বীরঙ্গনাদের মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অমুল্য বহি:প্রকাশ। ≠========================== ধন্যবাদ মাননীয় প্রধান মন্ত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনা। দীর্ঘ বছর পর হলেও আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধে নারী জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হারিয়ে যাঁরা আজকের বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের নিকট উপহাসের পাত্রী হয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বিকৃতি দিলেন।যদিও প্রাথমিক অবস্থায় তাঁর সংখ্যা সাগরের এক বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা সমতুল্য। মুক্তিযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক নারী মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের পথে লাঞ্ছিত; নিপীড়িত,নির্যাতীত হয়েছেন। আমরা বক্তৃতা,বিবৃতিতে বলি প্রায় দুই লক্ষ মা,বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।কিন্তু এদেশ তাঁদেরকে এত বছর শুধু অবহেলাই নয়,মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করে রেখেছিল।ছিল না কোন রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা,সামাজিক সম্মান।আমরা ভুলতে বসেছিলাম এদেশীয় দোষরেরা তাঁদের জোর পুর্বক পাঞ্জাবি খাঁন সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিল।তৎকালিন জামায়াতের আমীর গোলাম আযম সহ রাজাকারের বংশদবদেরা ফতোয়া দিয়ে গর্বের কন্ঠে বলেছিল গানিমতের মাল,ইসলামে নাকি জায়েজ আছে,বাঙালী মা বোনদের দর্শন করা।আজকে তাঁদেরও বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে।নারী জীবনের সবচেয়ে গ্লানিময় অধ্যায় হলো নারীর সম্ভ্রমহানি। যুদ্ধের সময় সম্ভ্রম হারানো নির্যাতিত নারীদের অনেকে মারা গেছেন, বেশীর ভাগ সমাজের গ্লানী সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবন এখনও দুঃসহ ও অবমাননাকর। নারীর এই আত্মত্যাগ, সম্ভ্রমহানি খুবই বেদনাবহ। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হানাদারবাহিনীর হাতে নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে তাদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ ওপরে। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে, যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে।’ সে সময় উন্নত সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার এই সম্মাননা দেন এবং সংবর্ধনার মাধ্যমে বিশেষ সম্মানে তাদের ভূষিত করেন। জাতীর জনক যদি বেঁচে থাকতেন,আজকের বীরঙ্গনারাই হতেন বাংলাদেশের সম্মানীয়,রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পাওয়া সোনালী পরিবার।প্রাথমিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণমূলক সংস্থা গঠন করে অনেক বিরঙ্গনাকে সেখানে স্থানান্তর করে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করেন।উৎপাদনমুখী বিভিন্ন প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে দেন।সেখান থেকে অনেকেই আজকে প্রতিষ্ঠিত শিল্প উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকান্ডের পর বীরাঙ্গনারা স্বাধীন দেশে নানাভাবে অবহেলিত এবং মানবেতর জীবনযাপন করা শুরু করে ।জাতির জনকের প্রস্থানের সাথে তাঁদের ভাগ্যের বিড়ম্বনাও আগমন ঘটা শুরু করে। তবে আশার কথা দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে বীরাঙ্গনারা যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন জাতির জনকের কন্যা দেশরত্ম শেখ হাসিনার সরকার। অবশেষে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছেন। চলতি বছরের জুলাই থেকে মুক্তিযোদ্ধার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন তাঁরা। একটি রিট আবেদনের জবাবে বীরাঙ্গনাদের সমন্বিত তালিকা প্রস্তুত করে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্মান ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করে গত বছরের জানুয়ারি মাসে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ১৩ অক্টোবর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ২৫তম সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন সংজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন সংজ্ঞায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নৃশংস নির্যাতনের শিকার নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবার ৪১ জনের নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। গেজেটে বলা হয়েছে, মৃত বীরাঙ্গনার পরিবারও গেজেটে তাঁর নাম প্রকাশের জন্য আবেদনের সুযোগ পাবেন। আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে বীরাঙ্গনা নিজে বা তার দাবিদাররা মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করতে পারবেন। আমরা আশা করবো অন্যসব সরকারী সেবার মত বিরঙ্গনাদের তালিকা প্রনয়ন,অন্তভুক্তি,ভাতা তালিকায় প্রবেশ,প্রাপ্তি পয্যন্ত যেন কোন বিড়ম্বনার শিকার না হয় তার প্রতি কোঠোর দৃষ্টি রাখা হবে।প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় থেকে নজরদারীর জন্য বিশেষ টিম গঠন করে দেয়া যেতে পারে কিনা, ভেবে দেখা ঊচিৎ।বিড়ম্বনার শিকারে পরিনত হলে অনেকে যারা এখন ও জীবিত আছেন, তাঁরা তালিকায় নাম দেয়ার জন্য উৎসাহিত হবে না।এক্ষেত্রে বীরঙ্গনা নারীদের বংশ পরস্পরায় রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি পাওয়ার বিষয়গুলি ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে আত্মসম্মান বাঁচাতে লুকিয়ে থাকা বীরঙ্গনাদের মনে সাহস যোগাতে পারে,সামাজিক বাঁধা পেরিয়ে তালিকায় নাম নিবন্ধন করতে। একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের তালিকা কোথাও সংরক্ষিত নেই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই সংখ্যা আড়াই থেকে সাড়ে চার লাখ। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সামাজিক সম্মান না থাকায় অনেকে নির্যাতিত হওয়ার কথা প্রকাশ করেন না। নির্যাতিতদের খুঁজে বের করে তালিকাভুক্ত করে গেজেট করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। বাংলাদেশের মত সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্পর্শকাতর একটি বিষয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক উঠেছে, নির্যাতিত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না আশা করা যায়।এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যারা গেজেট ভুক্ত হয়েছেন তারা যেন তাদের প্রাপ্য সম্মান, প্রথম ধাপে মাত্র ৪১ জনের নাম গেজেটভুক্ত হয়েছে, পর্যায়ক্রমে বাকিদের নাম গেজেটভুক্ত করতে যেন কালবিলম্ব না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরী। যতকাল স্বাধীনতা বিরুদীদের অস্থিত্ব থাকবে,ততকাল সম্মানের অধিকারী মা,বোনেরা অসম্মান নিয়ে সমাজে টিকে থাকতে হবে।রাজাকারের পরিবারের সরকারী সকল সুযোগ নিষিদ্ধ না করে,বীরঙ্গনাদের সম্মান দিলে, সেই সম্মান বহন করা কতটুকু সম্ভব হবে বলা যায় না।রাজাকারের তালিকা প্রনয়ন করা সহজ সাধ্য হওয়া সত্বেও, কেন তালিকা প্রনয়ন করা হচ্ছে না, বোধগম্য নয়।প্রাথমিক ভাবে রাজাকার পরিবারের সকলের ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। যারা সরকারি চাকুরীতে এখন ও বহাল আছেন,সত্বর তাঁদের চাকুরীচ্যুত করে,নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহষ যোগানো যেতে পারে।তখনি কেবল মনে হতে পারে, আমাদের জন্য, আমাদের ভবিষ্যত প্রজর্ম্মের জন্যই আজকের এই সামাজিক,রাষ্ট্রীয় সম্মান সরকার উপহার দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে,সুতারাং সাড়া দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
বীরঙ্গনা মা, বোনেরা দীর্ঘ ৪৪বছর পর মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন।এই সম্মান অমানীষার ঘোর অন্ধকার বেদ করে এক চিলতে চাঁদের আলোর সন্ধান পেলেন,বাংলা দেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নারীকূল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন