১লা মে আন্তজাতিক শ্রমদিবস এবং বর্তমান বাংলাদেশের শ্রমজীবি।
রুহুল আমিন মজুমদার
১৮৮৬ সালে আমোরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আটঘন্টার কাজের দাবীতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। [১][২][৩][৪] ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্র্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অণুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। [৫] ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অণুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না খাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে’র ১ তারিখে “বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার” সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। (বাংলা উইকিপিডিয়া)
মে দিবসের তাৎপয্য:--
দিবসটি প্রতি বছর পালিত হয় নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। এটি শ্রমিকশ্রেণির বিজয়ের দিন, আনন্দ-উৎসবের দিন, তার সংগ্রাম ও সংগ্রামের শপথগ্রহণের দিন। সর্বোপরি, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্প্রদায় দিবসটি তাদের সংহতি প্রকাশের জন্যও পালন করে থাকে।
১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা যে রক্তক্ষরা সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন, সেটি কালক্রমে সারা দুনিয়াতেই ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনটি সুনির্দিষ্টভাবেই ছিল আটঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে। শ্রমিকদের ভাষায়, আমরা আটঘণ্টা কাজ করব, আটঘণ্টা বিশ্রাম করব, আর বাকি আটঘণ্টা বিনোদন বা সংগ্রাম করব। এভাবে প্রতিটি কর্মদিবস ভাগ করে দাবি উত্থাপন করার মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনে একটি বিরাট গুণগত পরিবর্তন এসেছে। একে বিশ্লেষণ করলে আমরা শ্রমিকদের শ্রেণিসচেতন হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করতে পারি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মে দিবস:--
কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের কৃষি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী, কাজের ঘন্টা, কাজের পরিবেশ নিশ্চিতে বিভিন্ন নামে শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব লক্ষনীয় ছিল।কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক কর্মঘন্টা আট ঘন্টা এবং মজুরী সাড়ে তিন কেজি চালের সমপরিমানে নির্ধারনের জন্যে দীর্ঘ আন্দোলনে জড়িয়ে ছিল ক্ষেতমজুর সমিতি সহ আরো কতক কৃষিশ্রমিক সংগঠন। শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক ইউনিয়নের পাশাপাশি অসংগঠিত কৃষিশ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজেও লক্ষনীয় তৎপরতা দেখা গেছে এই সেদিনও।
কৃষি শ্রমিকের উন্নতি :---
কৃষিকাজে উন্নত বীজ, চাষাবাদে যন্ত্রের ব্যবহার বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষি শ্রমিকের মুজুরী বেড়ে সংগঠনগুলীর দাবীকৃতের চেয়ে কয়েকগুন বেড়ে যাওয়ায় সংগঠন গুলীর আবেদন ধীরে ধীরে কমে শুন্যের কোটায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়াও জনজীবনে উন্নতি, অগ্রগতির ছোঁয়ায় কৃষি শ্রমিকের দুস্প্রাপ্যতা স্বয়ংক্রিয় তাঁদের মজুরী ও কর্মঘন্টা নিশ্চিত করে দিতে পেরেছে। একজন দিন মজুরের বেতন সাড়ে তিন কেজি চালের সমপরিমানের আন্দোলনের স্থলে বর্তমান সময়ে কৃষি শ্রমিকের প্রাপ্যতা দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ১২/১৫ কেজি চালের সমপরিমান মজুরী। ফলে কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠনগুলী এক্ষেত্রে আবেদন হারিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে।
কৃষিতে নারী শ্রমিক:--
বাংলাদেশে কৃষিতে আবহমানকাল থেকেই নারী শ্রমিকদের অবদান লক্ষনীয় ছিল এবং তাঁদের বিচরন এখনও বহমান।দু:খ্যজনক হলেও সত্য কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকগন পুরুষের অর্ধেক মজুরীতে কাজ করতে বাধ্য হয়। কৃষিকাজে নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে আমাদের দেশে তেমন কোন নারী সংগঠন গড়ে উঠেনি। "কর্মজীবি নারী" নামে মাঝে মধ্যে যে সংগঠনটির কর্মকান্ড চোখে পড়ে সামগ্রিক অর্থে উক্ত সংগঠনটি নারী শ্রমিকের দাবী আদায় কল্পে নিয়োজিত নয়।উক্ত সংগঠনটি এন, জি,ও নির্ভর সংগঠন হওয়ায় কর্মজীবি নারীদের কর্মের মানোন্নয়ন নিয়েই কাজ করে থাকে।ফলে কৃষি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায়ে তেমন কোন কায্যকর সঙ্গঠনের অস্তিত্ব আবহমান কাল থেকেই নজরে আসে না।ফলে এইক্ষেত্রে পুরুষের সমান শ্রম দিয়ে নারী তাঁর অর্ধেক মজুরীতে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে যুগের পর যুগ।
শিল্প শ্রমিক--
অত্যান্ত আনন্দের বিষয় যে, দীর্ঘবছর শিল্প কারখানার বিস্তার স্থবির থাকার পর বর্তমান সরকারের সময়ে এসে শিল্পস্থাপন, বিকাশ, উৎপাদনী যন্ত্রের আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে সবিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর বৃহৎ শিল্পকারখানা জাতীয়করনের মাধ্যমে উৎপাদনী যন্ত্রের অংশিদারিত্ব এবং উৎপাদিত পণ্যে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল।৭৫ পরবর্তী সরকার সমূহ উক্ত আইন বাতিল করে ভারী শিল্প কল কারখানা মালিকদের ফেরৎ, ক্ষেত্র বিশেষ অ-দাবিকৃত শিল্প কারখানা বিক্রির মাধ্যমে শিল্প কলকারখানায় শ্রমিদের শ্রম, শ্রমের বিকাশ, উৎপাদন, উৎপাদনী যন্ত্রের বিকাশ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। তাছাড়া পণ্যের গুনগত মান হালনাগাদ করতে না পারার কারনে একসময়ের সোনালী আঁশখ্যাত পাট শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সবগুলী পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করন করার পর এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজি জুট মিলকেও নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে বিক্রয় করে দেয়া হয়। আদমজি পাটকল বিক্রির মাধ্যমে পাটশিল্প বিকাশের পথে শেষ পেরেকটি গেঁথে দেয়া হয়।
গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ:---
পাট, চা, চামড়া শিল্পের ধ্বংসপ্রাপ্তির লুটপাটে অংশগ্রহন করে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে একটি মুৎসূদ্ধি শ্রেনী গড়ে উঠে বাংলাদেশে। এই সময়ে শ্রমঘন গার্মেন্টস শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটে। একদিকে নারী শ্রমিকের সহজ প্রাপ্যতা এবং নামমাত্র মজুরীতে উৎপাদনী যন্ত্র সচল রাখার নিশ্চয়তা মুনাফাখোর একশ্রেনীর শিল্পপতি দ্রুত শিল্পটির বিকাশ ঘটায়।শহরের যত্রতত্র স্থাপনের বিশেষ সুবিধা থাকায় যেনতেন ভাবে কিছু মেশিনপত্র আমদানীর মাধ্যমে যেখানে সেখানে কারখানা স্থাপন করে।তাঁরা সস্তায় কোন কোন ক্ষেত্রে বিনাবেতনে নারী ও শিশুদের উক্ত উৎপাদনী যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃত্ত করে। উক্ত প্রক্রিয়ায় রাতারাতি শ্রেনীটি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে রুপান্তরীত হয়। নারী শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী প্রাপ্তি, কাজের পরিবেশ নিশ্চিত, কর্মঘন্টা নিশ্চিতের অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক কোন সংগঠনের শক্তিশালী অবস্থান শুন্য থাকায় মাধ্যমটিতে ব্যাপক শ্রমশোষনের শিকার হয়। উক্ত শ্রেনীটি গরীব নারী ও শিশুদের শ্রম শোষনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রনের দিকেও মনযোগী হয়ে উঠে।
গার্মেন্টস শ্রমিক নিয্যাতনের মধ্যযুগীয় বর্বরতা:--
দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে শ্রমিকদের নির্যাতন আর বঞ্চনার কথা। এ রাষ্ট্রে শ্রমিকদের গার্মেন্টস এর ভিতরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয় মেইন গেইট, অবর্ণনীয় কষ্টকর পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রেখে শ্রমিকদের খাটানো হয়, নিয়োগপত্রহীন-মনুষ্যোচিত বাঁচার মতো মজুরী ব্যতীত ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ১,৫০০ শ্রমিক মারা গেছে, ২৫০ এর বেশি ঘটেছে দুর্ঘটনা যার মধ্যে ৮০টি বড়।
হত্যালীলা চলছে বিগত ৪৫ বছর ধরে। শ্রমিক মরছে আগুনে পুড়ে বা পদদলিত হয়ে বা বিল্ডিং ভেঙ্গে। একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ভবন ধ্বসে প্রায় ৮০ জন মারা যায়। ভবন ধ্বসের ঘটনায় হাইকোর্টের জারি করা রুলের জবাব দীর্ঘ আট বছরে দেয়নি সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা। ওই ঘটনায় সরকারের তদন্ত রিপোর্টও আদালতে দাখিল করা হয়নি।
২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশনস লিমিটেড নামের ওই কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ২০০ এর বেশি শ্রমিক, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককে। কিন্তু কারো বিচার হয়েছে কি তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেড এর মালিক পক্ষীয়দের? ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের জীবন এবং ভাগ্যও রয়ে গেছে দূর্ঘটনার মতই বিশ্রী এবং শোচনীয় অবস্থাতেই। এরই মাঝে ঘটে গেলো সাভার ট্রাজেডী, লাশ হলো প্রায় পাঁচশ নিরীহ শ্রমিক, আহত হাজারের উপর ! এই অবর্ণনীয় ক্ষয়-ক্ষতির কি কোন ক্ষতিপূরণ সম্ভব হবে? কখনই সম্ভব নয়। যারা শারীরিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই বরণ করে নিয়েছেন মানসিক ভারসাম্যহীনতাকেও।
রানা প্লাজায় ধ্বংসলীলার খবর আমরা সকলেই অবগত আছি।মজার ব্যাপারটি হচ্ছে রানা প্লাজায় দুর্ঘটনায় আহত নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরনের তালিকায় বিল্ডিং এর মালিক রানা নিজেও নাকি তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন জমা দিয়েছেন। ইহা যেন শ্রমিক হত্যাকান্ডের জন্যে অপরাধবোধ জাগ্রত নয়, শ্রমিকদের সঙ্গে একপ্রকার মস্করা।
শিল্প স্থাপনে নবযুগের সূচনা:---
বর্তমান সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে দেশব্যাপি গড়ে উঠছে বহু শিল্পাঞ্চল। হালকা থেকে ভারী এই সব শিল্প কলখারখানায় প্রযুক্তি নির্ভরতার কারনে শ্রমনির্ভরতা অনেকাংশে কম।জাহাজ শিল্প থেকে শুরু করে কৃষি উপকরন প্রক্রিয়াজাতকরন নির্ভর শিল্পস্থাপনাও রয়েছে এদের অন্তভূক্ত।এই সমস্ত শিল্প কারখানায় পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহনও তাৎপয্যপূর্ণ।এক্ষেত্রেও নবগঠিত শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সীমিত পয্যায় বিধায় শ্রমিকেরা নিয্যাতীত হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায়না। ঔষদ শিল্পে যুগান্তকরি সাফল্য অর্জিত হলেও এক্ষেত্রে উৎপাদনী সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগন ন্যয্য বেতন ভাতাদি প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে রয়েছে পাহাড়সম বৈশম্য।
নারী ও শিশুশ্রম:---
বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী প্রক্রিয়াজাত কারখানা, মৎস প্রক্রিয়াজাত কারখানায় রিয়েছে নারী ও শিশু শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহন। এই স্থলেও রয়েছে বেতন প্রাপ্তির স্থলে পুরুষ শ্রমিকদের সাথে নারী ও শিশুদের আকাশ পাতাল ব্যবধান। উল্লেখিত কারখানা সমূহে রয়েছে উল্লেখযোগ্য শিশুশ্রমের ব্যবহার, শিশুশ্রম কাগজে কলমে নিষিদ্ধ হলেও আইনটি মান্য করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও মনে করেন না মালিকপক্ষ। নামমাত্র বেতন অথবা শিক্ষানবীশ অজুহাতে বিনাশ্রমে নারী ও শিশুদের সহজ শ্রমপ্রাপ্তি লোভাতুর মালিকপক্ষকে তাঁদেরকে যত্রতত্র ব্যবহারে উৎসাহিত করেছে।
শ্রমিক আন্দোলন--বর্তমান বাংলাদেশ: ---
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একসময়ে বিদেশী তাঁবেদার সরকার সমূহ শিল্পকলকারখানা বন্ধ করে দেয়ার কারনে শ্রমিক আন্দোলন তাঁর গতি হারিয়ে নিস্তেজ আকার ধারন করেছে। স্বল্পসংখ্যক শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের উপস্থীতি বিচারে শ্রমিক আন্দোলনে সম্পৃত্ত সংগঠনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পরিদৃষ্ট ছিল। নতুন করে কারখানা চালু ও নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠনগুলীর তৎপরতা লক্ষনীয় হয়ে দেখা দেয়নি।তাছাড়া উপযুক্ত শ্রমিক সংগঠনের উপস্থীতিও এক্ষেত্রে প্রনিধানযোগ্য। শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির চেয়ে তাঁদের নীজেদের আখের ঘোচানো অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূখ্য হয়ে দেখা দেয়ায়, শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্যমান অনেকগুলী সংগঠনের বিশ্বাসযোগ্যতা শুন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে। এমত:বস্থায় আদর্শবাদী শ্রমিক সংগঠনের যুগৎপত অবস্থান নিশ্চিত না হলে শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে একশ্রেনীর মালিক অর্থবিত্তের পাহাড়ই গড়বে, শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন হবেনা। এতে সমাজে অর্থনৈতিক বৈশম্যের পাহাড় উঁচুই হতে থাকবে, যাহা বর্তমান সরকারের কল্যান রাষ্ট্র বিনির্মানের ক্ষেত্রকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলবে।
দেশ ও জনগনের জীবনযাত্রায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।দেশের অর্থনীতির আকার ধারন করেছে দ্বিগুনেরও অধিক আয়তন। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটলেও মালিকদের শোষণের ইতিহাস এখনও বদলায়নি এই বাংলাদেশে। আন্তজাতিকভাবে মে দিবসকে ঘোষণ করা হয়েছিলো রক্তাক্ত অগ্নি শপথের দিন হিসাবে। বলা হয় এই দিবসই শ্রমজীবি মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের এক রক্তাক্ত ফসল। কিন্তু সে ফসল আবাদ যারা করে যাচ্ছে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে; তাঁরা কি ভোগ করতে পারছে বাংলাদেশের সেই শ্রমজীবি মানুষজন? এই প্রশ্নের পরেও প্রশ্ন থাকে ১ মে দিবসের বিপ্লব এবং চেতনা কি ডুকরে কেঁদে ওঠে না আমাদের দেশের দুর্ঘটনায় কবলিত হতভাগা শ্রমিকদের লাশ এবং রক্তের হোলিখেলার মধ্যে?
এবারের ১লা মে আন্তজাতিক শ্রমিক দিবসের শফথ হোক সর্বস্তরে নারী শ্রমিকের মজুরী পুরুষ সমতুল্য এবং শিশুশ্রম আদায় সর্বস্তরে নিষিদ্ধ করার। আইন প্রয়োগকারি সংস্থা কতৃক কঠিনভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করা হোক।শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরপত্তা নিশ্চিত করা হোক।প্রতিটি শিল্পকারখানা গড়ে উঠুক দুষনমুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। পরিবেশ গড়ে উঠুক প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে ন্যায্য দাবী আদায়ের শ্রমিকবান্ধব একাধিক শ্রমিক সংগঠনের।
রুহুল আমিন মজুমদার
১৮৮৬ সালে আমোরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আটঘন্টার কাজের দাবীতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। [১][২][৩][৪] ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্র্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অণুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। [৫] ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অণুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না খাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে’র ১ তারিখে “বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার” সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। (বাংলা উইকিপিডিয়া)
মে দিবসের তাৎপয্য:--
দিবসটি প্রতি বছর পালিত হয় নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। এটি শ্রমিকশ্রেণির বিজয়ের দিন, আনন্দ-উৎসবের দিন, তার সংগ্রাম ও সংগ্রামের শপথগ্রহণের দিন। সর্বোপরি, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্প্রদায় দিবসটি তাদের সংহতি প্রকাশের জন্যও পালন করে থাকে।
১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা যে রক্তক্ষরা সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন, সেটি কালক্রমে সারা দুনিয়াতেই ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনটি সুনির্দিষ্টভাবেই ছিল আটঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে। শ্রমিকদের ভাষায়, আমরা আটঘণ্টা কাজ করব, আটঘণ্টা বিশ্রাম করব, আর বাকি আটঘণ্টা বিনোদন বা সংগ্রাম করব। এভাবে প্রতিটি কর্মদিবস ভাগ করে দাবি উত্থাপন করার মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনে একটি বিরাট গুণগত পরিবর্তন এসেছে। একে বিশ্লেষণ করলে আমরা শ্রমিকদের শ্রেণিসচেতন হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করতে পারি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মে দিবস:--
কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের কৃষি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী, কাজের ঘন্টা, কাজের পরিবেশ নিশ্চিতে বিভিন্ন নামে শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব লক্ষনীয় ছিল।কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক কর্মঘন্টা আট ঘন্টা এবং মজুরী সাড়ে তিন কেজি চালের সমপরিমানে নির্ধারনের জন্যে দীর্ঘ আন্দোলনে জড়িয়ে ছিল ক্ষেতমজুর সমিতি সহ আরো কতক কৃষিশ্রমিক সংগঠন। শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক ইউনিয়নের পাশাপাশি অসংগঠিত কৃষিশ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজেও লক্ষনীয় তৎপরতা দেখা গেছে এই সেদিনও।
কৃষি শ্রমিকের উন্নতি :---
কৃষিকাজে উন্নত বীজ, চাষাবাদে যন্ত্রের ব্যবহার বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষি শ্রমিকের মুজুরী বেড়ে সংগঠনগুলীর দাবীকৃতের চেয়ে কয়েকগুন বেড়ে যাওয়ায় সংগঠন গুলীর আবেদন ধীরে ধীরে কমে শুন্যের কোটায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়াও জনজীবনে উন্নতি, অগ্রগতির ছোঁয়ায় কৃষি শ্রমিকের দুস্প্রাপ্যতা স্বয়ংক্রিয় তাঁদের মজুরী ও কর্মঘন্টা নিশ্চিত করে দিতে পেরেছে। একজন দিন মজুরের বেতন সাড়ে তিন কেজি চালের সমপরিমানের আন্দোলনের স্থলে বর্তমান সময়ে কৃষি শ্রমিকের প্রাপ্যতা দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ১২/১৫ কেজি চালের সমপরিমান মজুরী। ফলে কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠনগুলী এক্ষেত্রে আবেদন হারিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে।
কৃষিতে নারী শ্রমিক:--
বাংলাদেশে কৃষিতে আবহমানকাল থেকেই নারী শ্রমিকদের অবদান লক্ষনীয় ছিল এবং তাঁদের বিচরন এখনও বহমান।দু:খ্যজনক হলেও সত্য কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকগন পুরুষের অর্ধেক মজুরীতে কাজ করতে বাধ্য হয়। কৃষিকাজে নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে আমাদের দেশে তেমন কোন নারী সংগঠন গড়ে উঠেনি। "কর্মজীবি নারী" নামে মাঝে মধ্যে যে সংগঠনটির কর্মকান্ড চোখে পড়ে সামগ্রিক অর্থে উক্ত সংগঠনটি নারী শ্রমিকের দাবী আদায় কল্পে নিয়োজিত নয়।উক্ত সংগঠনটি এন, জি,ও নির্ভর সংগঠন হওয়ায় কর্মজীবি নারীদের কর্মের মানোন্নয়ন নিয়েই কাজ করে থাকে।ফলে কৃষি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায়ে তেমন কোন কায্যকর সঙ্গঠনের অস্তিত্ব আবহমান কাল থেকেই নজরে আসে না।ফলে এইক্ষেত্রে পুরুষের সমান শ্রম দিয়ে নারী তাঁর অর্ধেক মজুরীতে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে যুগের পর যুগ।
শিল্প শ্রমিক--
অত্যান্ত আনন্দের বিষয় যে, দীর্ঘবছর শিল্প কারখানার বিস্তার স্থবির থাকার পর বর্তমান সরকারের সময়ে এসে শিল্পস্থাপন, বিকাশ, উৎপাদনী যন্ত্রের আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে সবিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর বৃহৎ শিল্পকারখানা জাতীয়করনের মাধ্যমে উৎপাদনী যন্ত্রের অংশিদারিত্ব এবং উৎপাদিত পণ্যে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল।৭৫ পরবর্তী সরকার সমূহ উক্ত আইন বাতিল করে ভারী শিল্প কল কারখানা মালিকদের ফেরৎ, ক্ষেত্র বিশেষ অ-দাবিকৃত শিল্প কারখানা বিক্রির মাধ্যমে শিল্প কলকারখানায় শ্রমিদের শ্রম, শ্রমের বিকাশ, উৎপাদন, উৎপাদনী যন্ত্রের বিকাশ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। তাছাড়া পণ্যের গুনগত মান হালনাগাদ করতে না পারার কারনে একসময়ের সোনালী আঁশখ্যাত পাট শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সবগুলী পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করন করার পর এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজি জুট মিলকেও নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে বিক্রয় করে দেয়া হয়। আদমজি পাটকল বিক্রির মাধ্যমে পাটশিল্প বিকাশের পথে শেষ পেরেকটি গেঁথে দেয়া হয়।
গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ:---
পাট, চা, চামড়া শিল্পের ধ্বংসপ্রাপ্তির লুটপাটে অংশগ্রহন করে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে একটি মুৎসূদ্ধি শ্রেনী গড়ে উঠে বাংলাদেশে। এই সময়ে শ্রমঘন গার্মেন্টস শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটে। একদিকে নারী শ্রমিকের সহজ প্রাপ্যতা এবং নামমাত্র মজুরীতে উৎপাদনী যন্ত্র সচল রাখার নিশ্চয়তা মুনাফাখোর একশ্রেনীর শিল্পপতি দ্রুত শিল্পটির বিকাশ ঘটায়।শহরের যত্রতত্র স্থাপনের বিশেষ সুবিধা থাকায় যেনতেন ভাবে কিছু মেশিনপত্র আমদানীর মাধ্যমে যেখানে সেখানে কারখানা স্থাপন করে।তাঁরা সস্তায় কোন কোন ক্ষেত্রে বিনাবেতনে নারী ও শিশুদের উক্ত উৎপাদনী যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃত্ত করে। উক্ত প্রক্রিয়ায় রাতারাতি শ্রেনীটি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে রুপান্তরীত হয়। নারী শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী প্রাপ্তি, কাজের পরিবেশ নিশ্চিত, কর্মঘন্টা নিশ্চিতের অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক কোন সংগঠনের শক্তিশালী অবস্থান শুন্য থাকায় মাধ্যমটিতে ব্যাপক শ্রমশোষনের শিকার হয়। উক্ত শ্রেনীটি গরীব নারী ও শিশুদের শ্রম শোষনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রনের দিকেও মনযোগী হয়ে উঠে।
গার্মেন্টস শ্রমিক নিয্যাতনের মধ্যযুগীয় বর্বরতা:--
দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে শ্রমিকদের নির্যাতন আর বঞ্চনার কথা। এ রাষ্ট্রে শ্রমিকদের গার্মেন্টস এর ভিতরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয় মেইন গেইট, অবর্ণনীয় কষ্টকর পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রেখে শ্রমিকদের খাটানো হয়, নিয়োগপত্রহীন-মনুষ্যোচিত বাঁচার মতো মজুরী ব্যতীত ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ১,৫০০ শ্রমিক মারা গেছে, ২৫০ এর বেশি ঘটেছে দুর্ঘটনা যার মধ্যে ৮০টি বড়।
হত্যালীলা চলছে বিগত ৪৫ বছর ধরে। শ্রমিক মরছে আগুনে পুড়ে বা পদদলিত হয়ে বা বিল্ডিং ভেঙ্গে। একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ভবন ধ্বসে প্রায় ৮০ জন মারা যায়। ভবন ধ্বসের ঘটনায় হাইকোর্টের জারি করা রুলের জবাব দীর্ঘ আট বছরে দেয়নি সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা। ওই ঘটনায় সরকারের তদন্ত রিপোর্টও আদালতে দাখিল করা হয়নি।
২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশনস লিমিটেড নামের ওই কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ২০০ এর বেশি শ্রমিক, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককে। কিন্তু কারো বিচার হয়েছে কি তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেড এর মালিক পক্ষীয়দের? ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের জীবন এবং ভাগ্যও রয়ে গেছে দূর্ঘটনার মতই বিশ্রী এবং শোচনীয় অবস্থাতেই। এরই মাঝে ঘটে গেলো সাভার ট্রাজেডী, লাশ হলো প্রায় পাঁচশ নিরীহ শ্রমিক, আহত হাজারের উপর ! এই অবর্ণনীয় ক্ষয়-ক্ষতির কি কোন ক্ষতিপূরণ সম্ভব হবে? কখনই সম্ভব নয়। যারা শারীরিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই বরণ করে নিয়েছেন মানসিক ভারসাম্যহীনতাকেও।
রানা প্লাজায় ধ্বংসলীলার খবর আমরা সকলেই অবগত আছি।মজার ব্যাপারটি হচ্ছে রানা প্লাজায় দুর্ঘটনায় আহত নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরনের তালিকায় বিল্ডিং এর মালিক রানা নিজেও নাকি তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন জমা দিয়েছেন। ইহা যেন শ্রমিক হত্যাকান্ডের জন্যে অপরাধবোধ জাগ্রত নয়, শ্রমিকদের সঙ্গে একপ্রকার মস্করা।
শিল্প স্থাপনে নবযুগের সূচনা:---
বর্তমান সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে দেশব্যাপি গড়ে উঠছে বহু শিল্পাঞ্চল। হালকা থেকে ভারী এই সব শিল্প কলখারখানায় প্রযুক্তি নির্ভরতার কারনে শ্রমনির্ভরতা অনেকাংশে কম।জাহাজ শিল্প থেকে শুরু করে কৃষি উপকরন প্রক্রিয়াজাতকরন নির্ভর শিল্পস্থাপনাও রয়েছে এদের অন্তভূক্ত।এই সমস্ত শিল্প কারখানায় পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহনও তাৎপয্যপূর্ণ।এক্ষেত্রেও নবগঠিত শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সীমিত পয্যায় বিধায় শ্রমিকেরা নিয্যাতীত হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায়না। ঔষদ শিল্পে যুগান্তকরি সাফল্য অর্জিত হলেও এক্ষেত্রে উৎপাদনী সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগন ন্যয্য বেতন ভাতাদি প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে রয়েছে পাহাড়সম বৈশম্য।
নারী ও শিশুশ্রম:---
বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী প্রক্রিয়াজাত কারখানা, মৎস প্রক্রিয়াজাত কারখানায় রিয়েছে নারী ও শিশু শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহন। এই স্থলেও রয়েছে বেতন প্রাপ্তির স্থলে পুরুষ শ্রমিকদের সাথে নারী ও শিশুদের আকাশ পাতাল ব্যবধান। উল্লেখিত কারখানা সমূহে রয়েছে উল্লেখযোগ্য শিশুশ্রমের ব্যবহার, শিশুশ্রম কাগজে কলমে নিষিদ্ধ হলেও আইনটি মান্য করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও মনে করেন না মালিকপক্ষ। নামমাত্র বেতন অথবা শিক্ষানবীশ অজুহাতে বিনাশ্রমে নারী ও শিশুদের সহজ শ্রমপ্রাপ্তি লোভাতুর মালিকপক্ষকে তাঁদেরকে যত্রতত্র ব্যবহারে উৎসাহিত করেছে।
শ্রমিক আন্দোলন--বর্তমান বাংলাদেশ: ---
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একসময়ে বিদেশী তাঁবেদার সরকার সমূহ শিল্পকলকারখানা বন্ধ করে দেয়ার কারনে শ্রমিক আন্দোলন তাঁর গতি হারিয়ে নিস্তেজ আকার ধারন করেছে। স্বল্পসংখ্যক শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের উপস্থীতি বিচারে শ্রমিক আন্দোলনে সম্পৃত্ত সংগঠনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পরিদৃষ্ট ছিল। নতুন করে কারখানা চালু ও নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠনগুলীর তৎপরতা লক্ষনীয় হয়ে দেখা দেয়নি।তাছাড়া উপযুক্ত শ্রমিক সংগঠনের উপস্থীতিও এক্ষেত্রে প্রনিধানযোগ্য। শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির চেয়ে তাঁদের নীজেদের আখের ঘোচানো অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূখ্য হয়ে দেখা দেয়ায়, শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্যমান অনেকগুলী সংগঠনের বিশ্বাসযোগ্যতা শুন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে। এমত:বস্থায় আদর্শবাদী শ্রমিক সংগঠনের যুগৎপত অবস্থান নিশ্চিত না হলে শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে একশ্রেনীর মালিক অর্থবিত্তের পাহাড়ই গড়বে, শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন হবেনা। এতে সমাজে অর্থনৈতিক বৈশম্যের পাহাড় উঁচুই হতে থাকবে, যাহা বর্তমান সরকারের কল্যান রাষ্ট্র বিনির্মানের ক্ষেত্রকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলবে।
দেশ ও জনগনের জীবনযাত্রায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।দেশের অর্থনীতির আকার ধারন করেছে দ্বিগুনেরও অধিক আয়তন। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটলেও মালিকদের শোষণের ইতিহাস এখনও বদলায়নি এই বাংলাদেশে। আন্তজাতিকভাবে মে দিবসকে ঘোষণ করা হয়েছিলো রক্তাক্ত অগ্নি শপথের দিন হিসাবে। বলা হয় এই দিবসই শ্রমজীবি মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের এক রক্তাক্ত ফসল। কিন্তু সে ফসল আবাদ যারা করে যাচ্ছে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে; তাঁরা কি ভোগ করতে পারছে বাংলাদেশের সেই শ্রমজীবি মানুষজন? এই প্রশ্নের পরেও প্রশ্ন থাকে ১ মে দিবসের বিপ্লব এবং চেতনা কি ডুকরে কেঁদে ওঠে না আমাদের দেশের দুর্ঘটনায় কবলিত হতভাগা শ্রমিকদের লাশ এবং রক্তের হোলিখেলার মধ্যে?
এবারের ১লা মে আন্তজাতিক শ্রমিক দিবসের শফথ হোক সর্বস্তরে নারী শ্রমিকের মজুরী পুরুষ সমতুল্য এবং শিশুশ্রম আদায় সর্বস্তরে নিষিদ্ধ করার। আইন প্রয়োগকারি সংস্থা কতৃক কঠিনভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করা হোক।শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরপত্তা নিশ্চিত করা হোক।প্রতিটি শিল্পকারখানা গড়ে উঠুক দুষনমুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। পরিবেশ গড়ে উঠুক প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে ন্যায্য দাবী আদায়ের শ্রমিকবান্ধব একাধিক শ্রমিক সংগঠনের।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন