অ-শুভশক্তির আস্ফালনরোধে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সম্মিলীত প্রতিরোধ।
রুহুল আমিন মজুমদার
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল ইসলামী আন্দোলনের নেতা চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে।দলটির প্রচার সম্পাদক আহমদ আব্দুল কাইয়ুম জানিয়েছেন, সমাবেশে যোগ দিতে নেতাকর্মীরা সারাদেশ থেকে ঢাকায় এসেছেন।সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী, নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ২০ এপ্রিলের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্য সরাতে আল্টিমেটাম দিয়েছিল চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির ২১ এপ্রিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার কথা ছিল। পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় বায়তুল মোকাররমের সামনে নামাজের পর সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা থাকলে তা না করে সরকারকে আবারো সময় বেঁধে দিয়েছেন আগামী রোজার ঈদ পয্যন্ত।
যে কোন রাজনৈতিক দল তাঁদের আদর্শ অনুযায়ী বক্তব্য দেয়ার, দাবী জানানোর, আন্দোলনের হুমকি ধমকি দেয়ার, আন্দোলন করার অধিকার গনতান্ত্রীক রাষ্ট্রে বৈধ।আমার বক্তব্য সেটি নয়। আমার আলোচ্য বিষয়--তাঁদের সমাবেশে প্লেকার্ডে লেখা স্লোগান এবং মুখে ধ্বনিত শ্লোগান নিয়ে। তাঁদের বহনকরা প্লেকার্ডের লেখা এবং স্লোগানে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে হিন্দুস্তান যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
আমি প্রথমেই সম্মানীত সুধিমহলের নিকট প্রশ্ন রাখতে চাই---সবাই জানে গ্রিক ভাস্কায্য এবং তাঁরাও মুখে বলে গ্রিক মূর্তি। গ্রিক ভাস্কায্য হোক আর মূর্তি হোক আমি সেদিকে যাবনা।আমি জানতে চাই গ্রিক দেশের নাগরিকেরা কি হিন্দু? যদি হিন্দু না হয়, দোষ কেন হিন্দুদের হবে? গ্রিসের নাগরিকেরা যদি হিন্দুই হতেন, ধরে নেয়া যেত বিশ্বায়নের যুগে হিন্দুদের গাঁয়ে দোলা লেগেছে। তাছাড়া গ্রিক ভাস্কায্য বা মুর্তি যাই বলিনা কেন--বসিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট কতৃপক্ষ, হিন্দুদের কেন হিন্দুস্থানে যেতে হবে? গ্রিক মুর্তির সাথে ষাটলক্ষ হিন্দু যদি হিন্দুস্থানেই যেতে হয়, বাবরী মসজিদের সাথে ছয়কোটি বাঙ্গালী মসুলমানকে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত যদি শিবসেনা বা বিজেপি নেয় (উভয় হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল) তাহলে কি চরমোনাই পীর সাহেবদের খুব ভাল কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে ?
চরমোনাই পীর সাহেবেরা ভুলে গেছেন '৭১ এর মুক্তি যুদ্ধে সেদিনের বহনকরা প্লেকার্ডে উল্লেখিত সাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ শ্লোগানের চরম পরাজয়ের গ্লানী। তখন কেবলমাত্র শতকরা ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষিত মসুলমানের বিচরন ছিল এই অঞ্চলে। নতুনভাবে উদ্ভব শিক্ষিত মসুলমান সমাজে বিজ্ঞানের ছোঁয়াও তখন তেমন লাগেনি। মুসলিম সমাজে নতুন সৃষ্ট একটি মধ্যবিত্ত শ্রেনী সবেমাত্র বর্ধিঞ্চুতা পেতে যাচ্ছিল। তাঁদের ছেলেমেয়েরাই সকল বাঁধা উপেক্ষা করে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি ঝুকে পড়ে। বর্ধিঞ্চু সেই শিক্ষিত সমাজের অগ্রজ 'শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে অত্রাঞ্চলে বিদ্যমান ধর্মবেদে বাঙ্গালী জাতীর ঐক্যবদ্ধরুপ "বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ" আবিস্কার করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলকে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেনীপেশার মানুষ মিলেমিশে বসবাস করার উপযোগী করে গড়ে তোলার সুদুরপ্রসারী চিন্তা।
২০০বছরের বৃটিশ শাষনে আজকের ভাস্কায্য বিরুধীরাই মুসলিম সমাজকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখেছিল।তাঁদের সে সময়কার 'ইংরেজী শিক্ষা হারাম' ফতোয়ার কারনে কালক্রমে মসুলমান সমাজ অতীতের শৌয্যবিয্য হারিয়ে হিন্দুদের তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছিল। মুসলিম সমাজের সেইদিনের ক্রান্তিকাল পার করে পাকিস্তান রাষ্ট্র ক্যেমের অব্যবহিত পর ধর্মীয় উম্মদনা সৃষ্টি করে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি, কৃষ্টি, জাতীয়তাবোধ উম্মেষে সামান্যতম বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্তানী শাষক শ্রেনীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সর্বাঙ্গীন পৃষ্টপোষকতা পাওয়া সত্বেও বাঙ্গালীর অমলীন সত্বাকে রুখতে পারেনি। বাঙ্গালী মননে তাঁর আবহমান কালের অকৃত্তিম বন্ধন ভাংলা ভাষার সাংস্কৃতি ,কৃষ্টি, ভাষাগত মিল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মবেদে যে জাতীয়তাবোধের উম্মেস ঘটিয়েছিলেন 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু', সেই চেতনাবোধে ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালী '৭১ ইং সালে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক শক্তির কবর রচনা করে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিল।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু নতুন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মায্যদা দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। বাংলাদেশের রণ সঙ্গিতের মায্যদা দিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রখ্যাত কবিতা "বিদ্রোহী" কবিতাটিকে।ভাষা আন্দোলনের অমর সঙ্গীত 'আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী' রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী'' বছরের প্রথমার্ধ্যে ফেব্রুয়ারী মাসে, কোন বাঙ্গালী অবশিষ্ট থাকেনা মনের অজান্তেই গেয়ে উঠেনা, শোকে মূহ্যমান বাঙ্গালী। ফেব্রুয়ারি মাস এলে এমনকোন বই পড়ুয়া বাঙ্গালী নেই, যে বাঙ্গালীর মনে পড়ে না ''বঙ্গবিবেক আবুল ফজলের অমর রচনা-- ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’।
কবিগুরুর দেশপ্রেমের অমলিন শিখা, নজরুলের চির বিদ্রোহের আগুন, গাফফার চৌধুরীর বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে ত্যাগের শোকগাঁথা, আবুল ফজলের বাঙ্গালী জাতির শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরনা যতদিন বাঙ্গালী মানসে অনুরনিত হবে, অনুপ্রানিত হবে ততদিন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়ীকতার বিষবাস্প ছড়ানোর কোন সুযোগ কোন মহলের হবেনা। এই সত্যটি সেদিনের প্লে-কাড বহনকারী চরমোনাই পীর সাহেবদের অস্তিত্ব আবহমান টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই বুঝা একান্ত প্রয়োজন ছিল। সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ব্যাবসায়ী, ইহুদির অনুসারি ইসলাম ধর্মে বিচরন করা বকধার্মিক, সাম্প্রদায়িক উগ্র ইহুদীবাদী শক্তির পতনের প্রতি পীর সাহেবের খেয়াল রাখা উচিৎ ছিল। যে চালটি পাতিলে বেশি লাফায়, পাতিলের বাহিরে আগুনের চুল্লি অথবা ঝাড়ুর আগায় তাঁর স্থান হয়।
বাঙ্গালী চেতনায় যতবার আঘাত এসেছে বাঙ্গালী ততবার বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে চক্রান্ত প্রতিহত করেছে। তবু কালের পরিক্রমায় মীরজাফর থেকে মোস্তাক, মোস্তাক থেকে জিয়ার জম্ম হয়েছে এই বাংলায়, বাংলার গর্বীত মায়ের উদরে। তাঁরা কলংকীত করেছে বারেবারে, বিভিন্নভাবে বাঙ্গালীর জাতীয়তাবোধকে, বাঙ্গালীর শ্বাস্বত: সংস্কৃতি আবহমানকালের কৃষ্টিকে। বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালী জাতি কে পরিচয় করে দিতে চেয়েছে-ভাষাহীন, সাম্প্রদায়িক, খুনী, আইন, বিচার, রাষ্ট্র কাঠামো না মানা অসভ্য জাতি হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান একুশের চেতনাকে অত্যন্ত কৌশলে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা ভিত্তিক গড়ে উঠা সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে তাঁর মেধা, কৌশল, প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক দুরদর্শীতা দিয়ে তিলে তিলে দেশভিত্তিক আন্দোলনে রূপদান করেছিলেন। সেই দেশটির নামও রেখেছিলেন তিনি নীজের মুখে, স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র কয়বছর আগেই। মীর জাফর জিয়া অনুধাবন, অনুকরন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ধারাবাহিকতা, তাঁর শয়তানীর অন্তদৃষ্টি দিয়ে।কোথায় থেকে কোথায় এসে পরিনতি পেয়েছিল জাতির জনকের সংগ্রামের ইতিহাস। জিয়াও বঙ্গবন্ধুর শুরু থেকে ধংশের কৌশল অবলম্বন করে সুচুতুরতার সঙ্গে, অত্যান্ত সুক্ষভাবে। তিনি ভাষা আন্দোলনের মুলচেতনা বাঙ্গালী জাতিয়তা বোধকে কনডেম করে জিন্নাহর ধর্ম ভিত্তিক" দ্বি-জাতি " তত্ত্বের চেতনা প্রয়োগ করতে থাকেন তার রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনৈতিক কৌশলে।
তিন হাজার বছরে গড়ে উঠা বাঙালীর ইতিহাস ঐতিহ্য,কৃষ্টি সংস্কৃতি সর্বপরি ভাষার ভিত্তিতে গড়ে উঠা "বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের" স্থলে ১৯৭১ ইং সালের ১৬ ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে প্রতারীত করে, তাঁর অনুকরনে "বাংলাদেশী জাতীয়তা বাদ" স্থাপন করেন। এই এক শঠতার ধুম্রসৃষ্টি করে মহামায়ার ইন্দ্রজাল বিছানো চতুরতায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহ্লাস বিকৃতির করুন এক নিদর্শন। মানুষ মানুষকে প্রতারিত করে, ঠকায় কিন্তু দেশ এবং জাতির সাথেও তদ্রুপ করতে পারে, সাধারন আমজনতা কি বুঝার কোন সামর্থ রাখে?
প্রিয় পাঠক আপনাদের অনেকেরই মনে আছে, মেজর জিয়ার প্রথম "রাজাকার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান "১৯৭৯ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে -বাংলা ভাষার নামকরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়ার পরামর্শেই তিনি এই ঘোষনা দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার রঙ গাঁয়েমাখা মীরজাফর জিয়ার পরামর্শ ছাড়া প্রেসিডেন্ট শাসিত" সরকারের) প্রধান মন্ত্রী এই ঘোষনা দিতে পারেনা। প্রধানমন্ত্রীর চাকুরিটাইতো মহামান্য" রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
দেশ ভাগ হতে পারে, খন্ড বিখন্ড হতে পারে একই ভাষাভাষির মানুষ কিন্তু ভাষা কি ভাগ হতে পারে? বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের "আরবজাতি " বহুধা ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন নামে দেশ শাষন করছে কিন্তু তাঁদের জাতীয়তাবোধের চেতনা "আরব জাতীয়তাবাদ" কি পরিবর্তন হয়েছে? ,নাকি কখনও কেউ পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছে? তাঁদের আরবি ভাষার কি পরিবর্তন হয়েছে? তাঁদের সংস্কৃতির বন্ধন যদি আরবি ভাষা হতে পারে, আমাদের সংস্কৃতির বন্ধন বাংলায় অসুবিধা কোথায়? বিয়ে, জম্মদিন, আরব জাতির নিজস্ব জাতীয় উৎসবে আনন্দে, পালাপার্বনে উলুধ্বনী দেয়ার প্রথা তাঁদের আবহমান কালের। তাঁদের সেই কৃষ্টির কি পরিবর্তন হয়েছে? নবী করিম (স:) করেছেন নাকি পরবর্তি কোন ধর্মীয় নেতা করেছেন? তবে বাঙ্গালী সংস্কৃতি অনুসরনে বা বাংলা ভাষা,সংস্কৃতি, কৃষ্টিতে ইসলাম ধর্মের অমায্যদা হবে?
মুলত: শাহ আজিজকে দিয়ে হিন্দু-বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি উস্কে দিয়ে সাধারন বাঙ্গালী মসুলমানদের সস্তা সেন্টিমেন্টকে পুজি করে পাকিস্তানী ধারাকে পুন: প্রতিষ্ঠিত করার মানষে জিয়া উল্লেখিত ঘোষনাটি সংসদে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। জিয়াই আনুষ্ঠানিক ভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ধ্বংসের ভিত্তি স্থাপন করেন। এখানে শেষ হলেতো ভালই ছিল, তারপরের ইতিহাস আরো বর্বর, করুন, হৃদয়বিদারক। "বাংলাদেশ বেতারের" নাম পরিবর্তন করে তিনি রাখেন "রেডিও বাংলাদেশ".।চালনা বন্দরের নাম পরিবর্তন করে রাখেন, "পোর্ট অব চালনা"। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনী "জয় বাংলা" শ্লোগানকেও পরিবর্তন করার স্পর্ধাও দেখান মুক্তিযুদ্ধা জিয়া। জয় বাংলার জায়গায় পাকিস্তানী ভাবধারার শ্লোগান 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' স্থাপন করেন তিনি।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই যে--'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ" শ্লোগান বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর দাঁড়িয়ে খুনিরা ১৫ আগষ্ট প্রত্যুষ্যেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় ভীত সম্ভ্রস্তভাবে রেডিওতে বারবার বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘোষনা দেয়ার পরেই উচ্চারন করেছিল। জিয়া বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা খুনীদের উচ্চারীত শ্লোগানটিই নিজ কন্ঠে ধারন করেন। আর কয়বছর সময় পেলে হয়তোবা "পাকছার জমিন নেছা দোবাত'কেও" আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির অঙ্গ "জাতীয় সঙ্গীত" বলে চালিয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহন করতেন তিনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে---বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের জন্য যে সমস্ত পত্র দেয়া হত সেখানে" নিমন্ত্রন" শব্দটি পয্যন্ত উঠিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎসময়ের সভাপতি বর্ষিয়ান জননেতা জনাব মরহুম আবদুল মালেক উকিল প্রতিবাদ জানালে তাঁকে "ভগবান দাশ" বলে বিদ্রুপ করতেও তাঁদের বিবেকে বাঁধেনি।
মুলত: ছোটছোট পরিবর্তন করে বাঙ্গালী মননে ধারন করিয়ে---বড় পরিবর্তনের সুদুরপ্রসারী চিন্তা করেছিলেন জিয়া। তাঁর সেই চেতনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন বিগত ১৯৯৬ ইং সাল পয্যন্ত সরকার গুলী। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে---যদি বাংলা---ইংরেজী শব্দ প্রয়োগ বা বিন্যাসে অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়,সেই ক্ষেত্রে বাংলা শব্দটির প্রাধান্য পেয়ে প্রতিস্থাপিত হবে। মেজর জিয়া এই জায়গাটুকুতেও পরিবর্তন করে বসিয়ে দেন ইংরেজী প্রধান্যের বিষয়টি। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ,কৃষ্টিতে ছোট ছোট পরিবর্তন করে বড় পরিবর্তনের মানষিকতা গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন জিয়া এবং তাঁর পরর্তী সামরিক, সেনাসমর্থীত বেসামরিক ফ্যাসিবাদি সরকার সমুহ।
জিয়ার মিত্রশক্তি এবং স্বাধীনতাবিরুধী অবস্থান, ইতিহাস ঐতিহ্য পরিবর্তন, সংস্কৃতি, কৃষ্টির উপর নগ্ন হামলা, মাতৃ ভাষা বাংলায় পরিবর্তনের সূচনা মূলত: পাকিস্তানী ধারায় পিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টার ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধু খুনের মাষ্টার মাইন্ড জিয়ার মুক্তিযুদ্ধ বিরুধী চেতনার ধারাবাহিকতা হচ্ছে আজকের দিনের ভাস্কায্য বিতর্ক সহ এযাবৎ উত্থাপিত তাঁদের অনুসারি বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা তথা দেশদ্রোহী বক্তব্য।
সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আক্রমণের মুখে ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় অ-সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিসমুহ, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি সমূহ শত্রু চিহ্নিত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ভোটের রাজনীতির কারনে রাজনৈতিক দলগুলো এই সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি। সাংস্কৃতিক গোষ্টি সমূহের দায়িত্ব নিতে হবে রাজনৈতিক শক্তির দৈন্যতা ঘোচানোর। বৃহৎ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ব্যর্থতা ঘোচানো ছাড়া এইসময়ে আর কোন গত্যান্তর নেই।
সহিংসতা ঘটানো অপশক্তির সঙ্গে সম্পৃত্তরা জানেনা সংস্কৃতির বিনাশ কখনই হয়না। এটি মানবজাতির সহজাত প্রক্রিয়ায় অংশ। কোনোভাবেই এর গতি রুদ্ধ করা যায় না। মৌলবাদী শক্তির এমন আস্ফালন এবং ক্ষনেক্ষনে ঝটিকা আক্রমণ অনেক দিন আগে থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে। আর সব সময় তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল ব্যাক্তি, সাংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্প কলায় জড়িত ব্যাক্তি, শিল্পি, সাহিত্যিক সর্বশেষ যুক্ত হল মননশীল শিল্পকর্ম "ভাস্কায্য।"
এই অপশক্তির অগ্রযাত্রা মোকাবেলায় কেবলমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষা যুগোপযোগী করে হবেনা। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেনা, তাদের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সোচ্চার হতে হবে। প্রগতির ধারার যে যেখানে আছে সে সেখান থেকেই সামর্থনুযায়ী সর্ব শক্তি ঢেলে দিয়ে তাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। যেকোন মুল্যে স্বাধীনতা, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধবাদী শক্তিকে বিনাশ করতে হবে। অশুভশক্তির উৎসস্থল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে চারখার করে দিয়ে, আগামী প্রজম্মের জন্য নতুন বাংলাদেশ,প্রগতিশীল বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়ীক বাংলাদেশ, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতি দিয়ে অশুভশক্তির গতিরোধ সম্ভব নয়। অতীতেও রাজনৈতিক শক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেনি,শেষমহুর্তে নেতৃত্ব তুলে নিয়েছে,তাঁদের ক্ষমতা পাওয়ার সুবিধার্থে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় বসার সুবিধাই চাইবে এবং ইহা স্বাভাবিকও বটে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন---ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন দাঁনা বেঁধেছিল বলেই '৭১ ইং সালে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। উনসত্তরে পুর্ববাংলার আপামর জনগনের গনভ্যুত্থান ঘটেছিল বলেই মুক্তিযূদ্ধের গৌরবে গৌরাম্বিত হতে পেরেছে বাঙ্গালী জাতি। মহীয়ষি নারী 'জাহানারা ঈমামের' নেতৃত্বে মানবতা বিরুধী অপরাধের প্রতিকি বিচার সম্ভব হয়েছিল বলেই '৯৬ এ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। সেই প্রতিকী বিচারের রেশ ধরে বর্তমান সময়েও রাজাকারের বিচার সম্ভব হচ্ছে। শাহবাগে 'গনজাগরন মঞ্চ' হয়েছিল বলেই--আপিল সহ রাজাকারের সর্বচ্ছো শাস্তির বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। তদ্রুপ পূর্বের মতই আর একটি আন্দোলন প্রয়োজন সার্বজনীনভাবে। এবারের আন্দোলনের একমাত্র এবং একমাত্র লক্ষ হবে অ-শুভশক্তি এবং তাঁদের প্রেতাত্বাদের সর্বমূলে বিনাশ।
সাধারন চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ যে কোন সচেতন নাগরীকের উপলব্দি করার ক্ষেত্রে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়---ব্রাম্মনবাড়ীয়ার সহিংস ঘটনার পরপরই অশুভ চক্রটির ত্রানকর্তার ভুমিকায় অবতির্ন্ন হয় বিএনপি জামায়াতের বিশদলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহন করে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার করে জনমনে বিভ্রান্তি চড়ানোই কৌশল গ্রহন করে সে। সাম্প্রদায়িক গোষ্টি সমূহের মেরুকরন ও আস্ফালনের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার মুক্তিযুদ্ধবিরুধী অবস্থান এবং প্রকাশ্য বক্তব্য তাঁদের আস্ফালনের ক্ষেত্রে প্রভূত শক্তি যুগিয়েছে। নতুন নতুন বিতর্ক উত্থাপন করে একের পর এক চ্যালেঞ্জ চুঁড়ে দিয়ে সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও জাতিকে সহিংস করে তোলাই তাঁদের উদ্দেশ্য। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ধৈয্যচ্যুতি ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ স্বীকার করার অপচেষ্টা মাত্র। বিএনপি জোটের আস্কারা পেয়ে নতুনভাবে বাঙ্গালীর ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকায় অবতিন্ন হলেন চরমোনাই পীর সাহেব। তাঁর নেতৃত্বে সারাদেশ থেকে জড়ো হওয়া অতিক্ষুদ্র শক্তিও সরকারকে ভাস্কায্য সরানোর আলটিমেটাম দেয়ার দু:সাহষ দেখাতে পেরেছে। ইহা নির্গাত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারি দল,বাঙ্গালী চেতনার ধারক বাহক দল, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শে উজ্জিবীত দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও তাঁর সরকারের চরম দুর্বলতা।
৭৫ ইং থেকে ২০০৬ইং মাঝখানে ১৯৯৬-২০০১ ইং বাদ দিলে তাঁরাই তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয় করে শহীদ দিবস, স্বাধীনতাদিবস, বিজয়দিবস সহ অন্যান্ন জাতীয় দিবস সমূহ পালন করেছেন। তখন মনে হয়নি-- মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালী শহীদ হয়নি। এখন তাঁদের মনে হচ্ছে পরম বন্ধুরা যখন একের পর এক ফাঁসীর রজ্জুতে ঝুলছে এবং ঝুলার অপেক্ষায় আছে। ধর্মব্যাবসায়ী, অশুভশক্তি, ষড়যন্ত্রকারি, দেশদ্রোহীদের বিনাশের অপর নাম বিশদলীয় জোট এবং তাঁর নেত্রীর সর্বৈব বিনাশ। তাইতো মরিয়া হয়ে তাঁদের বাঁচার এত আয়োজন। সকল চেষ্টা ব্যার্থ হওয়ার পর নতুন আঙিকে ষড়যন্ত্রের নকশা বাস্তবায়নের অংশই হচ্ছে লাগাতার মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতিবেদ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাস্কায্য সর্বোপুরী বাঙ্গালী অসাম্প্রদায়িক অস্তিত্বের উপর একের পর এক আঘাত করে প্রতিঘাতের অপেক্ষায় প্রহরগোনা। যেকোন ভাবে সরকারের ধৈয্যচ্যুতি ঘটিয়ে দেশকে অস্থীতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়ে পানি ঘোলা করাই তাঁদের প্রতিজ্ঞা।
প্রাচীন যুগ থেকে অত্রাঞ্চলে সাহিত্যপ্রীতি ও সঙ্গীতপ্রীতি, শিল্পি ও শিল্পের কদর দেখা যায়। লোকনৃত্যে, সাহিত্যে ও শিল্পে একটি আধ্যাত্মিকতার ছাপ দৃশ্যমান। বাংলার ভাটিয়ালি, বাউল, মুর্শিদি, মারফতি প্রভৃতি গানের মধ্যে এখানকার জনজীবনের অন্তরের সুর ধ্বনিত হয়। কবিগান, যাত্রা, জারি, সারি, পালাগান, কীর্তন ইত্যাদির সঙ্গে অত্রাঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক নিবিড়। যত দিন বাঙালি আছে, বাংলা ভাষা আছে, শহীদ মিনার আছে, একুশে ফেব্রুয়ারি আছে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাসের কবিতা আছে, লালন ফকির, হাসনরাজা ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গীত আছে তত দিন কোন ষড়যন্ত্রই বাধাঁ হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। অ-শুভ সাম্প্রদায়ীক গোষ্টি যত চেষ্টাই করুক না কেন, সহিংসতা, সন্ত্রাস ও ধর্মান্ধতার মাধ্যমে আবহমান বাংলার এই সংস্কৃতি, কৃষ্টি ধ্বংস করা যাবেনা। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এইহীন অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক দল,মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি, মুক্তমনা লেখক সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সর্বপোরি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ব্যাক্তি, সংগঠন সমুহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই সময়। শিল্প সংস্কৃতি, কৃষ্টির বিরুদ্ধে যেকোন হুমকি অতীতের ন্যায় বাঙ্গালী বুকের তাজা রক্ত ঢেলে প্রতিহত করবেই করবে।
"জয়বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন