এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মা'য়ের প্রতিক্ষা--ছেলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এসে ভাত খাবে।
(রুহুল আমিন মজুমদার)
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ--হাজারো, লাখো হৃদয়স্পর্ষী কাহিনী বাংলার আনাছে কানাছে অ-প্রকাশিত রয়ে গেছে।অনুমান করাটা আসলে কঠিন ব্যাপার। বিজাতীয় পাকিস্তানী শাষনশোষনের যাঁতাকলে পিষ্ট বাঙ্গালীকে শেকলমুক্ত করতে, বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে সাড়া দিয়ে, লাখো লাখো তরুন, যুবক, আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা কতজন কতভাবে জীবনের সর্বস্ব তুচ্ছ করেছিল। কাংক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষে অবদান রাখতে গিয়ে, করুন, মর্মস্পর্ষী, হৃদয়হীনভাবে মৃত্যুমূখে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল--তাঁর কোন ইয়াত্তা নেই। হৃদয়স্পর্ষি সমূদয় ঘটনার শিকারে পরিণত পাত্র, পাত্রীর তথ্য, উপাত্ত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অদ্যাবদি সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত হয়নি। যদিও জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরব মুক্তিযুদ্ধের খুঁটিনাটি তথ্য উপাত্ত সংরক্ষনে রাখা রাষ্ট্রের নৈতিক, আইনগত, মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং আবশ্যই পালনীয় ছিল।
বর্তমান সরকার ২০০৯ইং সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়ার পর সমম্বিত কিছু উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে। এর আগে সময়ে সময়ে কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থা মুক্তিযুদ্ধের এই সমস্ত স্মৃতি, বাঙ্গালী জাতির ত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অবদান সংরক্ষনের উদ্যোগ নিয়েছিল সত্য--মাঝপথে বাঁধাগ্রস্ততার কারনে উদ্যোগ বাতিল অথবা থেমে গেছে। ঢাকা ইউনিভারসিটি কেন্দ্রিক একদল নতুন প্রজম্মের মেধাবী তরুন ২০১৩/১৪ সালে নীজেদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা সংরক্ষনের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে অনেকদুর অগ্রসর হতে পেরেছেন। মুক্তিযোদ্ধা আর্কাইবসও এক্ষেত্রে তাঁদের কাজের অগ্রগতি লক্ষনীয়ভাবে তুলে ধরেছেন।
'৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ অশুভশক্তি বাঙ্গালী জাতিকে উলটো দিকে অনেকদূর পয্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। ফলে বহু মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের নীজেদের বিরত্বগাঁথার সংবাদ, ত্যাগের মহিমা প্রকাশতো দুরের কথা--মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও ভীত ছিলেন। অনেকেই নিজকে মুক্তিযুদ্ধা ভাবতেও গ্লানীতে আত্মহননের ইচ্ছা জেগে উঠার পরিবেশ বিরাজমান ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগ এবং তাঁর নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালিন শাষনকালে উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর অন্যসব ইতিহাসের ন্যায় ইহাও হারিয়ে যায় হিংস্রতার আগুনে। মুক্তিযুদ্ধের লাখো লাখো আত্মত্যাগের কাহিনী, বীরত্বের কাহিনী বিগত চল্লিশ/বিয়াল্লিশ বছরে অনেকের স্মৃতির পাতা থেকে মুছে গেছে। মুছে যাওয়া ঐ সমস্ত স্মৃতি, ত্যাগ, বিরত্বের কাহিনী ইতিহাসের পাতায় আসার কথা নয়। এখনও এমন হাজারো অজানা আত্মত্যাগ, কিংবদন্তির বীরত্ব গাঁথা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোক মুখে জীবন্ত রয়েছে---সদিচ্ছা নিয়ে হাত বাড়ালেই পাওয়া যেতে পারে। এখনও কুড়িয়ে পাওয়া হৃদয় বিদারক, মর্মস্পষী কাহিনী গুলীও যদি কখনও প্রকাশিত হয়-- নিশ্চিত আরব্য রজনীর রুপকল্পকে হার মানাবে। বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও বাস্তবতা সর্বস্ব এতসব লোমহর্ষক কাহিনী যথাতথা চড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
মূলত: মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ, বীরত্বগাঁথা, মুক্তিযোদ্ধাদের শৌয্যবিয্য, সাধারন মানুষের অসীম সাহষী কর্মকান্ডের শতভাগের একভাগও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় শেষ পয্যন্তও স্থান হবেনা। ইতিহাসে স্থান না পাওয়া এখনও অজস্র আত্মত্যাগ, বীরত্বগাঁথা বাংলার হাটেঘাটে, পথেপ্রান্তরে পরিবার, সমাজ, পাড়াপড়শী, বন্ধুমহলের চোখের পানিতে স্বরনীয়, বরনীয় হয়ে জীবন্ত রয়েছে। সময়ে ইতিহাসের অতলগব্বরে অধিকাংশ হারিয়ে যাবে ; ইতিমধ্যে যেমনি ভাবে হারিয়ে গেছে হাজারো কাহিনী।
কত হাজারো বিকৃত উপায়ে, পাষন্ডতায়, শৃগাল কুকুরের মানষিকতায়, বিকৃত, ধিকৃত, পাশবিকতায়, অচিন্তনীয় রুচিতে এদেশের মা, বোনদের উপর অত্যাচার, নিয্যাতন, নিস্পেষন চালিয়েছিল---অধিকাংশের খোঁজখবরও হয়নি। হাজারো বিকৃত প্রক্রিয়ায় বাঙ্গালী মা, বোন ভাইদের জীবন কেড়ে নিয়েছিল---সেই সমস্ত হৃদয় নিংড়ানো অব্যাক্ত কাহিনী, শতভাগের একভাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবেনা শত চেষ্টার পরেও।হাজারো অমরত্বের বিরত্বগাঁথা লোকের মূখে মুখে অনেক বছর প্রচলিত ছিল কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছিলনা বিধায় সংগৃহিত হয়নি। অনেক ঘটনা পরিবেশ পরিস্থীতির কারনে ইচ্ছাকৃত হারাতে বাধ্য হয়েছে। হাজারো হৃদয়স্পর্ষী ঘটনা প্রথম থেকেই লোক লজ্জায় অ-প্রকাশিত থেকে গেছে---সেই সমস্ত ঘটনা কেউ কোন দিন জানবে না।
তেমনি এক ভিডিওচিত্র 'ফেইছবুক বন্ধু অন-লাইন পোর্টাল বাংলাদেশ প্রেসের সম্পাদক জনাব Asrarul Huq Mahmood Rumy ভাইয়ের মাধ্যমে আমার হাতে এসেছে।' সত্যি ভিডিওটি দেখে চমৎকৃত, হতবিহব্বল, হৎচকিৎ, শিহরীত হলাম। এমনও কি হয়!! হতে পারে!!!
ফিরোজপুরের এক মুক্তিযোদ্ধার মায়ের হৃদয় নিংড়নো, নাড়িচেড়া ধনের ফিরে আসার অপেক্ষায় দীর্ঘ ৪৬ বছর প্রতিক্ষার বাস্তব তার অম্লান, মর্মস্পর্ষী উপাখ্যান। মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক পাকবাহিনীর নিয্যাতনে শহিদ হন।তাঁর নাড়িচেড়া মা বিগত ৪৬ বছর ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাননা তাঁর ছেলে আর কখনও ফিরে আসবেনা।পাকবাহিনীর চরম শারিরীক নিয্যাতনে আজ থেকে ৪৬ বছর আগে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে।
ফিরোজ পুর সদর উপজেলার শহর মাজিম পুর গ্রামের এক নিবৃত পল্লি। রাঁতের আধাঁরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, জেগে থাকে এক মা কুলসুম বেগম। তাঁর ছেলে ( মায়ের আদূরে নাম ফারুক সাহেব) বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় বলেছিল--"মা আমি সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ী ফিরে আসব"। ছেলের এই একটি বাক্যই 'জননী মা'কে রেখেছে ৪৬ বছর নির্ঘুম প্রতিক্ষায়।
মায়ের ফারুক সাহেব আর আসেননি। আজও মা তাঁর ফারুক সাহেবের অপেক্ষায় দরজা খোলা রেখে ঘুমান। ঘুমের ক্লান্তি যদি কখনও এসে যায় ঘরের সবাইকে সজাগ করে দেন প্রত্যহ, দরজায় খেয়াল রাখতে, যাতে তাঁর ফারুক সাহেব দরজা খোলা না পেয়ে ফেরৎ চলে না যায়। প্রতিদিন মা' ভাতের চাল দিয়ে রাখেন, অনেক সঙ্গি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভাত খেতে আসবে তার সাহেব ! ফারুকের বোন অঝোরে কেঁদে বলছিল--কোনদিন যদি আমরা চালের পরিমাণ কম দেই, মা খুব রাগ হয়ে যায় এবং কি মেয়ের জামাই বাড়ীতে বা কোথাও বেড়াতে গেলেও একই নিয়ম সবাইকে পালন করতে হয়।
মো: ওমর ফারুক। বয়স সবেমাত্র ২১ বছর। সরকারি শহীদ সরওয়াদী কলেজ ছাত্র সংসদের ভি,পি। ৭১ এর উত্তাল দিনগুলীতে লুকিয়ে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার মূল দায়িত্ব ছিল ছাত্রনেতা ওমর ফারুকের উপর। শুরুতে জড়িয়ে পড়েন 'স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গ্রুপে'র সঙ্গে।১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ফিরোজপুর টাউন হল চত্বরে প্রথম 'স্বাধীন বাংলাদেশের' পতাকা উত্তোলন করেন ওমর ফারুক। সেদিন তাঁর নেতৃত্বে পুড়িয়ে ফেলা হয় সব পাকিস্তানী পতাকা। সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পিরোজপুর ট্রেজারী ভেঙ্গে লুট করে নিয়ে আসেন সব অস্ত্র। প্রথম তিনমাস দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তি যুদ্ধ করলেও পরবর্তীতে ভারত চলে যাওয়ার প্রয়োজনীতা দেখা দেয়।
২৯ মে, স্বরুপ আটঘর কুরিয়ানা থেকে ভারত যাওয়ার পথে কির্তনখোলা নদীর তীরে ধরা পড়ে যায় এই অকুতোভয় বীর সেনানী পাকবাহিনীর হাতে। ধরাপড়ার সময় তার কাছে রক্ষিত ছিল সাতটি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তার একটি পতাকা নিষ্ঠুর,পাশবিক কায়দায় হাতুড়ি পেটা করে ডুকিয়ে দেয়া হয় তার মাথার মগজে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়--পাকিস্তানী সেনারা বারবার বলেছিল "পাকিস্তান জিন্দাবাদ বললে ছেড়ে দেবে। তেজস্বী যুবক নিয্যাতনে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে থাকা সত্বেও গাঁয়ের সমস্ত শক্তি উজাড় করে চিৎকার করে বলে উঠেছিল "জয়বাংলা"।
সেদিনই ওমর ফারুককে মৃত্যু নিশ্চিত করে কির্তন খোলা নদীতে তাঁর লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়।অনেক খুঁজাখুঁজি করেও সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর লাশের কোন সন্ধান পাননি। সমসাময়িক সময়ের এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন--ফারুক ভাই ছিলেন অগ্নিঝরা বক্তা।প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনিই সংগঠিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। পিরোজপুর কালেক্ট্রোরিয়েট মাঠে তিনিই প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।অথছ আজও আমরা তাঁকে জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা সেই সম্মানটুকুও দিতে পারিনি।
তানবীর আহম্মদের তথ্য ও ছবি নিয়ে মাকসুদুর নবীর প্রতিবেদনটি বেসরকারি টিভি 'চ্যানেল ২৪'' এ প্রচারিত হয়। বোনের চোখের পানি এখনও ঝর ঝর করে পড়ছিল।তাঁর বৃদ্ধ মা আজও বিশ্বাস করেন না তার ছেলে আর কখনও ফিরে আসবেনা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযূদ্ধ চলাকালিন দশম শ্রনীর একছাত্রের সাক্ষাৎকারও সংযোজিত রয়েছে ভিডিও চিত্রটিতে।
ruhulaminmujumder27@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন