বীরঙ্গনাদের মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অমুল্য বহি:প্রকাশ। ≠========================== ধন্যবাদ মাননীয় প্রধান মন্ত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনা। দীর্ঘ বছর পর হলেও আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধে নারী জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হারিয়ে যাঁরা আজকের বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের নিকট উপহাসের পাত্রী হয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বিকৃতি দিলেন।যদিও প্রাথমিক অবস্থায় তাঁর সংখ্যা সাগরের এক বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা সমতুল্য। মুক্তিযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক নারী মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের পথে লাঞ্ছিত; নিপীড়িত,নির্যাতীত হয়েছেন। আমরা বক্তৃতা,বিবৃতিতে বলি প্রায় দুই লক্ষ মা,বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।কিন্তু এদেশ তাঁদেরকে এত বছর শুধু অবহেলাই নয়,মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করে রেখেছিল।ছিল না কোন রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা,সামাজিক সম্মান।আমরা ভুলতে বসেছিলাম এদেশীয় দোষরেরা তাঁদের জোর পুর্বক পাঞ্জাবি খাঁন সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিল।তৎকালিন জামায়াতের আমীর গোলাম আযম সহ রাজাকারের বংশদবদেরা ফতোয়া দিয়ে গর্বের কন্ঠে বলেছিল গানিমতের মাল,ইসলামে নাকি জায়েজ আছে,বাঙালী মা বোনদের দর্শন করা।আজকে তাঁদেরও বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে।নারী জীবনের সবচেয়ে গ্লানিময় অধ্যায় হলো নারীর সম্ভ্রমহানি। যুদ্ধের সময় সম্ভ্রম হারানো নির্যাতিত নারীদের অনেকে মারা গেছেন, বেশীর ভাগ সমাজের গ্লানী সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবন এখনও দুঃসহ ও অবমাননাকর। নারীর এই আত্মত্যাগ, সম্ভ্রমহানি খুবই বেদনাবহ। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হানাদারবাহিনীর হাতে নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে তাদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ ওপরে। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে, যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে।’ সে সময় উন্নত সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার এই সম্মাননা দেন এবং সংবর্ধনার মাধ্যমে বিশেষ সম্মানে তাদের ভূষিত করেন। জাতীর জনক যদি বেঁচে থাকতেন,আজকের বীরঙ্গনারাই হতেন বাংলাদেশের সম্মানীয়,রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পাওয়া সোনালী পরিবার।প্রাথমিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণমূলক সংস্থা গঠন করে অনেক বিরঙ্গনাকে সেখানে স্থানান্তর করে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করেন।উৎপাদনমুখী বিভিন্ন প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে দেন।সেখান থেকে অনেকেই আজকে প্রতিষ্ঠিত শিল্প উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকান্ডের পর বীরাঙ্গনারা স্বাধীন দেশে নানাভাবে অবহেলিত এবং মানবেতর জীবনযাপন করা শুরু করে ।জাতির জনকের প্রস্থানের সাথে তাঁদের ভাগ্যের বিড়ম্বনাও আগমন ঘটা শুরু করে। তবে আশার কথা দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে বীরাঙ্গনারা যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন জাতির জনকের কন্যা দেশরত্ম শেখ হাসিনার সরকার। অবশেষে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছেন। চলতি বছরের জুলাই থেকে মুক্তিযোদ্ধার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন তাঁরা। একটি রিট আবেদনের জবাবে বীরাঙ্গনাদের সমন্বিত তালিকা প্রস্তুত করে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্মান ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করে গত বছরের জানুয়ারি মাসে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ১৩ অক্টোবর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ২৫তম সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন সংজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন সংজ্ঞায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নৃশংস নির্যাতনের শিকার নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবার ৪১ জনের নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। গেজেটে বলা হয়েছে, মৃত বীরাঙ্গনার পরিবারও গেজেটে তাঁর নাম প্রকাশের জন্য আবেদনের সুযোগ পাবেন। আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে বীরাঙ্গনা নিজে বা তার দাবিদাররা মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করতে পারবেন। আমরা আশা করবো অন্যসব সরকারী সেবার মত বিরঙ্গনাদের তালিকা প্রনয়ন,অন্তভুক্তি,ভাতা তালিকায় প্রবেশ,প্রাপ্তি পয্যন্ত যেন কোন বিড়ম্বনার শিকার না হয় তার প্রতি কোঠোর দৃষ্টি রাখা হবে।প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় থেকে নজরদারীর জন্য বিশেষ টিম গঠন করে দেয়া যেতে পারে কিনা, ভেবে দেখা ঊচিৎ।বিড়ম্বনার শিকারে পরিনত হলে অনেকে যারা এখন ও জীবিত আছেন, তাঁরা তালিকায় নাম দেয়ার জন্য উৎসাহিত হবে না।এক্ষেত্রে বীরঙ্গনা নারীদের বংশ পরস্পরায় রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি পাওয়ার বিষয়গুলি ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে আত্মসম্মান বাঁচাতে লুকিয়ে থাকা বীরঙ্গনাদের মনে সাহস যোগাতে পারে,সামাজিক বাঁধা পেরিয়ে তালিকায় নাম নিবন্ধন করতে। একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের তালিকা কোথাও সংরক্ষিত নেই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই সংখ্যা আড়াই থেকে সাড়ে চার লাখ। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সামাজিক সম্মান না থাকায় অনেকে নির্যাতিত হওয়ার কথা প্রকাশ করেন না। নির্যাতিতদের খুঁজে বের করে তালিকাভুক্ত করে গেজেট করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। বাংলাদেশের মত সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্পর্শকাতর একটি বিষয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক উঠেছে, নির্যাতিত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না আশা করা যায়।এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যারা গেজেট ভুক্ত হয়েছেন তারা যেন তাদের প্রাপ্য সম্মান, প্রথম ধাপে মাত্র ৪১ জনের নাম গেজেটভুক্ত হয়েছে, পর্যায়ক্রমে বাকিদের নাম গেজেটভুক্ত করতে যেন কালবিলম্ব না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরী। যতকাল স্বাধীনতা বিরুদীদের অস্থিত্ব থাকবে,ততকাল সম্মানের অধিকারী মা,বোনেরা অসম্মান নিয়ে সমাজে টিকে থাকতে হবে।রাজাকারের পরিবারের সরকারী সকল সুযোগ নিষিদ্ধ না করে,বীরঙ্গনাদের সম্মান দিলে, সেই সম্মান বহন করা কতটুকু সম্ভব হবে বলা যায় না।রাজাকারের তালিকা প্রনয়ন করা সহজ সাধ্য হওয়া সত্বেও, কেন তালিকা প্রনয়ন করা হচ্ছে না, বোধগম্য নয়।প্রাথমিক ভাবে রাজাকার পরিবারের সকলের ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। যারা সরকারি চাকুরীতে এখন ও বহাল আছেন,সত্বর তাঁদের চাকুরীচ্যুত করে,নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহষ যোগানো যেতে পারে।তখনি কেবল মনে হতে পারে, আমাদের জন্য, আমাদের ভবিষ্যত প্রজর্ম্মের জন্যই আজকের এই সামাজিক,রাষ্ট্রীয় সম্মান সরকার উপহার দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে,সুতারাং সাড়া দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

বীরঙ্গনা মা, বোনেরা দীর্ঘ ৪৪বছর পর মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন।এই সম্মান অমানীষার ঘোর অন্ধকার বেদ করে এক চিলতে চাঁদের আলোর সন্ধান পেলেন,বাংলা দেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নারীকূল।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন