আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, শিক্ষা মন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের উক্তি---"জাতির জনকের অ-সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দর্শন"।
     (রুহুল  আমিন  মজুমদার)

        গত ৩১/১২/২০১৬ ইং তারিখে একটি কলাম লিখেছিলাম--কলামটির শিরোনাম ছিল--"শেখ হাছিনার বর্তমানে বাংলাদেশ দর্শনের ধারনা পরিস্কার হওয়া উচিৎ।"অর্থাৎ আমি বলতে চেয়েছিলাম--"বাংলাদেশ যে তত্বের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ ইং সালে সে তত্ব জনগনের নিকট সঠিকভাবে, আওয়ামীলীগ, সরকার সকল পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে জনগনের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছেনা। "ফলে রাষ্ট্রের আমলা, সরকারের মন্ত্রী, দলের নেতা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একান্ত অনুগত ব্যাক্তিবর্গের বক্তৃতা, বিবৃতি,আচার আচরন, সরকারের গুরুত্বপুর্ণ নীতি নির্ধারনী বিষয়ে বৈপরিত্য সর্বসময়ে লক্ষনীয়ভাবে দৃষ্টিগোচর হতে দেখা যায়।ঘটনাক্রমে সেই কলামটি গতকালও ১০/১২/২০১৭ ইং তারিখে 'ওয়েব সাইট' থেকে পূর্ণ:বার পোষ্ট করেছিলাম। গতকাল শিক্ষামন্ত্রী কাকতালীয়ভাবে সাংবাদিক সম্মেলনে উল্লেখিত বৈপরিত্যের তেমনি এক দৃষ্টান্তের পূন:রাবৃত্তি ঘটিয়েছেন।
           পাঠ্যবইয়ের মুদ্রন জনীত ত্রুটি, শব্দ সংযোজনে গাফিলতি, বানানের ভুল, প্রচ্ছদ অংকনে অবহেলা ইত্যাদি হতেই পারে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, কর্মচারি সবাই দায়িত্বের প্রতি সমান মনযোগী নয়, সরকারের নীতি আদর্শ বিরুধী কর্মকর্তা কর্মচারিও থাকা অস্বাভাবিক নয়। ইচ্ছা-অনিচ্ছাহেতু বা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্যেও অনাকাংখিত ভুলক্রুটি কোন পক্ষ হ'তে করতে পারে। কিন্তু বিষয় বস্তুতে কি ভুল হ'তে পারে? সরকারের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতে কোন মন্ত্রনালয় বা মন্ত্রীর অবস্থান থাকতে পারে এমননতর ঘটনা বিশ্বের কোন সরকারের রাজকর্মচারি, মন্ত্রী পয্যায়ে, নিতিনির্ধারনী ক্ষেত্রে আদৌ কখনও ঘটেছে? "বিষয়বস্তু অর্থই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় "দর্শন"-- "তাই নহে কি !!"
     এবারকার পাঠ্যবই চাপানোর কাজে নিয়োজিত শিক্ষা মন্ত্রনালয় এবং তাঁর অধিনস্ত দফতর সমুহ তাই করেছে।মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়  পাঠ্যবইয়ের কিছু বিষয়বস্তুর পরিবর্তন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন--“দেশ, জাতি, মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আমাদের চিন্তা সব কিছু বিবেচনায় রেখেই আমাদের তৈরি করতে হয়। তাতে কোনো সময় পাল্লা এদিক-ওদিক হতেই পারে, সমালোচনা থাকতে পারে, আমরা সেগুলোও বিবেচনায় নেই।"
       সদাশয় সরকারের মুল উদ্দেশ্য এবং 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের''৭৫ পরবর্তী নিয়ন্তর আন্দোলন সংগ্রাম, সর্বশেষ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করা বা বাংলাদেশ দর্শন রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে জাতির জনকের স্বপ্নের সুখী, সসমৃদ্ধশালী, আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। '৭৫ পরবর্তী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সাম্প্রদায়িক গোষ্টি, অগনতান্ত্রিক সামরিক সরকার সমুহ বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্নের লিখিত দলিল '৭২ এর সংবিধানকে কবর দিয়ে প্রগতির চাকাকে যতটুকু পিছনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল;সেখান থেকে জাতির জনকের প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর আদর্শে পরিপুষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূজারি, বাংলাদেশ দর্শনের ধারক ও বাহক 'বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ' কতৃক গঠিত সরকার ধীরে হলেও জাতিকে টেনে নিয়ে আসবে, জাতিকে প্রগতির ধারায় প্রতিস্থাপন করার নিয়ন্তর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

      প্রজম্ম জানে দীর্ঘ বছর প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক  চক্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাষনে একতরফা অপ-প্রচারে জাতির মেধা ও মননে সত্যিকার অর্থে পঁচন ধরেছে।এর অর্থ এই নয়--"সেই পঁছনকে অক্ষত রেখে, প্রজম্মকে সত্যিকারের ইতিহাস, আধুনিক শিক্ষা, প্রগতির ধ্যান ধারনা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, লিঙ্গ বৈশম্য দুরিকরনে উপযুক্ত শিক্ষা থেকে যুগের পর যুগ বঞ্চিত রাখতে হবে।"

        জাতির মেধা ও মননে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক ধ্যানধারনা জাগরুক করার উপযুক্ত ক্ষেত্র অবশ্যাম্ভাবী দেশের 'শিক্ষা ব্যবস্থা।' শিক্ষাব্যাবস্থার বিষয় বস্তু নির্ধারনে যদি বাংলাদেশ সৃষ্টির 'মুল থিম' উপেক্ষিত থাকে বা নীতিনির্ধারক পয্যায় থেকে ইচ্ছাকৃত ধোঁয়াসার আবরনে ঢেকে রাখার প্রানান্তকর চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, কর্মচারি, দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সরকারের নীতি নির্ধারনী পয্যায়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়াবলির সিদ্ধান্ত গ্রহনে নিয়মিত বৈপরিত্য পরিলক্ষিত হওয়া অত্যান্ত স্বাভাবিক। '৭৫ পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবদি হচ্ছেও তাই।

বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সরকার দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরও 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' শুধুমাত্র আওয়ামী ঘরনার "দর্শন" নয়, ইহা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার "মুলমন্ত্র" আপামর জনগনের "মুক্তি"' এবং "মহান স্বাধীনতার" একমাত্র 'দর্শন'--ইহা কি, কেন প্রয়োজন --"বুঝাতে সক্ষম হয়নি।" তাই দেখা যায় যখনই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকার বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ আসে তখনই একশ্রেনীর মানুষ (মগজ ধোলাই করা) বলতে থাকে সর্বত্র "আওয়ামীকরন" করা হচ্ছে।মুলত: "আওয়ামী করন নয়--"সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন।
"জম্মকে যে অস্বিকার করে তাঁকে আমরা সাধারন ভাবে বলি "বেজম্মা" বা "অবৈধ সন্তান"। জম্মদাতার সম্পত্তিতে 'বেজম্মা সন্তান বা অবৈধ সন্তানের' কোন অধিকার কোন সমাজে বা রাষ্ট্রে আইন সিদ্ধ নয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির দর্শন অস্বিকার করার অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশকে অস্বিকার করা। ,বাংলাদেশ অস্বিকারকারি কোন ব্যাক্তি, দল, গোষ্টি বাংলাদেশে রাজনীতি করার, সরকার পরিচালনা করার, রাষ্ট্রীয় সুযোগ গ্রহনের কোন আইনগত, নৈতিক ভিত্তি থাকেনা। বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত কোন রাষ্ট্রেই দ্বিমূখি বা মিশ্র দর্শন ধারন করে বা দর্শন বিষয়ে জনগনকে ধোঁয়াশায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়না, বাংলাদেশেও ব্যাতিক্রম দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারেনা।
দু:খ্যজনক হলেও সত্য উল্লেখীত কারনে--"স্বাধীনতা লাভের এতকাল পরেও রাষ্ট্রের অন্যান্ন সকল বিষয় সাময়িক বা স্থায়ী নীতি প্রনয়ন করা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট অস্থায়ী বা স্থায়ী নীতি রাষ্ট্র স্থীর করতে পারেনি।"অথছ সর্বমহল থেকে হরহামেশাই বলতে শুনা যায়-"শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড" আপ্তবাক্যটি। ইসলামী রাষ্ট্রের পিতৃভুমি খোদ 'সৌদী আরবে'ও জাতির জনক "ইবনে আল-সৌদ" এর নামের উপর ভিত্তি করে সৌদী আরব এবং তাঁর লালিত দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় শিক্ষা বিষয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি "ধর্মীয় জ্ঞান" অর্জনের জন্যেও উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা রয়েছে।
       অন্যসকল দল ও তাঁদের গঠিত সরকারের সামনে জাতিকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্যকোন আদর্শ বা উদ্দেশ্য নেই বা ছিলনা। সুতারাং তাঁদের নিকট দল পরিচালনার আদর্শ উদ্দেশ্য এবং রাষ্ট্র পরিচালনার  নীতি-কৌশল খোঁজ করা বাতুলতা মাত্র। তাঁদের যতসব  ভয়ের কারন আধুনিক, যুগ উপযোগী শিক্ষার আলো।জাতিকে বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থায় আধুনিক যুগোপযোগী বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার পদক্ষেপ নিতে গেলে বরাবরই তাঁদের ষড়যন্ত্রের মাত্রা দ্বিগুন বেড়ে সহিংসতায় রুপ নিতে দেখা যায়।তাঁদের ভয়ে কি 'বাংলাদেশ দর্শনের' মুলভিত্তির চারিত্রিক পরিবর্তন মেনে নিতে হবে ?
      বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারি দল কতৃক গঠিত সরকার। তাঁরচেয়েও বড়কথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকেরই জৈষ্ঠকন্যা।তাঁর বর্তমানেই যদি জাতি গঠনের "মূল হাতিয়া"রে "বঙ্গবন্ধুর আদর্শচ্যুতি" দেখা যায়-- 'তাঁর অবর্তমানে জাতি কি আশা করতে পারে'। '৭৫ এর পর স্বল্প পরিসরে হোক বা বর্তমান সময়ে বৃহত্তর পরিসরে হোক--"বঙ্গবন্ধুর ইন্দ্রজালিক নেতৃত্ব, আদর্শ, উদ্দেশ্য, সংগ্রামের উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দল পরিচালনা করতে দেখা গেছে।বঙ্গবন্ধুর ভূবনজয়ী ঐতিহাসিক ভাষন বাজিয়ে অদ্যাবদি ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার কৌশল খোঁজে নিতে দেখা গেছে।জাতির জনকের দীর্ঘ সংগ্রাম, আরাধ্য কামনার ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ বিধায়--''জাতি ক্ষনে ক্ষনে আবেগ আপ্লুত হতে দেখা যায়'। জনগনের সেই আবেগকে পুঁজি করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে ক্ষমতার মসনদ পাকাপাকি করার পর--'জনগনের সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট বাংলাদেশে, তাঁর আদর্শকে ঘিরে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করার অপরনাম--"জনগনের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রতারণা নয় কি"?
      বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামে যেই সমস্ত প্রতিশ্রুতি জাতিকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, যে সমস্ত অঙ্গিকারের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, অঙ্গিকার পূরণার্থে জাতির সামনে মুক্তিযুদ্ধ  অনিবায্য হয়ে উঠেছিল--"মুক্তিযুদ্ধের সেই সমস্ত অঙ্গিকারকেই-তো বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।" অদ্যাবদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র কথা বলেই  জাতিকে আবেগ আপ্লুত করে অতীত স্মৃতির সাগরে ডুবিয়ে 'বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ' আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করতে হয়েছে।বাংলাদেশের জনগনও বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারনকারি এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একমাত্র উত্তরাধিকারী রাজনৈতিক দল "বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।" জনগনের সেই পাহাড়সম আস্থা, বিশ্বাসের কারনে শতষড়যন্ত্র উপেক্ষা করেও আওয়ামী লীগকে বারবার "রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে ক্ষমতার বৃত্তে ফিরিয়ে আনতে দেখা যায়। জাতিরজনকের "দর্শন" অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বলিয়ান, লিঙ্গ বৈশম্যহীন, জাতিগত বৈশম্যহীন, সুখী, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক, গনতান্ত্রিক সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মানের লক্ষে তাঁর জৈষ্ঠকন্যার ডাকে বারবার রাজপথে তাজারক্ত ঢেলে দিতে বাঙ্গালী কোন প্রয়োজনীয় সময় কোনদিনও কুণ্ঠাবোধ করেনি, জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের জনগন,তথা বাঙ্গালী জাতি।"
 
বর্তমান বাংলাদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ , উদ্দেশ্য, অবস্থান নীতি থেকে দিন দিন কেমন যেন  দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁর যথাযথ প্রমান পাওয়া যায় অনেকের মতে অধিকতর প্রগতিশীল ঘরনার "শিক্ষামন্ত্রী জনাব নাহিদ সাহেব-"মুক্তিযুদ্ধের মুল্যবোধের কথা না বলে 'ধর্মীয় মুল্যবোধে'র কথা বলেন, তবে আর ত্রিশলক্ষ শহিদের, তিনলক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের আদর্শ "বাংলাদেশ দর্শন" তথা মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকার অস্বীকারের বাকী আর রইল কোথায়? বঙ্গবন্ধুর দর্শন, বাংলাদেশ দর্শন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার অঙ্গিকার যা-ই বলিনা কেন সব-ই মুদ্রার এপিট আর ওপিট।
বাংলাদেশ থাকবে, বাংলাদেশ শাষনের জন্য সরকার থাকবে, সেই সরকারে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থাকবে। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষন সময় সময় প্রচার হবে, জাতি দু:খ্যের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে তাঁর প্রয়ান দিবস ১৫ই আগষ্ট যথাযোগ্য মায্যদায়, ভাবগম্ভীর পরিবেশে, এতিম মিশকিনদের গরু জবাই করে খাওয়াবে(নিজের বাবা-মায়ের জন্যেও যাহা অনেকেই করেনা)। মহান আল্লাহর নিকট তাঁর আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করে মসজিদে, মন্দিরে, প্যাগোড়ায় বিশেষ প্রার্থনা করবে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস যথাযোগ্য মায্যদায় যথারীতি নিয়মিত পালন করবে। জাতির জনকের বনাঢ্য সংগ্রামী জীবন আলোচনা করে নেতাকর্মী, জাতিকে উজ্জিবীত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুধীতাকারি রাজাকার আলবদরদের বিচার চলমান রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস, জীবনহানীর মত চরম মুল্য পরিশোধে জাতি কূন্ঠিত হবেনা। মানবতাবিরুধী বিচারে সাজাপ্রাপ্তদের বিচারের রায় কায্যকর প্রশ্নে সারা জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকবে। অ-শুভ শক্তির ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মুক্তমনের অধিকারি নেতাকর্মী অকাতরে জীবন দিয়ে ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার শফথে দৃড প্রতিজ্ঞ থাকবে। অথছ ভাগ্যের নির্ম পরিহাস যাকে উপলক্ষ করে এতসব হস্ব, বিস্বাদ, গৌরব, বীরত্বগাঁথার হামেশা বড়াই, আলোচনা, সমালোছনা--"তাঁর নীতি বাস্তবায়ন প্রশ্নে ধোঁয়াশা থাকবে,  আদর্শ বাস্তবায়নে ধোঁয়াশা থাকবে, মুক্তিযোদ্ধের অঙ্গিকার পূরণে ধোঁয়াশা  থাকবে, বিভ্রান্তি থাকবে, তাঁর কালজয়ী দর্শন অনুসরন প্রশ্নে ধোঁয়াশা  থাকবে! ! -"ইহা বাঙ্গালী জাতির জন্যে কখনই কাম্য হতে পারেনা, বিজ্ঞান মনস্ক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জাতি গঠনে এইরুপ নীতি রাষ্ট্রীয় পয্যায় গ্রহন সুফল বয়ে আনবেনা, আনতে পারেনা।"
      বাংলাদেশ দর্শন ধর্মীয় মুল্যবোধের পরিপন্থি কখনই ছিলনা, এখনও নয়। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য আলাদা পাঠ্য বই 'ইসলামীয়াত' হিন্দুদের 'হিন্দু ধর্ম' বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানের আলাদা আলাদা 'ধর্মশিক্ষা' বঙ্গবন্ধুর সময়েও ছিল।প্রত্যেক ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষার আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্বেও আধুনিক শিক্ষালয়ে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মের জন্যে নির্দিষ্ট পাঠ্যবই এবং সিলেবাস ছিল, এখনও আছে।সকল ধর্মের শিক্ষালয় থাকতে পারলে আধুনিক, বর্তমান যুগের সাথে তালমিলিয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়, ইংরেজী, বাংলা ভাষার উৎকর্ষের জন্যে আলাদা শিক্ষালয় থাকতে পারবেনা কেন? এখানে কেন ধর্মীয় মুল্যবোধের প্রশ্ন জড়িয়ে থাকবে?

বরঞ্চ ধর্মীয় শিক্ষালয়ে অধ্যায়নরত: লাখো অলস মস্তিস্ককে দেশ ও জনগনের উন্নতি অগ্রগতিতে অংশ নেয়ার উপযোগি করে গড়ে তোলার  স্বার্থে এবং তাঁদের পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে আল্লাহকে স্মরন করার জন্যে যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষাকে সহশিক্ষা হিসেবে প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সর্বমহলে উপলব্দি করার সময় এসেছে। তা-না করে যেই টুকু নিরপেক্ষতা শিক্ষাব্যবস্থায় এতদিন চালু ছিল--সেই  টুকুকেও একক ইসলাম ধর্মের আবর্তে, লিঙ্গ বৈশম্যের বেড়াজালে বেষ্টিত করার চক্রান্তে লিপ্ত হল। সরকারে ঘাপটি মেরে থাকা একশ্রেনীর অ-শুভ শক্তির নিয়োগ দেয়া অথর্ব আমলা, সরকারে নতুন যোগ দেয়া  মন্ত্রী, হাইব্রিড শ্রেনীর নীতিনির্ধারক পয্যায়ের তথাকথিত বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যাক্তিবর্গ।
 -মুলত: জড়ালে আপনা আপনিই জড়ায়--" এই জড়ানোর জন্যে একুশবছর বিনাপরিক্ষায়, বিশেষ বিবেচনায়, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের অজুহাতে, বিশেষ নিয়োগ ইত্যাদি অনিয়মকে নিয়মের আওতায় এনে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দফতরে অ-শুভ শক্তির মদদপুষ্টদের নিয়োগ দিয়ে রাখা হয়েছে।, সরকারি দলে আওয়ামী লীগে এত হুমকি ধমকীর পরেও অশুভ শক্তির প্রেতাত্বাদের যোগদান প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চতুদিকে তাঁবেদার, মৌসাহেব, সুযোগসন্ধানী, মোস্তাক বংশধরদের আনাগোনায় এবং তাঁদের আলৌকিক প্রভাবের কারনে--"কেন্দ্রে অসংখ্য ত্যাগি নেতার উপস্থীতি থাকা সত্বেও কারো কোন বক্তব্য, বিবৃতি দেয়ার সাহষ হয় না।"

      পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের অযোগ্যতা, অবহেলা, শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রেষারেষি এবং সমন্বয়হীনতার ফলেই ঘটেছে নতুন পাঠ্যপুস্তকের মহাকেলেঙ্কারি। ভুলেভরা পাঠ্যবইয়ের জন্য যেমন সারাসরি এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিযুক্ত তেমনি হেফাজতসহ উগ্রবাদীদের দাবি মেনে বিশ্বকবি রবীদ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ূন আজাদের মতো ব্যক্তিদের লেখা বাদ দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য দায়ী দুই মন্ত্রণলয়ের প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান। কারণ কোন লেখা বাদ দেয়া হবে তার অনুমোদন দিয়েছিল দুই মন্ত্রণলয়ের দুটি কমিটি। ইহা একান্তই সর্বক্ষেত্রে  "রাষ্ট্রীয় দর্শনের" অনুপস্থীতি এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে "রাষ্ট্রীয় দর্শন" বিষয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রাখার অনিবায্য ফসল--'আমি দৃডভাবে বিশ্বাস করি'।

      এমনি আরো একটি ঘটনা দেশব্যাপি আলোচনা, ক্ষোভ বিক্ষোভের সুত্রপাত ঘটিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের জন্যে আলাদা নতুন কায্যালয়ে সামনে 'ভাস্কয্য' স্থাপন নিয়ে। ভাস্কায্যটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক হলেও কোন কিছুই তাঁর গায়ে লেখা নেই।তারচাইতে বড় কথাটি হচ্ছে ভাস্কায্যটির নির্মাতার স্থলে পরিচিতি দেয়া হয়েছে 'ভাস্কায্য শিল্পি। তথাকথিত জ্ঞানীদের এখনও এতটুকু জানার বাকী রয়ে গেছে তাঁদের পরিচিতি শিল্পি নয়-- "ভাস্কর"।

       দেশ ও জনগনের সম্মুখ্যে এইরুপ হাজারো অসামজস্যতা দেখে আমার সাড়া জাগানো বঙ্গবন্ধুর একটি বিশেষ মহুর্তের কথাই বার বার মনে পড়ে।     সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশের অকৃতিম বন্ধু 'ক্যাস্ট্রো'জাতিসংঘের অধিবেশনের এক ফাঁকে বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন--"কমরেড আপনি বাংলাদেশের প্রশাসনে পাকিস্তানী কর্মকর্তা/কর্মচারিদের বহাল কেন রেখেছেন?" বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন-- "সদ্য স্বাধীন দেশে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা কর্মচারি আমি পাব কোথায়"। ক্যাস্ট্রো তৎক্ষনাৎ বলেছিলেন--"যারা জীবনবাজি রেখে একটা দেশ স্বাধীন করতে পারে--তারা প্রশাসন চালাতে পারবেনা !!"বন্ধু কমরেড আপনি ভুল করেছেন---'আপনার মৃত্যু সমাসন্ন।' বিদায়ের প্রাক্কালে চিৎকার করে কান্না বিজড়িত কন্ঠে বার বার বঙ্গবন্ধুকে সজাক করে দিয়েছিলেন।  আমার উদ্ধিতিটি হুবহু নয়--'তবে বক্তব্যের মর্মাথ্য ইহাই ছিল।'
       দীর্ঘ একুশ বছর প্রকাশ্য অ-প্রকাশ্য ইতিহাস বিকৃতিতে যতটুকু জাতিকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছিল, একটানা আটবছর জাতির জনকের কন্যা সরকার পরিচালনায় থাকার পর, চলতি বছর পাঠ্যপুস্তক মুদ্রনে তাঁর চেয়ে বেশী ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে। অত্যান্ত সুচুতুর ভাবে বঙ্গবন্ধুকে হেয় প্রতিপন্ন করে তাঁর কন্যাকে অধিক গুরুত্ব দিতে(মুলত: মৌসাহেবির অন্তরালে ইতিহাস বিকৃতি) পঞ্চম শ্রেনীর বইয়ের মলাটের পেছনে এক জায়গায় এইরুপও মুদ্রন করা হয়েছে (শেখ হাছিনার বাংলাদেশ)। মুলত: তাঁরা বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম ব্যাক্তিত্বের কষাঘাতে জর্জরীত হয়ে তাঁর কন্যাকে সমান্তরালে উপস্থাপন করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের ইতিহাসকে ভুলিয়ে 'উন্নয়ন অগ্রগতির' ইতিহাসকে সুকৌশলে প্রতিস্থাপন করে  প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার অভিনব পন্থা অনুসরন করেছে। সরকারের একান্ত নিকটে থেকে  অ-শুভশক্তির প্রেতাত্বারা (ধোলাই মগজের ফসল) তাঁদের মুরুব্বিদের চক্রান্তে বাংলাদেশের "অস্তিত্বের ইতিহাস"কে 'ভিন্নখাতে নেয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়ন' করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এখনই সময় তাঁদের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার--"বিলম্বে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না"।
       ruhulaminmujumder@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন