ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের মৃত্যু--তৃনমুল আওয়ামী লীগে বঞ্চনার শংকা প্রতিষ্ঠিত।
(রুহুল আমিন মজুমদার)
গত ৩/১২/০০১৬ ইং রোজ শনিবার বিকেল সাড়ে চার ঘটিকায় কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ফুল গাজী থানা পরবর্তীতে উপজেলার দুইবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আপোষহীন, ত্যাগী,নিবেদিত আওয়ামী লীগার হিসেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। যদিও দুইবার নির্বাচিত হন -রাজনৈতিক টানাপোড়নের কারনে প্রায় ২০০০ ইং সাল পয্যন্ত তাঁকে উক্ত সভাপতি পদ বহন করতে হয়েছিল।প্রায় বিশ বছর ফুলগাজী থানা আওয়ামী লীগের মায্যদাপুর্ণ সভাপতির দায়িত্ব পালন করলেও নির্লোভ নেতা কোন স্তরেই জনপ্রতিনীধিত্ব করার জন্য খুব বেশী বাড়াবাড়ি করেননি।গত শনিবার এই অকতোভয় বীর সেনানী ৭৮ বছর বয়সে ঢাকার শমরীতা হাসপাতালে পরলোকগমন করেন।তাঁকে তাঁর নীজবাড়ী ফুলগাজী উপজেলার মুন্সির হাট ইউনিয়নের শ্রিপুর গ্রামে কাজী পরিবারের নীজস্ব কবরস্থানে দাপন করা হয়।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম কাজী গোলাম মাহমুদ যে বছর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ঠিক সেই বছরই আমি সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হই। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল খুব অল্প বয়স হলেও নিবেদিত নেতার সাথে একত্রে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি আমার ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক থাকা অবস্থায় ঐ কমিটিরই সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে দু'টি গুরুত্বপুর্ণ পদ দীর্ঘবছর বহন করি। ঐ একই সময়কালে বসন্তপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব আমার উপর ছিল।পরবর্তী কাউন্সিলে 'দুই জন যুগ্ম সম্পাদকের' পদ সৃষ্টি হলে আমি এক নম্ভর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হই।উল্লেখ্য যে ফুলগাজীর মাটি ও মানুষের নেতা,উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জনাব আজিজুল হক মজুমদার ১৯৯৬ ইং সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার জন্য গেলে ফকিরা পুল আবাসিক হোটেল কক্ষে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর অকাল মৃত্যুতে ফুলগাজী বাসির উপর বিনামেঘে বজ্রাঘাত তুল্য, কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে পড়ে।চতুর্দিকে হতাশার চাদরে ঢেকে পড়লে সভাপতি কাজী গোলাম মাহমুদ শক্ত হাতে পরিস্থীতি নিয়ন্ত্রনে মনযোগী হন।
একদিকে ২১ বছরে দল ক্ষমতা পাওয়ায় সংগত কারনে নেতাকর্মীরা অসংযত,অধৈয্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জনাব আজিজুল হক মজুমদার সাহেবের হঠাৎ অনুপস্থীতি দলে বিশৃংখলা চরম আকার ধারন করে।এমনতর মহুর্তে পদাধিকার বলে আমাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক এর দায়িত্ব দিয়ে তিনি শক্তভাবে হাল ধরে বিশৃংখলা মোকাবেলা করার উদ্যোগ গ্রহন করেন।স্বল্প সময়ে রাজনৈতিক বিচক্ষনতার গুনে তিনি দলকে নিয়মাতান্ত্রিক পয্যায় নিয়ে আসেন। যদিও আমাকে তিনি সঙ্গী হিসেবে নিয়েছিলেন তের/ চৌদ্দটি মামলা এবং বসন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের গুরুত্বপুর্ণ পদে দায়িত্বরত: থাকায় আমি রানিংমেট হিসেবে তাঁকে তেমন উল্লেখযোগ্য সময় দিতে পারিনি।২০০০ ইং সালের কাউন্সিলে বাধ্যক্যজনীত কারনে তিনি সভাপতি পদ নীজ থেকে ত্যাগ করেন।২০০১ ইং সালের দলীয় বিপয্যয়ের মহুর্তে নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক পালিয়ে গেলে আবারও ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন দল পরিচালনায় সার্বিক সহযোগীতা পেয়েছিলাম আমি মরহুম জনাব কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের নিকট থেকে।২০০৯ ইং সাল পয্যন্ত যদিও আমি ফুলগাজীর রাজনীতিতে পুর্বের পদবি নিয়ে সক্রিয় ছিলাম কিন্তু যাদের নেতৃত্বে রাজনীতিতে ছিলাম তাঁদের দু'জনের কেউই ছিলেন না।
কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেব প্রথম জীবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারী কন্টিজেন্সে যোগদান করে স্বাধীনতা উত্তর চাকুরী পরিত্যাগ করে চট্রগ্রামে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঢামাডোল বেজে উঠলে তিনি তাঁর এলাকা ফুলগাজীর মুন্সির হাট চলে আসেন। এলাকার যুবক ভাইদের সংগঠিত করে আলী আজম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন এবং তিনি নিজেই প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মাতৃভুমি শত্রুমুক্ত করার মহান লক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসমসাহষিকতা এবং বিরত্বপুর্ণ অবদান এলাকাবাসি এখনও স্মরণ করেন।
তিনি যুদ্ধশেষে কর্মস্থল চট্রগ্রাম চলে গেলেও তাঁর মন সেখানে স্থীত হয়নি। তিনি ফিরে এসে ফুলগাজী উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘদিন ফুলগাজীতে শিক্ষকতার সুবাদে সর্বশ্রেনীর মানুষের নিকট সৎ, ব্যাক্তিত্বশীল, মায্যদাবান মানুষ হিসেবে তাঁর ইমেজ গড়ে উঠে।পরবর্তীতে তাঁর এলাকার আলী আজম হাইস্কুলে চলে গেলেও ফুলগাজী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ অলংকৃত করতে তাঁকে তেমন বেগ পেতে হয়নি।
তিনি ছিলেন অত্যান্ত ব্যাক্তিত্ববান, স্বল্পবাসি, অসাধারন বাগ্মিতার অধিকারি ত্যাগি নেতা। খালেদা জিয়ার কথিত বাড়ীর দরজায় উপজেলা আওয়ামী লীগের একটানা বিশ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সহজ ব্যাপার নয়।তিনি উক্ত কঠিন বিষয়টিকে ব্যাক্তিত্বের প্রভাবে সহজ করেছিলেন এবং সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তিলে তিলে সংসার, অর্থ সম্পদ ধ্বংস করে যেই সমস্ত নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের পতাকাকে আগামী প্রজম্মের হাতে তুলে দিতে নিবেদিত ছিলেন, সারাজীবন আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ আজ আর জীবিত নেই। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য---'সর্বজনাব আজিজুল হক মজুমদার(চেয়ারম্যান, সাধারন সম্পাদক),আজিজুল হক(ছোট্র মিয়া,ভেন্ডার,ফুলগাজী),সফিকুর রহমান ভুইয়া(ভেন্ডার, মুন্সির হাট) আবুল মজুমদার(ফুলগাজী, শ্রিপুর, খালেদা জিয়ার কথিত বাড়ীর একমাত্র আওয়ামী পরিবার) আবুল কালাম আজাদ (হাজী হুদামিয়া,ফুলগাজী), আবুল মিয়া(ফুলগাজী,বরইয়া) বিষু চৌধুরী( ফুলগাজী, বরইয়া) হাজী ইব্রাহীম মজুমদার ( চেয়ারম্যান, আমজাদ হাট), মোশারফ হোসেন মজুমদার (আমজাদ হাট) মোশারফ হোসেন মজুমদার( ফুলগাজী), ডাক্তার আফাজ উদ্দিন মজুমদার (আমজাদ হাট) আবদুল মন্নান( দরবার পুর) সামছু উদ্দিন মজুমদার( চেয়ারম্যান বক্সমাহমুদ)সহ আরো অনেকেই চলে গেছেন পরপারে।
জীবিতদের মধ্যে তেমন কাউকে আজ আর চোখে পড়েনা। নাইয়ের মধ্যে সর্বজনাব আজিজ আহাম্মদ চৌধুরী (বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) হাবিবুর রহমান মজুমদার (সাবেক সভাপতি, আনন্দপুর, বন্ধুয়া, ভেন্ডার) আবদুল মন্নান ভুঁইয়া (বক্সমাহমুদ) হাবিলদার জহির উদ্দিন ভুইয়া(সভাপতি, জিএম হাট) রুহুল আমিন মজুমদার( সাবেক সভাপতি, ফুলগাজী থানা), আবুল কাশেম মাষ্টার( চেয়ারম্যান, আমজাদ হাট) দুলাল মজুমদার(সাবেক সাধারন সম্পাদক, আনন্দপুর ইউনিয়ন) কাজী গিয়াস উদ্দিন ( সভাপতি, দরবারপুর) আবদুস ছালাম ভুঁইয়া(সাবেক সাধারন সম্পাদক, ফুলগাজী থানা)হাজী জামাল উদ্দিন ( বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ফুলগাজী থানা) সবার চেয়ে কম বয়সের মাষ্টার রুহুল আমিন মজুমদার এখনও বেঁচে আছেন।
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, নিশ্চয়ই আপনাদেরকে অযথা বিরক্ত করছি--'মনের জ্বালা নিবারনের গত্যান্তর খুঁজে না পেয়ে অদ্য আপনাদের বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছি।' উপরে উল্লেখিত জীবিত এবং মৃত সম্মানিত ব্যাক্তিবর্গ সহ আরো অনেকেই জনাব মরহুম কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের একান্ত রাজনৈতিক বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন।শুধু সহচর বললে আংশিক বলা হয় ; দীর্ঘদিনের আন্দোলনে সংগ্রামে জড়িত থেকে একে অপরের পুরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন।দলীয় গণ্ডির সীমারেখা অতিক্রম করে ব্যাক্তিগত এবং পারিবারিক বন্ধুত্বে রুপ নিয়েছিল উল্লেখিত ব্যাক্তিবর্গের মধ্যে।
"মরহুম কাজী গোলাম মহামুদ সেনাবাহিনীতে দশবছর চাকুরীর কারনে একদল চৌকস সেনাদল 'মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকের জানাজা পুর্ব গার্ড অব অনার দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করেছেন।' মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন স্বীকৃতি স্বরুপ একদল পুলিশ গর্ড় অব অনার প্রদান করে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের পর সমাহিত করে। ফুলগাজী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কারনে স্বরণ সভার আয়োজন করেছে।শেষ কর্ম স্থল আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজ সৃতিচারন সভার আয়োজন করে তাঁর বনাঢ্য কর্মজীবন নিয়ে আলোকপাত করার উদ্যোগ গ্রহন করেছেন।"
"মরহুম জনাব কাজী গোলাম গোলাম মাহমুদের জানাজায় সর্বস্তরের শিক্ষক,ছাত্রছাত্রী, আত্মীয়স্বজন উপস্থীত থেকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নয়মাস যুদ্ধের ময়দানে সাথীদের সঙ্গদানের প্রতিদানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা এবং থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল জানাজা পুর্ব নেতৃত্ব প্রদান করে জনগনের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়েছেন।"
অত্যান্ত পরিতাপের বিষয়, সকল একত্রিত লাভজনক পেশার চেয়ে দীর্ঘতম সময় (প্রায় পয়তাল্লিশ বছর)যে কাজে নিয়োজিত ছিলেন, যে আদর্শ ধারন করে সোনালী দিনগুলী হেলায় হারিয়েছেন, অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁদের সম্মান শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন, যাদের সাথে কর্মজীবনের বেশীরভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন ; সেই মুজিব আদর্শের উধ্বতন নেতা একমাত্র জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ফেনী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আবদুর রহমান (বিকম) ছাড়া আর কোন উল্লেখযোগ্য নেতাকে জানাজায় উপস্থীত দেখা যায়নি।হাজার হাজার মানুষের উপস্থীতির মধ্যেও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থীতির হার ছিল অত্যান্ত নগন্য, মাত্র হাতে গোনা কয়জন।
তাঁর রাজনীতির বিচরন ভুমি ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হয়তো স্মৃতি চারণ মূলক সভার আয়োজন করা হবেনা। অতীতের প্রতিতযসা অনেকের মৃত্যুতে যেহেতু কোন স্বরণসভার আয়োজন করা হয়নি; মরহুম কাজী গোলাম মাহমুদের ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হবে বলে মনে হয়না।যদিও দীর্ঘতম সময় বিনাবেতনে,পরিবার পরিজন বিমুখ করে মুজিব আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আওয়ামী লীগ সংগঠনে শ্রম মেধা, অর্থ সম্পদ, মুল্যবান সময় সবকিছুই উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন। সেই প্রানের সংগঠন যদি একটা স্মৃতিচারন সভার আয়োজনও না করে--এর চেয়ে বড় দু:খ্যজনক ঘটনা তাঁর পরিবার,ভক্ত অনুরাগীদের জন্যে আর কি হতে পারে। প্রসিদ্ধ ব্যাক্তিবর্গের বেলায় এমন অনিহা পোষন করা হলে ; আমাদের ন্যায় যৎসামান্য অবদান রাখা মুজিব প্রেমিকদের বেলায় জানাজায়ও কেউ অংশ নিতে আসবেন না।
"এমন হওয়ারতো কথা ছিলনা- দলের শীর্ষনেতা বিবৃতি দিয়ে শোক প্রকাশ করার কথা ছিল তদস্থলে আঞ্চলিক নেতারাও যদি শোক প্রকাশ না করেন, বিবৃতি না দেন -এই দু:খ্য কি তাঁর পরিবার, বন্ধুমহল,শুভাকাংখীরা ভুলতে পারবে?"
আমি মহান শিক্ষাগুরু, মুজিবাদর্শের লড়াকু সৈনিক কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে দেশব্যাপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আদর্শবান, ত্যাগি, মুজিবাদর্শের প্রকৃত সৈনিক, সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের--'বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার আকুল আবেদন জানাচ্ছি।'
ruhulaminmujumder27@gmail.com
"জয়বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু"
(রুহুল আমিন মজুমদার)
গত ৩/১২/০০১৬ ইং রোজ শনিবার বিকেল সাড়ে চার ঘটিকায় কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ফুল গাজী থানা পরবর্তীতে উপজেলার দুইবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আপোষহীন, ত্যাগী,নিবেদিত আওয়ামী লীগার হিসেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। যদিও দুইবার নির্বাচিত হন -রাজনৈতিক টানাপোড়নের কারনে প্রায় ২০০০ ইং সাল পয্যন্ত তাঁকে উক্ত সভাপতি পদ বহন করতে হয়েছিল।প্রায় বিশ বছর ফুলগাজী থানা আওয়ামী লীগের মায্যদাপুর্ণ সভাপতির দায়িত্ব পালন করলেও নির্লোভ নেতা কোন স্তরেই জনপ্রতিনীধিত্ব করার জন্য খুব বেশী বাড়াবাড়ি করেননি।গত শনিবার এই অকতোভয় বীর সেনানী ৭৮ বছর বয়সে ঢাকার শমরীতা হাসপাতালে পরলোকগমন করেন।তাঁকে তাঁর নীজবাড়ী ফুলগাজী উপজেলার মুন্সির হাট ইউনিয়নের শ্রিপুর গ্রামে কাজী পরিবারের নীজস্ব কবরস্থানে দাপন করা হয়।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম কাজী গোলাম মাহমুদ যে বছর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ঠিক সেই বছরই আমি সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হই। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল খুব অল্প বয়স হলেও নিবেদিত নেতার সাথে একত্রে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি আমার ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক থাকা অবস্থায় ঐ কমিটিরই সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে দু'টি গুরুত্বপুর্ণ পদ দীর্ঘবছর বহন করি। ঐ একই সময়কালে বসন্তপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব আমার উপর ছিল।পরবর্তী কাউন্সিলে 'দুই জন যুগ্ম সম্পাদকের' পদ সৃষ্টি হলে আমি এক নম্ভর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হই।উল্লেখ্য যে ফুলগাজীর মাটি ও মানুষের নেতা,উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জনাব আজিজুল হক মজুমদার ১৯৯৬ ইং সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার জন্য গেলে ফকিরা পুল আবাসিক হোটেল কক্ষে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর অকাল মৃত্যুতে ফুলগাজী বাসির উপর বিনামেঘে বজ্রাঘাত তুল্য, কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে পড়ে।চতুর্দিকে হতাশার চাদরে ঢেকে পড়লে সভাপতি কাজী গোলাম মাহমুদ শক্ত হাতে পরিস্থীতি নিয়ন্ত্রনে মনযোগী হন।
একদিকে ২১ বছরে দল ক্ষমতা পাওয়ায় সংগত কারনে নেতাকর্মীরা অসংযত,অধৈয্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জনাব আজিজুল হক মজুমদার সাহেবের হঠাৎ অনুপস্থীতি দলে বিশৃংখলা চরম আকার ধারন করে।এমনতর মহুর্তে পদাধিকার বলে আমাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক এর দায়িত্ব দিয়ে তিনি শক্তভাবে হাল ধরে বিশৃংখলা মোকাবেলা করার উদ্যোগ গ্রহন করেন।স্বল্প সময়ে রাজনৈতিক বিচক্ষনতার গুনে তিনি দলকে নিয়মাতান্ত্রিক পয্যায় নিয়ে আসেন। যদিও আমাকে তিনি সঙ্গী হিসেবে নিয়েছিলেন তের/ চৌদ্দটি মামলা এবং বসন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের গুরুত্বপুর্ণ পদে দায়িত্বরত: থাকায় আমি রানিংমেট হিসেবে তাঁকে তেমন উল্লেখযোগ্য সময় দিতে পারিনি।২০০০ ইং সালের কাউন্সিলে বাধ্যক্যজনীত কারনে তিনি সভাপতি পদ নীজ থেকে ত্যাগ করেন।২০০১ ইং সালের দলীয় বিপয্যয়ের মহুর্তে নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক পালিয়ে গেলে আবারও ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন দল পরিচালনায় সার্বিক সহযোগীতা পেয়েছিলাম আমি মরহুম জনাব কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের নিকট থেকে।২০০৯ ইং সাল পয্যন্ত যদিও আমি ফুলগাজীর রাজনীতিতে পুর্বের পদবি নিয়ে সক্রিয় ছিলাম কিন্তু যাদের নেতৃত্বে রাজনীতিতে ছিলাম তাঁদের দু'জনের কেউই ছিলেন না।
কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেব প্রথম জীবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারী কন্টিজেন্সে যোগদান করে স্বাধীনতা উত্তর চাকুরী পরিত্যাগ করে চট্রগ্রামে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঢামাডোল বেজে উঠলে তিনি তাঁর এলাকা ফুলগাজীর মুন্সির হাট চলে আসেন। এলাকার যুবক ভাইদের সংগঠিত করে আলী আজম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন এবং তিনি নিজেই প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মাতৃভুমি শত্রুমুক্ত করার মহান লক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসমসাহষিকতা এবং বিরত্বপুর্ণ অবদান এলাকাবাসি এখনও স্মরণ করেন।
তিনি যুদ্ধশেষে কর্মস্থল চট্রগ্রাম চলে গেলেও তাঁর মন সেখানে স্থীত হয়নি। তিনি ফিরে এসে ফুলগাজী উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘদিন ফুলগাজীতে শিক্ষকতার সুবাদে সর্বশ্রেনীর মানুষের নিকট সৎ, ব্যাক্তিত্বশীল, মায্যদাবান মানুষ হিসেবে তাঁর ইমেজ গড়ে উঠে।পরবর্তীতে তাঁর এলাকার আলী আজম হাইস্কুলে চলে গেলেও ফুলগাজী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ অলংকৃত করতে তাঁকে তেমন বেগ পেতে হয়নি।
তিনি ছিলেন অত্যান্ত ব্যাক্তিত্ববান, স্বল্পবাসি, অসাধারন বাগ্মিতার অধিকারি ত্যাগি নেতা। খালেদা জিয়ার কথিত বাড়ীর দরজায় উপজেলা আওয়ামী লীগের একটানা বিশ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সহজ ব্যাপার নয়।তিনি উক্ত কঠিন বিষয়টিকে ব্যাক্তিত্বের প্রভাবে সহজ করেছিলেন এবং সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তিলে তিলে সংসার, অর্থ সম্পদ ধ্বংস করে যেই সমস্ত নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের পতাকাকে আগামী প্রজম্মের হাতে তুলে দিতে নিবেদিত ছিলেন, সারাজীবন আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ আজ আর জীবিত নেই। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য---'সর্বজনাব আজিজুল হক মজুমদার(চেয়ারম্যান, সাধারন সম্পাদক),আজিজুল হক(ছোট্র মিয়া,ভেন্ডার,ফুলগাজী),সফিকুর রহমান ভুইয়া(ভেন্ডার, মুন্সির হাট) আবুল মজুমদার(ফুলগাজী, শ্রিপুর, খালেদা জিয়ার কথিত বাড়ীর একমাত্র আওয়ামী পরিবার) আবুল কালাম আজাদ (হাজী হুদামিয়া,ফুলগাজী), আবুল মিয়া(ফুলগাজী,বরইয়া) বিষু চৌধুরী( ফুলগাজী, বরইয়া) হাজী ইব্রাহীম মজুমদার ( চেয়ারম্যান, আমজাদ হাট), মোশারফ হোসেন মজুমদার (আমজাদ হাট) মোশারফ হোসেন মজুমদার( ফুলগাজী), ডাক্তার আফাজ উদ্দিন মজুমদার (আমজাদ হাট) আবদুল মন্নান( দরবার পুর) সামছু উদ্দিন মজুমদার( চেয়ারম্যান বক্সমাহমুদ)সহ আরো অনেকেই চলে গেছেন পরপারে।
জীবিতদের মধ্যে তেমন কাউকে আজ আর চোখে পড়েনা। নাইয়ের মধ্যে সর্বজনাব আজিজ আহাম্মদ চৌধুরী (বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান) হাবিবুর রহমান মজুমদার (সাবেক সভাপতি, আনন্দপুর, বন্ধুয়া, ভেন্ডার) আবদুল মন্নান ভুঁইয়া (বক্সমাহমুদ) হাবিলদার জহির উদ্দিন ভুইয়া(সভাপতি, জিএম হাট) রুহুল আমিন মজুমদার( সাবেক সভাপতি, ফুলগাজী থানা), আবুল কাশেম মাষ্টার( চেয়ারম্যান, আমজাদ হাট) দুলাল মজুমদার(সাবেক সাধারন সম্পাদক, আনন্দপুর ইউনিয়ন) কাজী গিয়াস উদ্দিন ( সভাপতি, দরবারপুর) আবদুস ছালাম ভুঁইয়া(সাবেক সাধারন সম্পাদক, ফুলগাজী থানা)হাজী জামাল উদ্দিন ( বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ফুলগাজী থানা) সবার চেয়ে কম বয়সের মাষ্টার রুহুল আমিন মজুমদার এখনও বেঁচে আছেন।
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, নিশ্চয়ই আপনাদেরকে অযথা বিরক্ত করছি--'মনের জ্বালা নিবারনের গত্যান্তর খুঁজে না পেয়ে অদ্য আপনাদের বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছি।' উপরে উল্লেখিত জীবিত এবং মৃত সম্মানিত ব্যাক্তিবর্গ সহ আরো অনেকেই জনাব মরহুম কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের একান্ত রাজনৈতিক বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন।শুধু সহচর বললে আংশিক বলা হয় ; দীর্ঘদিনের আন্দোলনে সংগ্রামে জড়িত থেকে একে অপরের পুরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন।দলীয় গণ্ডির সীমারেখা অতিক্রম করে ব্যাক্তিগত এবং পারিবারিক বন্ধুত্বে রুপ নিয়েছিল উল্লেখিত ব্যাক্তিবর্গের মধ্যে।
"মরহুম কাজী গোলাম মহামুদ সেনাবাহিনীতে দশবছর চাকুরীর কারনে একদল চৌকস সেনাদল 'মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকের জানাজা পুর্ব গার্ড অব অনার দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করেছেন।' মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন স্বীকৃতি স্বরুপ একদল পুলিশ গর্ড় অব অনার প্রদান করে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের পর সমাহিত করে। ফুলগাজী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কারনে স্বরণ সভার আয়োজন করেছে।শেষ কর্ম স্থল আলী আজম স্কুল এন্ড কলেজ সৃতিচারন সভার আয়োজন করে তাঁর বনাঢ্য কর্মজীবন নিয়ে আলোকপাত করার উদ্যোগ গ্রহন করেছেন।"
"মরহুম জনাব কাজী গোলাম গোলাম মাহমুদের জানাজায় সর্বস্তরের শিক্ষক,ছাত্রছাত্রী, আত্মীয়স্বজন উপস্থীত থেকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নয়মাস যুদ্ধের ময়দানে সাথীদের সঙ্গদানের প্রতিদানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা এবং থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল জানাজা পুর্ব নেতৃত্ব প্রদান করে জনগনের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়েছেন।"
অত্যান্ত পরিতাপের বিষয়, সকল একত্রিত লাভজনক পেশার চেয়ে দীর্ঘতম সময় (প্রায় পয়তাল্লিশ বছর)যে কাজে নিয়োজিত ছিলেন, যে আদর্শ ধারন করে সোনালী দিনগুলী হেলায় হারিয়েছেন, অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁদের সম্মান শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন, যাদের সাথে কর্মজীবনের বেশীরভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন ; সেই মুজিব আদর্শের উধ্বতন নেতা একমাত্র জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ফেনী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আবদুর রহমান (বিকম) ছাড়া আর কোন উল্লেখযোগ্য নেতাকে জানাজায় উপস্থীত দেখা যায়নি।হাজার হাজার মানুষের উপস্থীতির মধ্যেও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থীতির হার ছিল অত্যান্ত নগন্য, মাত্র হাতে গোনা কয়জন।
তাঁর রাজনীতির বিচরন ভুমি ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হয়তো স্মৃতি চারণ মূলক সভার আয়োজন করা হবেনা। অতীতের প্রতিতযসা অনেকের মৃত্যুতে যেহেতু কোন স্বরণসভার আয়োজন করা হয়নি; মরহুম কাজী গোলাম মাহমুদের ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হবে বলে মনে হয়না।যদিও দীর্ঘতম সময় বিনাবেতনে,পরিবার পরিজন বিমুখ করে মুজিব আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আওয়ামী লীগ সংগঠনে শ্রম মেধা, অর্থ সম্পদ, মুল্যবান সময় সবকিছুই উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন। সেই প্রানের সংগঠন যদি একটা স্মৃতিচারন সভার আয়োজনও না করে--এর চেয়ে বড় দু:খ্যজনক ঘটনা তাঁর পরিবার,ভক্ত অনুরাগীদের জন্যে আর কি হতে পারে। প্রসিদ্ধ ব্যাক্তিবর্গের বেলায় এমন অনিহা পোষন করা হলে ; আমাদের ন্যায় যৎসামান্য অবদান রাখা মুজিব প্রেমিকদের বেলায় জানাজায়ও কেউ অংশ নিতে আসবেন না।
"এমন হওয়ারতো কথা ছিলনা- দলের শীর্ষনেতা বিবৃতি দিয়ে শোক প্রকাশ করার কথা ছিল তদস্থলে আঞ্চলিক নেতারাও যদি শোক প্রকাশ না করেন, বিবৃতি না দেন -এই দু:খ্য কি তাঁর পরিবার, বন্ধুমহল,শুভাকাংখীরা ভুলতে পারবে?"
আমি মহান শিক্ষাগুরু, মুজিবাদর্শের লড়াকু সৈনিক কাজী গোলাম মাহমুদ সাহেবের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে দেশব্যাপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আদর্শবান, ত্যাগি, মুজিবাদর্শের প্রকৃত সৈনিক, সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের--'বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার আকুল আবেদন জানাচ্ছি।'
ruhulaminmujumder27@gmail.com
"জয়বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন