বর্তমান যুগে একমাত্র নিয়ন্তর গনতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে "বিশ্বমানবতার মুক্তির ধর্ম ইসলাম" প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
(রুহুল আমিন মজুমদার)
গনতন্ত্র আসলে কি? বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক থেকে দার্শনিক, মনীষিরা গনতন্ত্রের সংজ্ঞা যেভাবে দিয়েছেন ঐ সংজ্ঞাও যদি বিশ্লেষন করি তাহলেও গনতন্ত্রের আগে পরে কোন বিশেষনের প্রয়োজন হয়না।জনকল্যান মূখি রাষ্ট্রব্যাবস্থা গঠনকল্পে গনতন্ত্রে নেই এমন কোন নীতি অবশিষ্ট নেই।যতসব ভাল,উন্নত, সমৃদ্ধ গুনাবলি সব ভাল গুনাবলি গনতন্ত্রে উপস্থিত।শুধুমাত্র একটা দিক খারাপ বলা যেতে পারে, গনতন্ত্রের অন্যতম একটি বাহন জনগনের সরাসরি মতামতে বা ভোটে নেতা নির্বাচনে অনেক সময় খারাপ লোকও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারে।
জনগনের সরাসরি ভোটে বলতে কি উপস্থিত সকলের? না, সকলের নয়- ম্যাজরিটির বা বেশীর ভাগ উপস্থিতির। ম্যাজরিটির মতামতকে মাইনোরিটি মেনে নিতে হয়। বৃহদাংশের মত ক্ষুদ্র অংশের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলা হলেও গনতন্ত্র অর্থহীন।সকলের মত কোন অবস্থায় এক হয়না,একক যেহেতু হয়না গ্রহন করার প্রশ্নই উঠেনা। সকলের ভিন্ন ভিন্ন অভিমত গ্রহন করতে গেলে শৃংখলাই থাকেনা।বৃহদাংশের মতামতকে মেনে নিতে শৃংখলিত করার রীতিকেই বলে 'গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা'।'গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা' সফল করার নিমিত্তে প্রথমেই প্রয়োজন সহনশীলতা। সহনশীলতা সাধারনত: ব্যাক্তির চরিত্রে একদিনে বা একাধিক বছরেও অর্জিত হয়না, ব্যাক্তির চরিত্রে ধারন করার জন্যেও প্রয়োজন হয় নিবিড় চর্চার।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ বিশ্বব্যাপি তরুন সমাজকে নাড়া দিতে পেরেছিল। বিশ শতকের মধ্যভাগে ‘সমাজতন্ত্রের’ জনপ্রিয়তা আকাশচুম্ভি আকার ধারন করেছিল।এমনও ভাবা হ'ত প্রকৃত সমাজতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের উচ্চতর রূপ। কোন কোন দেশে অতি গনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক বুঝানোর অর্থে গনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের আগে পরে যুৎসই অন্য একটা শব্দ যোগ করে দিতেন।পরবর্তীতে দেখা গেছে গনতন্ত্রের উচ্চরুপ সমাজতন্ত্রতো নহেই গনতন্ত্রের ধারে কাছেও নেই।উক্ত বিশেষন সম্পুর্ণ ফ্যাসিষ্ট শাষনকেও হার মানায়। উদাহরণ হিসেবে উত্তর কোরিয়ার কথা বলা যায়। দেশটির মুলত: নাম "ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া।" উত্তর কোরিয়ায় কেমন ডেমোক্রেসি আছে বা কয় জন পিপল রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে অংশ নিতে পারে, কমবেশি আমরা সবাই জানি। গালভরা বুলি কপচে যতই তন্ত্রমন্ত্রের গুণগান করা হোক না কেন, তা যে আসলেই কত ঠুনকো, অন্তঃসারশূন্য, তা এ ধরনের দেশের হালচাল দেখলেই বোঝা যায়।
আমাদের অত্যান্ত নিকটের দেশ শ্রীলঙ্কা।সাংবিধানিক নাম "ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব শ্রীলঙ্কা।" বাইরে থেকে আমরা অনেকেই ওই দেশের ভেতরের খবর জানি না বা রাখি না। ওই দেশের অনেক নাগরিক মনে করেন ওখানে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সমাজতন্ত্র তো নির্বাসনে গেছে অনেক আগেই। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মানবাধিকারের রেকর্ড তলানিতে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কাই সবার আগে বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল। শাষনব্যবস্থার ভুলের কারনে বিদেশী ঋণের ভারে দেশটির অর্থনীতি অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
একসময় বিশ্বের দেশে দেশে রাজা-রানিদের শাসন ছিল। এখন অবশ্য বিশ্বব্যাপি না থাকলেও অঞ্চলভেদে দেখা যায়। আরব দেশগুলোতে এখনো রাজা-বাদশাহরা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, কিন্তু ইউরোপের দেশগুলোতে রাজা-রানিরা সংবিধানের আলোকে অলংকারমাত্র, কিন্তু প্রজা সাধারন যথেষ্ট সম্মান ভক্তি বজায় রেখেছে। প্রজাতন্ত্র হলেই যে প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রজাতন্ত্রের নামের আড়ালেও স্বৈরশাসন থাকতে পারে, বাংলাদেশ তাঁর যুৎসই উদাহরন হতে পারে।বিগত চল্লিশ বছরে দুই সরকারের দাপুটে মন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদূদ নীজেই স্বিকার করে বলেছেন --বাংলাদেশে গত চল্লিশবছর গনতন্ত্র এবং সুশাষন ছিলনা।উল্লেখ্য কথিত চল্লিশ বছরের মধ্যে তাঁর শাষিত দল বিএনপি, জাতিয় পার্টির শাষনই ছিল ত্রিশ বছরের অধিক।
আমরা আলংকারিক শব্দ বা বিশেষন যুক্ত শব্দসমষ্টি ভালবাসি। সংবিধানে কোন শব্দটি আছে বা নেই, কোনটা ঢুকল বা বাদ পড়ল, তা নিয়ে আমরা তুলকালাম করি। ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'পরম' 'পবিত্র' খাঁটি মসুলমানি শব্দরাজির ব্যবহার ছিল। ‘রাষ্ট্রীয় মূলনীতি’ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদ ছিল। এখনও আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ এই শব্দগুলোর অর্থ বোঝেন কি না বা ব্যাখ্যা জানেন কি না, তা নিয়ে আমার মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে। তারপরও আমরা এই শব্দগুলো নিয়ে কতই-না হইচই করি, হাঙ্গামা বাধাই।
গনতন্ত্র একটি সম্পুর্ণ শাষন ব্যবস্থা আগেই বলেছি। পরবর্তিতে সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতার কি প্রয়োজন ছিল? গনতন্ত্রের উচ্ছতর রুপ সমাজতন্ত্র মেনে নিলে সমাজতন্ত্রের কোন প্রয়োজনীয়তা থাকেনা।তেমনি ধর্ম, বর্ণ, গোষ্টি, লিঙ্গ, জাতিভেদ যেহেতু গনতন্ত্রে কোন স্থান নেই ধর্মনিরপেক্ষতার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? জাতীয়তার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র জাতি সত্বার উম্মেষ এবং কখনই এই জাতির শাষন ক্ষমতা, স্বাধীনসত্বা ছিলনা বুঝাতে প্রয়োজন ছিল কিন্তু সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন ছিলনা--'তথাপি সংযোজিত হয়েছিল'।
বর্তমানে একদল মানুষ গনতন্ত্র পুর্ণোদ্ধারের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন।তাঁরা সকলেই '৭২এর পবিত্র সংবিধানে 'রাষ্ট্রধর্ম এবং বিসমিল্লাহ সংযোজনকারি।' রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল রাখার জন্যে শহিদ হতেও প্রস্তুত কিন্তু গনতন্ত্র পুণো:দ্ধারের সংগ্রামও চালিয়ে যাচ্ছেন। গনতন্ত্রের সংজ্ঞায় বা গনতন্ত্রে ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ভেদাবেদ সমর্থন করে? নিজেদেরকে বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবক্তা কেন বলেন? গনতন্ত্র কি একদলীয়?
একদল মৌলভি নতুন করে বের হয়েছেন--তাঁদের জম্ম ১৯৭১ ইং সালে।- বাঙ্গালী জাতি যখন তাঁদের স্বাধীকারের লড়াইয়ে, মুক্তির লড়াইয়ে পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাষক শোষকের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইরত: ছিল; তখন চুপিসারে চট্রগ্রামের পটিয়ায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। উক্ত মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও নানাহ কাহিনী উক্ত জনপদে প্রচলিত আছে। আমি সেদিকে যেতে চাইনা---"তাঁরাও গনতন্ত্র চান, আবার ভাস্কায্য সরানোর আন্দোলনও করেন"।
গনতন্ত্রের শিক্ষাই হচ্ছে সৃজনশীল কাজের উৎসাহ প্রদান, শিল্প, সংস্কৃতির লালন।গনতন্ত্র চাইলে ভাস্কায্য কেন সরাতে হবে? গনতন্ত্রই যদি চান নারী কেন হিজাব পড়বে, ভাইয়ের সমান সম্পত্তি বোন পাবে না কেন বা নারী তাঁর অর্জিত সম্পদের মালিক হতে পারবে না কেন? এককথায় ইসলাম সমর্থন করেনা--এই তো?
সমর্থন করেনা বলেই তো ইসলাম গনতন্ত্র চর্চা করাকেও হারাম বলে। আপনি কেন গনতন্ত্র মেনে আন্দোলন সংগ্রাম, বক্তৃতা, বিবৃতি দেন? আপনি কি ইসলাম ধর্মের মধ্যে আছেন?বলতে পারেন গনতন্ত্র মানিনা--"গনতন্ত্র যদি নাইবা মানেন বিবৃতি প্রকাশ করেন কোন শাষনাধীনে, কিভাবে? কোন শাষনাধীনে, কিভাবে গনতন্ত্রকে অনুসরন করে মিছিল মিটিং, সভা, সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট করেন? আপনারাই-তো বলেন--"ইসলাম ধর্মে গনতন্ত্র অনুসরন, অনুকরন, বিশ্বাস, লালন সম্পূর্ণ হারাম"। তাহলে আমরা বলতে পারি--"আপনারা নিশ্চয়ই ইসলাম ধর্মভিত্তিক কোরানের আলোকে, নবী প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষে পবিত্র ধর্ম ইসলামকে পরিচালিত করছেন না।"
সৌদি আরব ইসলাম ধর্মের তীর্থভূমি।সৌদি বাদশাহ'র এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ভাস্কায্য উম্মোচিত হতে পারলে বাংলাদেশে কেন সরাতে হবে? বাংলাদেশে কি কোরানের শাষন কায়েম করা হয়েছে? সরকার বলে গনতান্ত্রিক শাষন কায়েম করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি- আপনারা চাইতেছেন গনতন্ত্র পুর্ণোদ্ধার, মৌলবি সাহেবেরা গনতা। সকল পক্ষ যেহেতু গনতন্ত্রের পূজারি--সেহেতু ভাস্কায্য পেতে পারে সকল পক্ষের সম্মান, আন্দোলন হতে পারে তাঁর ভাবগাম্ভিয্য রক্ষার--তাই নয় কি?
গ্রেট বৃটেনকে গনতন্ত্রের রাজা-রাণীর দেশ বলা হয়,শতববছর গনতন্ত্র চর্চা অব্যাহত রেখেছে বৃটেন।সেখানে গনতন্ত্রের বিধিবিধান অনুসরনের জন্যে লিখিত সংবিধানের প্রয়োজন হয়নি তাঁদের। দীর্ঘ দিনের প্রচলিত রীতিনীতিই তাঁদের জনগনের মনে স্থায়ি প্রভাব সৃষ্টি করে--অলঙ্ঘনীয় সংবিধানে পরিণত করেছে। কোনপক্ষ কতৃক প্রচলিত প্রথা বা রীতিনীতি ভঙ্গ করার উদাহরনও দেখা যায়না। সেখানে তাঁদের বিশ্ব শাষন করার ঐতিহ্য রাজপরিবারকে যথাযথ মায্যদায় লালন করে, রাজপরিবারের শাষনতান্ত্রিক ক্ষমতা উহ্য।গনতন্ত্র চর্চায় রাজ পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
"গনতন্ত্র" মানব সৃষ্ট এমন একটি শাষন ব্যবস্থা-"যে শাষন ব্যবস্থা মানব কল্যানে তাঁর অন্তনিহিত সকল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কল্যান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিয়ন্তর চেষ্টা অব্যাহত রাখে। গনতন্ত্র ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধনি, গরিব, কাল, সাদা ইত্যাদি সকল বিষয়ে অন্ধ।কোন একটি বিষয় তাঁর উপর প্রভাব বিস্তারের অধিকার রাখেনা। গনতন্ত্রের কোন বিশেষন নেই, কোন অলংকার নেই, রঙ, রুপ, গন্ধ কিছুই নেই। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, হিন্দুকে হিন্দু, মুসলিমকে মুসলিম মেনে নিয়ে সকলের জন্যে সমমায্যদা রক্ষা করে নিজের ধর্ম সৃষ্টি করেছে "মানবধর্ম।" সুয্য যেমন তাঁর আলোতে পৃথিবীর সব কিছুতে সমভাবে আলো বিকিরণ করে; গনতন্ত্র তাঁর নিজের আলো "বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে মানবসেবার" উজ্বল আলোকরস্মির দ্বারা সবাইকে সমভাবে আলোকিত করে।
সুতারাং মহান সৃষ্টিকর্তা ঘোষিত যুগের সাথে তালমিলিয়ে সকল জটিলতার মিমাংসা পূর্বক ইসলামকে আধুনিকায়ন ও যুগ উপযোগী করার লক্ষে কোরান ও হাদিসের আলোকে এগিয়ে নেয়াই হবে ধর্মীয় ব্যাক্তিত্বদের সময়ের দাবী পূরনের অন্যতম দুরদর্শিতার পরিচায়ক।
ruhulaminmujumder@gmail.com
(রুহুল আমিন মজুমদার)
গনতন্ত্র আসলে কি? বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক থেকে দার্শনিক, মনীষিরা গনতন্ত্রের সংজ্ঞা যেভাবে দিয়েছেন ঐ সংজ্ঞাও যদি বিশ্লেষন করি তাহলেও গনতন্ত্রের আগে পরে কোন বিশেষনের প্রয়োজন হয়না।জনকল্যান মূখি রাষ্ট্রব্যাবস্থা গঠনকল্পে গনতন্ত্রে নেই এমন কোন নীতি অবশিষ্ট নেই।যতসব ভাল,উন্নত, সমৃদ্ধ গুনাবলি সব ভাল গুনাবলি গনতন্ত্রে উপস্থিত।শুধুমাত্র একটা দিক খারাপ বলা যেতে পারে, গনতন্ত্রের অন্যতম একটি বাহন জনগনের সরাসরি মতামতে বা ভোটে নেতা নির্বাচনে অনেক সময় খারাপ লোকও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারে।
জনগনের সরাসরি ভোটে বলতে কি উপস্থিত সকলের? না, সকলের নয়- ম্যাজরিটির বা বেশীর ভাগ উপস্থিতির। ম্যাজরিটির মতামতকে মাইনোরিটি মেনে নিতে হয়। বৃহদাংশের মত ক্ষুদ্র অংশের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলা হলেও গনতন্ত্র অর্থহীন।সকলের মত কোন অবস্থায় এক হয়না,একক যেহেতু হয়না গ্রহন করার প্রশ্নই উঠেনা। সকলের ভিন্ন ভিন্ন অভিমত গ্রহন করতে গেলে শৃংখলাই থাকেনা।বৃহদাংশের মতামতকে মেনে নিতে শৃংখলিত করার রীতিকেই বলে 'গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা'।'গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা' সফল করার নিমিত্তে প্রথমেই প্রয়োজন সহনশীলতা। সহনশীলতা সাধারনত: ব্যাক্তির চরিত্রে একদিনে বা একাধিক বছরেও অর্জিত হয়না, ব্যাক্তির চরিত্রে ধারন করার জন্যেও প্রয়োজন হয় নিবিড় চর্চার।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ বিশ্বব্যাপি তরুন সমাজকে নাড়া দিতে পেরেছিল। বিশ শতকের মধ্যভাগে ‘সমাজতন্ত্রের’ জনপ্রিয়তা আকাশচুম্ভি আকার ধারন করেছিল।এমনও ভাবা হ'ত প্রকৃত সমাজতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্রের উচ্চতর রূপ। কোন কোন দেশে অতি গনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক বুঝানোর অর্থে গনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের আগে পরে যুৎসই অন্য একটা শব্দ যোগ করে দিতেন।পরবর্তীতে দেখা গেছে গনতন্ত্রের উচ্চরুপ সমাজতন্ত্রতো নহেই গনতন্ত্রের ধারে কাছেও নেই।উক্ত বিশেষন সম্পুর্ণ ফ্যাসিষ্ট শাষনকেও হার মানায়। উদাহরণ হিসেবে উত্তর কোরিয়ার কথা বলা যায়। দেশটির মুলত: নাম "ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া।" উত্তর কোরিয়ায় কেমন ডেমোক্রেসি আছে বা কয় জন পিপল রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে অংশ নিতে পারে, কমবেশি আমরা সবাই জানি। গালভরা বুলি কপচে যতই তন্ত্রমন্ত্রের গুণগান করা হোক না কেন, তা যে আসলেই কত ঠুনকো, অন্তঃসারশূন্য, তা এ ধরনের দেশের হালচাল দেখলেই বোঝা যায়।
আমাদের অত্যান্ত নিকটের দেশ শ্রীলঙ্কা।সাংবিধানিক নাম "ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব শ্রীলঙ্কা।" বাইরে থেকে আমরা অনেকেই ওই দেশের ভেতরের খবর জানি না বা রাখি না। ওই দেশের অনেক নাগরিক মনে করেন ওখানে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সমাজতন্ত্র তো নির্বাসনে গেছে অনেক আগেই। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মানবাধিকারের রেকর্ড তলানিতে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কাই সবার আগে বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল। শাষনব্যবস্থার ভুলের কারনে বিদেশী ঋণের ভারে দেশটির অর্থনীতি অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
একসময় বিশ্বের দেশে দেশে রাজা-রানিদের শাসন ছিল। এখন অবশ্য বিশ্বব্যাপি না থাকলেও অঞ্চলভেদে দেখা যায়। আরব দেশগুলোতে এখনো রাজা-বাদশাহরা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, কিন্তু ইউরোপের দেশগুলোতে রাজা-রানিরা সংবিধানের আলোকে অলংকারমাত্র, কিন্তু প্রজা সাধারন যথেষ্ট সম্মান ভক্তি বজায় রেখেছে। প্রজাতন্ত্র হলেই যে প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রজাতন্ত্রের নামের আড়ালেও স্বৈরশাসন থাকতে পারে, বাংলাদেশ তাঁর যুৎসই উদাহরন হতে পারে।বিগত চল্লিশ বছরে দুই সরকারের দাপুটে মন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদূদ নীজেই স্বিকার করে বলেছেন --বাংলাদেশে গত চল্লিশবছর গনতন্ত্র এবং সুশাষন ছিলনা।উল্লেখ্য কথিত চল্লিশ বছরের মধ্যে তাঁর শাষিত দল বিএনপি, জাতিয় পার্টির শাষনই ছিল ত্রিশ বছরের অধিক।
আমরা আলংকারিক শব্দ বা বিশেষন যুক্ত শব্দসমষ্টি ভালবাসি। সংবিধানে কোন শব্দটি আছে বা নেই, কোনটা ঢুকল বা বাদ পড়ল, তা নিয়ে আমরা তুলকালাম করি। ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'পরম' 'পবিত্র' খাঁটি মসুলমানি শব্দরাজির ব্যবহার ছিল। ‘রাষ্ট্রীয় মূলনীতি’ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদ ছিল। এখনও আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ এই শব্দগুলোর অর্থ বোঝেন কি না বা ব্যাখ্যা জানেন কি না, তা নিয়ে আমার মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে। তারপরও আমরা এই শব্দগুলো নিয়ে কতই-না হইচই করি, হাঙ্গামা বাধাই।
গনতন্ত্র একটি সম্পুর্ণ শাষন ব্যবস্থা আগেই বলেছি। পরবর্তিতে সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতার কি প্রয়োজন ছিল? গনতন্ত্রের উচ্ছতর রুপ সমাজতন্ত্র মেনে নিলে সমাজতন্ত্রের কোন প্রয়োজনীয়তা থাকেনা।তেমনি ধর্ম, বর্ণ, গোষ্টি, লিঙ্গ, জাতিভেদ যেহেতু গনতন্ত্রে কোন স্থান নেই ধর্মনিরপেক্ষতার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? জাতীয়তার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র জাতি সত্বার উম্মেষ এবং কখনই এই জাতির শাষন ক্ষমতা, স্বাধীনসত্বা ছিলনা বুঝাতে প্রয়োজন ছিল কিন্তু সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন ছিলনা--'তথাপি সংযোজিত হয়েছিল'।
বর্তমানে একদল মানুষ গনতন্ত্র পুর্ণোদ্ধারের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন।তাঁরা সকলেই '৭২এর পবিত্র সংবিধানে 'রাষ্ট্রধর্ম এবং বিসমিল্লাহ সংযোজনকারি।' রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল রাখার জন্যে শহিদ হতেও প্রস্তুত কিন্তু গনতন্ত্র পুণো:দ্ধারের সংগ্রামও চালিয়ে যাচ্ছেন। গনতন্ত্রের সংজ্ঞায় বা গনতন্ত্রে ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ভেদাবেদ সমর্থন করে? নিজেদেরকে বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবক্তা কেন বলেন? গনতন্ত্র কি একদলীয়?
একদল মৌলভি নতুন করে বের হয়েছেন--তাঁদের জম্ম ১৯৭১ ইং সালে।- বাঙ্গালী জাতি যখন তাঁদের স্বাধীকারের লড়াইয়ে, মুক্তির লড়াইয়ে পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাষক শোষকের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইরত: ছিল; তখন চুপিসারে চট্রগ্রামের পটিয়ায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। উক্ত মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও নানাহ কাহিনী উক্ত জনপদে প্রচলিত আছে। আমি সেদিকে যেতে চাইনা---"তাঁরাও গনতন্ত্র চান, আবার ভাস্কায্য সরানোর আন্দোলনও করেন"।
গনতন্ত্রের শিক্ষাই হচ্ছে সৃজনশীল কাজের উৎসাহ প্রদান, শিল্প, সংস্কৃতির লালন।গনতন্ত্র চাইলে ভাস্কায্য কেন সরাতে হবে? গনতন্ত্রই যদি চান নারী কেন হিজাব পড়বে, ভাইয়ের সমান সম্পত্তি বোন পাবে না কেন বা নারী তাঁর অর্জিত সম্পদের মালিক হতে পারবে না কেন? এককথায় ইসলাম সমর্থন করেনা--এই তো?
সমর্থন করেনা বলেই তো ইসলাম গনতন্ত্র চর্চা করাকেও হারাম বলে। আপনি কেন গনতন্ত্র মেনে আন্দোলন সংগ্রাম, বক্তৃতা, বিবৃতি দেন? আপনি কি ইসলাম ধর্মের মধ্যে আছেন?বলতে পারেন গনতন্ত্র মানিনা--"গনতন্ত্র যদি নাইবা মানেন বিবৃতি প্রকাশ করেন কোন শাষনাধীনে, কিভাবে? কোন শাষনাধীনে, কিভাবে গনতন্ত্রকে অনুসরন করে মিছিল মিটিং, সভা, সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট করেন? আপনারাই-তো বলেন--"ইসলাম ধর্মে গনতন্ত্র অনুসরন, অনুকরন, বিশ্বাস, লালন সম্পূর্ণ হারাম"। তাহলে আমরা বলতে পারি--"আপনারা নিশ্চয়ই ইসলাম ধর্মভিত্তিক কোরানের আলোকে, নবী প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষে পবিত্র ধর্ম ইসলামকে পরিচালিত করছেন না।"
সৌদি আরব ইসলাম ধর্মের তীর্থভূমি।সৌদি বাদশাহ'র এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ভাস্কায্য উম্মোচিত হতে পারলে বাংলাদেশে কেন সরাতে হবে? বাংলাদেশে কি কোরানের শাষন কায়েম করা হয়েছে? সরকার বলে গনতান্ত্রিক শাষন কায়েম করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি- আপনারা চাইতেছেন গনতন্ত্র পুর্ণোদ্ধার, মৌলবি সাহেবেরা গনতা। সকল পক্ষ যেহেতু গনতন্ত্রের পূজারি--সেহেতু ভাস্কায্য পেতে পারে সকল পক্ষের সম্মান, আন্দোলন হতে পারে তাঁর ভাবগাম্ভিয্য রক্ষার--তাই নয় কি?
গ্রেট বৃটেনকে গনতন্ত্রের রাজা-রাণীর দেশ বলা হয়,শতববছর গনতন্ত্র চর্চা অব্যাহত রেখেছে বৃটেন।সেখানে গনতন্ত্রের বিধিবিধান অনুসরনের জন্যে লিখিত সংবিধানের প্রয়োজন হয়নি তাঁদের। দীর্ঘ দিনের প্রচলিত রীতিনীতিই তাঁদের জনগনের মনে স্থায়ি প্রভাব সৃষ্টি করে--অলঙ্ঘনীয় সংবিধানে পরিণত করেছে। কোনপক্ষ কতৃক প্রচলিত প্রথা বা রীতিনীতি ভঙ্গ করার উদাহরনও দেখা যায়না। সেখানে তাঁদের বিশ্ব শাষন করার ঐতিহ্য রাজপরিবারকে যথাযথ মায্যদায় লালন করে, রাজপরিবারের শাষনতান্ত্রিক ক্ষমতা উহ্য।গনতন্ত্র চর্চায় রাজ পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
"গনতন্ত্র" মানব সৃষ্ট এমন একটি শাষন ব্যবস্থা-"যে শাষন ব্যবস্থা মানব কল্যানে তাঁর অন্তনিহিত সকল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কল্যান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিয়ন্তর চেষ্টা অব্যাহত রাখে। গনতন্ত্র ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধনি, গরিব, কাল, সাদা ইত্যাদি সকল বিষয়ে অন্ধ।কোন একটি বিষয় তাঁর উপর প্রভাব বিস্তারের অধিকার রাখেনা। গনতন্ত্রের কোন বিশেষন নেই, কোন অলংকার নেই, রঙ, রুপ, গন্ধ কিছুই নেই। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, হিন্দুকে হিন্দু, মুসলিমকে মুসলিম মেনে নিয়ে সকলের জন্যে সমমায্যদা রক্ষা করে নিজের ধর্ম সৃষ্টি করেছে "মানবধর্ম।" সুয্য যেমন তাঁর আলোতে পৃথিবীর সব কিছুতে সমভাবে আলো বিকিরণ করে; গনতন্ত্র তাঁর নিজের আলো "বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে মানবসেবার" উজ্বল আলোকরস্মির দ্বারা সবাইকে সমভাবে আলোকিত করে।
সুতারাং মহান সৃষ্টিকর্তা ঘোষিত যুগের সাথে তালমিলিয়ে সকল জটিলতার মিমাংসা পূর্বক ইসলামকে আধুনিকায়ন ও যুগ উপযোগী করার লক্ষে কোরান ও হাদিসের আলোকে এগিয়ে নেয়াই হবে ধর্মীয় ব্যাক্তিত্বদের সময়ের দাবী পূরনের অন্যতম দুরদর্শিতার পরিচায়ক।
ruhulaminmujumder@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন