যৌতুকের সর্বগ্রাসি বিস্তার--বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে বড় বাঁধা।

যৌতুকের সর্বগ্রাসি বিস্তার--"বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মানের ক্ষেত্রে বড় বাধা।"
        (রুহুল  আমিন  মজুমদার)

      যৌতুক কি---

      বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে- বিবাহের চুক্তি অনুসারে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বা বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে যে সম্পত্তি বা অর্থ দেয় তাকে যৌতুক বা পণ বলে। (বাংলাপিডিয়া ৮/৪৫৫)
বাংলাদেশের ১৯৮০ সনের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে যৌতুকের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ : যৌতুক অর্থ (ক) কোন এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে, অথবা (খ) বিবাহের কোন এক পক্ষের পিতামাতা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোন পক্ষকে বা অন্য কোন ব্যক্তিকে বিবাহের মজলিসে বা বিবাহের পূর্বে বা পরে যে কোন সময়ে বিবাহের পণ রূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদানে অঙ্গিকারাবদ্ধ যে কোন সম্পত্তি বা জামানত। (যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০, আইন নং ০৫)
২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। তাতেও যৌতুকের ব্যাপক সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ আইনটি ২০০৩ সালে সংশোধন হয়। সংশোধিত আইনে যৌতুকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা এই : যৌতুকের অর্থ (অ) কোন বিবাহে বর বা বরের পিতামাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বিবাহের পণ হিসেবে বিবাহের অন্য পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রি বা অন্যবিধ সম্পদ। অথবা (আ) কোন বিবাহের কনেপক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোন ব্যক্তিকে উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপরে বা বৈবাহিক সর্ম্পক বিদ্যমান থাকাকালে বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বিবাহের পণ হিসাবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ। (ধারা-২, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩)

  মোহরানা:---

   দেনমোহর যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত নয়। যৌতুক নিষিদ্ধ করণ আইন ১৯৮০ তে যৌতুকের সংজ্ঞা দেওয়ার পর বলা হয়েছে, শলীয়ত মোতাবেক প্রদেয় দেনমোহর, বা মোহরানা ইহার অন্তর্ভুক্ত নহে।’ (যৌতুক নিষিদ্ধ আইন ১৯৮০,আইন নং৩৫)তদ্রূপ ভারতের ১৯৬১ সনের যৌতুক নিষিদ্ধ করণ আইন থেকেও মোহরকে বাদ দেওয়া হয়েছে। (বাংলা পিডিয়া ৮/৪৫৫)।

যৌতুকের উৎপত্তি----

    যৌতুকের উৎপত্তি সম্বন্ধে সুনির্ধারিত কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। অধুনা এ বিষয়ে গবেষকগণ এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে যা লিখেছেন এর সারমর্ম হল, প্রাচীন হিন্দুসমাজে এর উৎপত্তি হয়েছে, এটি প্রায় স্বীকৃত।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রাচীন হিন্দুসমাজে এটি ছিল কন্যাপণ (ইৎরফব চৎরপব) অর্থাৎ বরপক্ষ কনে পক্ষকে দিত। কনেপক্ষ বিয়ের মাধ্যমে তাদের একজন সদস্য হারাচ্ছে এর ক্ষতিপূরণের জন্য কনের পরিবারকে বরপক্ষ কর্তৃক বিভিন্ন সম্পদ দিত। কালক্রমে এটি বরপণে রূপ ধারণ করে| (The family Structure in Islam, By : Dr. Hammadah Abdul Ati); বাংলাপিডিয়া ৮/৪৫৫; ইসলাম ও যৌতুক, সিরাজুল হক সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত,( পৃ. ১৫)

ইসলামের দৃষ্টিতে যৌতুক----
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে ভাবেই ইউক না কেন অন্যায় ভাবে মানুষের মাল ভক্ষন করা জায়েয নেই ৷ জোর পূবক আথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কারো কোন টাকা -পয়সা ,খাওয়া দাওয়া, ব্যবহায্য জীনিষপত্র দখলে নেয়া জায়েজ নেই।, তেমনি সমাজিক চাপে পডে বা অন্যকোন উপায়ে যে কোন উপঢৌকন দাবী বা আদায় করে নেয়া অন্যায়, অবৈধ ও হারাম।

ইসলাম ধর্মে নারীদের সম্মান:----

      ইসলাম নারীদের সম্মানীত করেছে তাঁদের বিবাহের মোহর ধায্য করে।পৈত্রিক এবং স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকারি করে,স্বামী স্ত্রীর সমমায্যদা দিয়ে-- "যাহা অন্য কোন ধর্মে নারীদের দেয়নি।"
আল্লাহর তাঁর পাককালামে বলেন "তোমরা তোমদের স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও।এই বাক্যটির মাধ্যমে মোহর পরিশোধ বাধ্যতামূলক করে নারীদের মায্যদা এবং শ্রেষ্ঠত্বকে উধ্বে তুলে ধরেছেন।একমাত্র ইসলামেই নারী এবং পুরুষের পার্থক্য বিবেচনা করার সামগ্রিক বিবরণ ফয়েছে।স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে আচার আচরন সম্পর্কীত বিষয়াবলীও কোরান এবং হাদিসে বর্ণিত আছে।অন্যকোন ধর্মগ্রন্থেই এত বিশদ বর্ণনা নেই যা ইসলাম ধর্মগ্রন্থ পাক কোরান এবং নবী(স:) এর হাদিসে রয়েছে।

   মুসলিম আইন অনুযায়ী পাত্রীকে মোহরানা পরিশোধ করতে হয়।ইসলামী জীবন বিধানে 'মোহর' বিষয়টির উপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবতায় তাঁর চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত।  বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে দেবে--মেয়ে নেবে- যেমন 'মোহর"। মেয়ে পক্ষ কোনমতেই দেয়ার কথা নয়--"মোহরই প্রমান করে।"
      অথচ আজকাল কন্যা পক্ষ বরকে ১, ২, ৩, ৫,লক্ষ টাকা বা ততোধিক নগদ অর্থ প্রদান করতে হয়। সাথে আরও অনেক কিছু তো আছে-ই। এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক--"বর কণের মোহরানা বাবত কিছুই পরিশোধ করা ব্যতিরেকে  বিবাহ কি বৈধ হবে? পরিশোধ করলেও মুখে মুখেই সীমাবদ্ধ কিন্তু বাস্তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আদায় করেনা। অথচ বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য বর-কনের ইজাব-কবুল, ইমামসহ ৪জন সাক্ষির উপস্থীতি ও মোহরানা আদায় বাধ্যতামূলক। একদিকে বর  মোহরানা আদায় করছেনা  উল্টো নিচ্ছে--" ইসলামের দৃষ্টিতে যাহা সম্পুর্ণ শরিয়ত বিরুধী"।

হিন্দু সমাজে যৌতুক:-----

উপমহাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বৈবাহিক রীতিতে যৌতুকের গুরুত্ব অত্যধিক। হিন্দু ধর্মে উত্তরাধিকার সুত্রে পিতার সম্পত্তিতে মেয়ে সন্তানদের অংশীদারিত্বের স্বীকৃতি নেই। এ জন্য যৌতুক তাদের বিবাহপর্বের একটি শক্তিশালী অনুষঙ্গ ও উপলক্ষ হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে এসেছে ও আসছে।যেহেতু পিতার অবর্তমানে সম্পদের মালিক হওয়া ধর্মীয় রীতিতে নেই সেহেতু বিয়ে উপলক্ষ করে এককালিন যা দেয়া হয় উহাকে তাঁর অংশীদারিত্ব বললে অত্যুক্তি হবেনা কারন:--পারিবারিক অবস্থাবেদে উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সম্পদের চেয়ে উক্ত সম্পদ কেবল মাত্র কম নয়।
     তাছাড়া হিন্দুরীতিতে স্ত্রীত্যাগ করার বিধান নেই, কোন কোন ক্ষেত্রে একাধিক স্ত্রী গ্রহনও স্বীকৃত নয়। সেই সুত্রেও তাঁদের সামাজিক রীতিতে এককালিন ধায্য সম্পদ কোন প্রকারেই যৌতুক বলা যেতে পারেনা।

  এই অঞ্চলে যৌতুক প্রথার বিস্তার এবং উল্লেখযোগ্য কারন:---

   -এ অঞ্চলে প্রতিবেশী সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও জীবনাচারের প্রভাব মুসলমানদের ক্ষেত্রে অচ্যুত হলেও যৌতুকের ন্যায় কু-প্রভাবটি গ্রহন করতে কারো আপত্তি হয়নি।বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী মুক্ত করার জন্যে যারা একদা অর্দু ভাষার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিল সেই কুলিন পক্ষরাই যৌতুক প্রথা প্রচলন করেছে এই অঞ্চলে।সাধারন বাঙ্গালী মসুলমানদের ক্ষেত্রে যৌতুক প্রথা ৭০এর দশক পয্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারেনি।বৃটিশ / পাকিস্তানের তাঁবেদার শ্রণী তৎসময়ের সরকার সমুহের তাঁবেদারীর মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়।তাঁরা তাঁদের ছেলেদের লেখা পড়া করিয়ে শিক্ষিত করার পর কনে পক্ষ থেকে নগদ টাকা দাবী করতে থাকে। ক্রমান্বয়ে রীতিটি কুলিনদের ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত হয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত পয্যন্ত বিস্তৃত হয়।আশির দশকে এসে উক্ত রীতি মহামারি আকার ধারন করে সর্বস্তরে বিস্তৃতি লাভ করে।গরীবেরা তাঁদের ছেলেকে গরীবি নিবারনের হাতিয়ারে পরিণত করে।কেউ কেউ কনের পিতা থেকে অর্থগ্রহন করে সেই অর্থে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে সত্যিকার অর্থেই গরীবি হঠাতে সমর্থ হয়েছে।গরীব ছেলের বাবা যদিও গরীবি হঠিয়েছেন গরীব কণের বাবা সম্পদ হারিয়ে পথে বসেছেন।
    ৭০ দশক আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে যৌতুক নামক প্রথা সর্বস্তরে অপরিচিত ছিল। সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৪৫-১৯৬০ সালে যৌতুকের হার ছিল ৩% মাত্র(উইকিপিডিয়া)।উক্ত যৌতুক দেয়া নেয়া হয়েছে শুধুমাত্র কুলিন পরিবার সমূহের মধ্যে(ইংরেজ/পাকি তাবেদার শ্রেনী)।'
     '৭৩/ '৭৪ ইং সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকার কতৃক বিদেশ ভ্রমনের জন্য পাসপোর্ট প্রনয়ন করে।তাঁর আগে এই অঞ্চলের মানুষ পাসপোর্টের অভাবে বিদেশ যাওয়ার কোন সুযোগ ছিলনা।সাধারনে পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার তাঁর বিস্তার যত দ্রুত সংগঠিত হয়েছে   যৌতুক তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে সর্বব্যাপি হয়েছে। বিদেশভ্রমনের আইনগত বৈধতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্র অঞ্চলের মানুষ তাঁদের জীবন যাত্রা পরিবর্তনের নেশায় বিয়ে ব্যবস্থাকে জিম্মি করে ছেলেপক্ষ ।
          মুলত: জীবন যাত্রার পরিবর্তন,উন্নত জীবিকার তাড়না,  সমাজে বসবাসরত: পরিবার গুলীর অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতা, বিলাসী জীবনযাপনের  অদম্য আকাংক্ষা থেকে যৌতুকের বিস্তার ঘটে।এই সময়ে সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার উক্তব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

    এই সময়ে কন্যাসন্তানের পরিবার সম্পদ হারিয়ে দ্রুত নি:স্ব হতে থাকলে সর্বস্তরে টনক নড়ে উঠে। বিশেষকরে ৭০ এর দশকে যৌতুক সর্বব্যাপি বিস্তারীত হয়ে ছোটবড় সকল পরিবারকে কোন না কোনভাবে নাড়া দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বহু পুরাতন সংসারেও নতুন করে  যৌতুকের দাবীতে আগুন জ্বলে উঠে।যৌতুক সংক্রান্ত বিষয়ে স্ত্রীহত্যা,কেরোসিন ঢেলে গাঁয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া,হত্যাকরে ফাঁসীর রশিতে ঝুলিয়ে রাখা, শশুর শাশুড়ি কতৃক অকথ্য নিয্যাতনে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার মত অমানবিক কর্মকান্ড ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। তড়িগড়ি সরকার ১৯৮০ সালে আইনগতভাবে যৌতুক নিষিদ্ধ করে। কিন্তু উক্ত আইন প্রনয়নের পর যৌতুক না কমে অনেকাংশে বেড়েছে, যা ২০০৩ সালে ছিল ৭৬% । ২০০৮ইং সালে ব্র্যাক ও আমেরিকার পপুলেশন কাউন্সিলের সমীক্ষা অনুযারী বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ভেদে যৌতুকের হার নিরুপিত হয় ২০% থেকে ৮০% পয্যন্ত।

নারী পুরুষের বন্ধনগত সামাজিক গুরুত্ব:-----

নারী পুরুষের সম্পর্কের সবচেয়ে দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি হয় বিবাহের মাধ্যমে । অনেক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও এ সম্পর্ক গভীর হয় বললেও অতিরঞ্জিত করা হবে বলে মনে হয়না । বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে নারী পুরুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় সু-গভীর আত্মীক সম্পর্ক । যে সম্পর্ক বলে বোঝানোর বিষয় নয় বরং উপলব্ধির বিষয় । ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা একটি ছেলে অন্য পরিবেশের একটি মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এতটা আপন হওয়া সত্যিই বিস্ময়ের বিষয় । দেশের সীমানা, জাতির পরিচয় কিংবা ধর্মের বাধা পেড়িয়েও এ সম্পর্ক তৈরি হয় । সম্পূর্ণ অচেনা দু’জন নারী পুরুষও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মূহুর্তের মধ্যে চির আপন হয়ে যায় । এদের একজনের প্রতি অন্যজনের আস্থা কিংবা বিশ্বাস পরিমাপ করার কোন যন্ত্র এখনো কোন বিজ্ঞানী আবিস্কার করতে পারেনি কিংবা পারবেও না কোনদিন । বিবাহের মাধ্যমেই শুরু হয় জীবনের দ্বিতীয় ধাপ এবং নতুন পথচলা। আমাদের দেশে বিবাহ পদ্ধতিতে আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে । ধর্মীয় নিয়মাবলীর সাথে পালন করা হয় ঐতিহ্যগত অনেক প্রথা । বিবাহে অনেকগুলো সু-প্রথা অনুসরণ করা হলেও কয়েকটি কু-প্রথাও অনুসরণ করা হয় ।

সামাজিক বন্ধনে কু-প্রথা যৌতুকের প্রভাব:---

এ কু-প্রথার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক এবং ঘৃণ্যতম যৌতুক প্রথা । বিবাহের মত একটি মধুর সম্পর্ককে যৌতুক প্রথা বিষিয়ে তোলে । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৈরি হয় দূরত্ব । স্ত্রীকে সহ্য করতে হয় অনেক গঞ্জনা । শারীরিক এবং মানসিক নিয্যাতন তো আছেই । অনেক স্ত্রীকে জীবন দিতে হয় শুধু যৌতুকের কারণে । সমাজের নিম্নতম পেশাজীবি থেকে একেবারে সর্বোচ্চ শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে কম বেশি যৌতুক প্রথা বিদ্যমান । বর্তমানে যৌতুক আদান প্রদান আইনত নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং এ কু-প্রথাকে কিছু সচেতন মানুষ ঘৃণা করতে শুরু করায় ভিন্ন নামে এর প্রচলন শুরু হয়েছে । মেয়ে-জামাই এবং জামাইয়ের পরিবারকে খুশি করার নামে গরীব কিংবা ধণাঢ্য পিতা-মাতা উপহার হিসেবে অনেক কিছু দিলেও তা যৌতুক হিসেবে বিবেচিত হয়না । ধণাঢ্যরা অনেক কিছু দেয়ার সামর্থ্য রাখলেও গরীব-পিতামাতা সামান্য কিছু দিতে বাধ্য হলেও অনেক সময় তাদের সর্বস্ব হারাতে হয় । অন্যদিকে যৌতুক আইনত নিষিদ্ধ হলেও সামাজিক কু-প্রথা হিসেবে অনেক গভীরে শেকড় প্রোথিত রয়েছে।

যৌতুক আদায়ের কৌশল:----

       মেয়ে পক্ষের পিতা-মাতা অনেক বাধ্য হয়েই সামাজিক পদ-মায্যদা রক্ষা করার জন্য উপহারের মোড়কে যৌতুক দেন । ছেলে পক্ষের অভিভাবকরাও ওঁৎ পেতে থাকে কিভাবে কৌশলে মেয়ে পক্ষ থেকে কিছুটা আদায় করা যায় । মেয়ে পক্ষ থেকে ছেলে পক্ষ কখনো ছেলে বিদেশ যাবে বলে ধারের নামে অর্থ আদায়, কখনো চাকরিতে ঘুষ দিতে হবে বলে অর্থ গ্রহন কিংবা আরও বহু পদ্ধতি অনুসরণ করে ঠিকই ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষ থেকে সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার সময় বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় । সামাজিক রীতির কারণে মেয়েকে যেন শ্বশুড় বাড়ীতে গিয়ে ছোট হয়ে থাকতে না হয় সেজন্য বাবা-মা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন তাদের সাধ্যমত মেয়ে-জামাইকে উপহার দিতে । উপহার হিসেবে কিছু দেয়া অন্যায় নয় কিন্তু এই উপহার যখন ছেলে পক্ষকে আরও বেশি কিছু পাওয়ার জন্য লোভী করে, উপহারের মান খারাপ হয়েছে কিংবা কিছু ঘাটতি রয়েছে বলে মেয়েকে কথা শুনতে হয় তখন সেটা আর উপহার না থেকে বরং যৌতুকের দিকেই নির্দেশ করে ।

অঘোষিত যৌতুক:---

কোরবানীর গরু, রমজানের গাড়ীভর্তি ইফতারী, রমজানের ঈদের কাপড় সেমাই চিনি, নুডলস,ইত্যাদি গাড়ী ভর্তি, সকল সিজনের জনের ফলা ফলাদি(কমপক্ষে একগাড়ী), ভাদ্রমাসের চিড়া মুড়ি গাড়ী ভর্তি, পৌষমাসের শীতের পিঠা গাড়ীভর্তি, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বস্ত্রবিতরন সম্পুর্ণ পরিবারের, পারিবারিক অনুষ্ঠানে সর্বচ্ছ উপহারের বাধ্যবাধকতা, ইত্যাদি ক।ম বেশীতে নেমে আসে মেয়ের শুশুর বাড়ীর গঞ্জনা।

যৌতুকের কুফল:---

 উল্লেখিত সমুদয় কারণে শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি । স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাটি রুপ নয় দাম্পত্য কলহে । নষ্ট হয় মধুরতম সম্পর্ক । শুরু হয় নির‌্যাতন । কখনো কখনো যৌতুকের বলি হতে হয় অগণন নারীকে । পত্রিকার পাতা কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় প্রত্যহ এরূপ অসংখ্য ঘটনার স্বাক্ষী হতে হয় আমাদেরকে । মনে ধিক্কার আসে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে তারপরেও আমাদের পরিবার থেকে উপহারের ছদ্মবেশী যৌতুক প্রথা বিদায় নেয় না । যৌতুকের সংজ্ঞা কিংবা এর অপরকারীতা প্রায় সকলের ঠোটস্থ থাকলেও প্রয়োগের সময় অর্থ আদায় ছাড়া কিছুই মনে থাকে না । বিবাহকেও বাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মতো আর্থিক লেনদেনে বিবেচনা করা হয় । অথচ যৌতুক দাম্পত্য জীবনে অসূখী করা এবং বিবাহ বিচ্ছেদের মত মারাত্মক ঘটনায় অন্যতম মূখ্য ভূমিকা পালন করে ।

    পবিত্র বন্ধনকে কলঙ্কিত করছে যৌতুক প্রথা। এই যৌতুক প্রথা সমাজে এখন এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে, যৌতুক ছাড়া বিয়ের কল্পনা করাও যেন বৃথা। সমাজ এটাকে ভীষণভাবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু কেন? মেয়ের জন্মলগ্ন থেকেই গরিব বাবা–মাকে যৌতুক নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয়। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়তই যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতনের অসংখ্য সংবাদ ছাপা হয়। নারী নির্যাতনের অন্যতম একটি কারণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ‘যৌতুক প্রথা’।

উপসংহার:-----

উপসংহারে বলতে চাই--নারী নির্যাতনকারী যৌতুকলোভী স্বামীর আইনি বিচারে জেল, জরিমানা কিংবা ফাঁসি হয়। এই রায় নারী নির্যাতন দমানোর ক্ষেত্রে ততটা কায্যকর কোন ভুমিকা রাখতে পারছেনা।যৌতুক বর্তমানে পারিবারিক সাংস্কৃতি ও মানসিক ব্যাপারে রুপ নিয়েছে। সার্বিক ভাবে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মননের পরিবর্তন না হলে এই প্রথা বিলুপ্ত হবে না। ফলে যৌতুক প্রথা বন্ধ করতে সমাজকে সচেতন করতে হবে। এ জন্য দরকার সরকারি,  বেসরকারি, এনজিও, সামাজিক সংস্থা সমুহের সমম্বিত উদ্যোগ। দেশের শিক্ষিত জনগোষ্টি, নতুন প্রজম্ম, সুশিল সমাজ, কবি,সাংবাদিক, সাহিত্যিক এগিয়ে না এলে এবং সমম্বিত নাগরিক উদ্যোগ নিতে না পারলে সমাজকে এর অভিসাপ থেকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না।
       ruhulaminmujumder27@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন