবং জিজ্ঞাসাবাদ করি। তাতেও সন্দেহ নিরসন না হওয়াতে ই,পি,আর-এর এক নায়েক এবং দুই সিপাহীর সাহায্যে তাকে এবং তার দু’জন সহচর ছাত্রকে নিরস্ত্র করি এবং ভাইস চ্যান্সেলরের ভিজিটরস রুমে পাহারাধীন রাখি। তাঁদের উদ্দেশ্যে আমি বলি যে দেশ এক সংকটময় পরিস্থিতিতে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত। এ অবস্থায় কারও চালচলনে সন্দেহের উদ্রেক হলে তাকে নজরবন্দী রাখতে হয়। মেজর জিয়ার ক্যাম্প থেকে তাঁদের সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেব। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে ফোনে যোগাযোগ করি। তিনি বলেন যে, উক্ত অফিসারকে দু’জন ছাত্রসহ পাঠিয়েছি। আমার বক্তব্য,তাই যদি হয়,তবে আমার সঙ্গে দেখা না করে এখানকার দায়িত্ব না নিয়ে চলে যাচ্ছিল কেন। যাহোক,তখন ওই অফিসারকে মুক্ত করে আমি জিয়ার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিই এবং অন্য কোন সিনিয়র অফিসার পাঠাতে অনুরোধ করি। সঙ্গের দুজন ছাত্রকেও তার সঙ্গে পাঠাই কারণ এটা প্রমাণিত হয় যে,তাঁরা প্রতিরোধ সংগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে মেজর জিয়ার ক্যাম্পে গিয়েছিলো। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার নির্দেশে অফিসারকে নিয়ে আমাদের এখানে আসে। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত নয়। ছাত্রদের পরিচিতি সম্বন্ধে স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে খবর নিয়ে জানতে পারি যে,তাঁদের বক্তব্য সত্য। তখন ওই দুটি ছাত্রকে দিয়ে উক্ত অফিসারকে কালুরঘাট পাঠানো হয় ক্যাপ্টেন রফিকের নিকট। ছাত্র দুটি যখন ফিরে আসছিলো তখন তাঁরা পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ক্যাম্পাস থেকে সংগ্রাম পরিচালনার সময় আমাদের ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দুইজন সদস্য আব্দুর রব (তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক) এবং ফরহাদ কাপ্তাই রোডের ওপর এক গেরিলা অপারেশনে মৃত্যুবরণ করে।
২৯শে মার্চ সেনাবাহিনী ও পুলিশের অফিসারদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। মনে হয় তাঁরা অবস্থান পাল্টেছেন,কিন্তু আমাদের খবর দেবার সময় পাননি।
পক্ষান্তরে আমরা চট্টগ্রাম শহরের পতনের সংবাদ পাই। ইতিমধ্যে শত্রুর গুলিতে পরিখায় অবস্থানরত আমাদের কয়েকজন জওয়ান আহত হয়। এমতাবস্থায় প্রতিরোধ এখান থেকে জোরদার করা সম্ভব নয় বলে জওয়ানদের পক্ষ থেকে আরও উত্তরে চলে যাবার প্রস্তাব আসে। আমরা একমত হই। তাঁরা নাজিরহাটে যাবে সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের সঙ্গে অবস্থানকারী জওয়ানরা গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে ডাক্তার আবুল বশর ও ডাক্তার আখতারুজ্জামানের চিকিৎসাধীন কয়েকজন আহত যোদ্ধা ছাড়া তখন আর প্রায় কোন যোদ্ধাই আমাদের হাতে রইলো না। এরপরে শহর থেকে গ্রাম্য পথ ঘুরে যোদ্ধৃবেশে কিছু আওয়ামী লীগ ও নেতা এবং ইউ,ও,টি,সির কিছু প্রশিক্ষণরত ছাত্র ও অফিসার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছান,কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করে রাখা অসম্ভব দেখে তারাও অন্যত্র চলে যান। এদিকে ক্যাম্পাস থেকে উত্তর চট্টগ্রাম বা রাঙ্গামাটির রাস্তায়ও স্থানীয় জনসাধারণ ব্যারিকেড স্থাপন করতে শুরু করে। এই অবস্থায় আমরা স্থির করি যে ৩০ শে মার্চ ক্যাম্পাস থেকে সকল শিশু,বৃদ্ধ ও নারীকে স্থানান্তরিত করা হবে। কয়েকটি বাসে করে কিছু পরিবার নাজিরহাটে পাঠিয়ে দেয়া হয়, অন্যেরা গিয়ে আশ্রয় নেন কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের হস্টেলে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের বেতন বন্ধ ছিল কারণ হাতে টাকা ছিল না এবং ব্যাংক বন্ধ ছিল।কিছু কর্মচারী ব্যাংকের দরজা ভেঙ্গে টাকা নেয়ার প্রস্তাব করে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিই এবং ব্যাংক লুট করা চলবে না বলে দিই। আমার বাসায় যে ব্যক্তিগত টাকা ছিল সেখান থেকে চার হাজার টাকা নিয়ে এবং অধ্যাপক আর,আই,চৌধুরীর কাছে যে ২/৩ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসের টাকা ছিল তা নিয়ে নিচু * শ্রেণীর কর্মচারীদের বাড়ী যাবার ভাড়া তাৎক্ষণিকভাবে দিয়ে দিই এবং তাদের যার যার বাড়ীতে চলে যেতে বলে তাদের কাছ থেকে আমি বিদায় নিই। ৩১ শে মার্চ রাতে ক্যাম্পাস প্রায় খালি হয়ে যায়। ডাক্তার দু'জনের হাতে চিকিৎসাধীন চার পাঁচজন যোদ্ধাকে রেখে ১লা এপ্রিল সন্ধ্যায় আমার পরিবার,রেজিস্টারের পরিবার এবং আনিসুজ্জামানকে নিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলাম। আমি সপরিবারে রাউজানে আশ্রয় নিলাম। ক্যাম্পাসে ভি,সির বাসগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় আমার সেক্রেটারি ইনস্যুরেন্স পলিসি,শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদির কিছু কাগজপত্রের ব্যক্তিগত ফাইল আমার পাসপোর্টসহ আমার সামনে এনে হাজির করে সঙ্গে নেবার জন্য। আমি ওই পাসপোর্ট সবার সামনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম কারণ,তখন আমি আর পাকিস্তানী নই,তাই পাকিস্তানী পরিচয়ে কোন পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে চাইনি। অন্যান্য কাগজপত্রের ফাইলটিও ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল,যতক্ষণ না দেশ স্বাধীন হচ্ছে ততক্ষণ কোন বীমা, কোন শেয়ার সার্টিফিকেটের দরকার নেই। পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হবার পর আমার সেক্রেটারি ঐ ছুড়ে ফেলে দেয়া ফাইলটি আমার ড্রাইভারকে দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
রাউজানে আমি সপ্তাহখানেক ছিলাম। ইতিমধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের প্রতিকূলে চলে যায়।সকলেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে থাকে। কুণ্ডেশ্বরীতে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন,তারা ছড়িয়ে- ছিটিয়ে পড়েন। সেখানে আশ্রয় দাতা নূতনচন্দ্র সিংহের পরিবার ও স্থান ত্যাগ করেন।নূতন বাবু শূন্য গৃহে রয়ে যাবার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরে ১৩ ই এপ্রিল হানাদার বাহিনী তাকে হত্যা করে।
সম্ভবত: ৮ই এপ্রিল আমি রাউজান থেকে নাজিরহাটে চলে যাই। ওখানে তখন আমাদের সহযোগী জওয়ানরা ছিলেন। সেখানে এক রাত তাদের সঙ্গে থেকে রামগড়ের পথে রওয়ানা হই। সপরিবারে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক রশিদুল হক ও ড: মাহমুদ শাহ কোরেশী আমার সঙ্গে আসেন। উল্লেখ্য নাজিরহাট থেকে আমার সঙ্গে যায় মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজন,তাদের সঙ্গে কালুরঘাট থেকে সরিয়ে আনা ট্রান্সমিটার সেট ছিল। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধাও ছিল।
১০ ই এপ্রিলে হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে। ১১ই থেকে ১৪ ই এপ্রিলের মধ্যে রামগড়ে সপরিবারে এসে পৌঁছান অধ্যাপক শামসুল হক,ডঃ আনিসুজ্জামান,ওসমান জামাল;অন্য শিক্ষকদের মধ্যে ষরিৎকুমার সাহা, নূরুল ইসলাম খোন্দকার প্রভৃতি এবং বেশ কিছু ছাত্র। ছাত্রেরা অনেকেই সাবরুম হয়ে ভারতে প্রবেশ করে এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ দু'চার দিনের সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসে শত্রুর মোকাবিলা করে। আমাদের ছাত্র শহীদ ইফতিখার ছিল তেমন একজন।
রামগড়ে এসে মেজর জিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হয়। সেখান থেকেই তিনি তখন যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেজর শামসুদ্দীন ( ই পি আর),ক্যাপ্টেন রফিক,ক্যাপ্টেন আফতাব (গোলন্দাজ বাহিনী),ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া প্রমুখ। রাঙ্গামাটি থেকে হাসান তৌফিক ইমাম ও এস,পি বজলুর রহমান আমাদের আগেই এখানে এসে যোগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতৃস্থানীয় কর্মী তাদের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা থেকে সাদেক খানও সেখানে এসে পৌঁছান। রামগড়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজে এবং আমাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সর্বাত্মক সাহায্য করেন সেখানকার চা বাগানের ম্যানেজার জনাব আব্দুল আউয়াল। রামগড় অবস্থানের শেষ দিন ভোরে ক্যাপ্টেন কাদের আমার সঙ্গে দেখা করে তাঁর উপর জিয়া কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে যান পার্বত্য চট্টগ্রামে। তিনি এই অপারেশন নিহত হন।
==========================
(দ্বিতীয় কিস্তি:--ছাত্র লীগ ভাইদের সংগ্রহে রাখার জন্য আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস)
"
"জয়বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু
জয়তু দেশরত্ম শেখ হাসিনা"
আগামী কাল শেষ কিস্তি।
((প্রথম কিস্তি যারা পাননি ৩/৯ এর পোষ্ট দেখুন))
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন