ইসলামী সন্ত্রাস বাদ বাস্তবতা: না অলীক কল্পনা? ________________________________________ ভয় দেখিয়ে বা ত্রাস সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টাকেই বলা হয় সন্ত্রাসবাদ। বিরোধীদের দমনের জন্য বা তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহিংস বা অবৈধ তৎপরতাও সন্ত্রাসবাদ হিসাবে বিবেচিত হয়। এ দ্বিতীয় ধরনের পদক্ষেপকে বলা হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ইসলাম গোপনে কাউকে হত্যা করা বা সন্ত্রাসী পদক্ষেপকে নিষিদ্ধ করেছে। সূরা কাহ্ফ,সূরা মায়েদা ও বনি ইসরাইলে নরহত্যাকে নিষিদ্ধ বলে জানানো হয়েছে। যেমন,সূরা মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,‘এ কারণেই আমি বনি ইসরাইলের প্রতি এ বিধান দিয়েছি যে,কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। আর যে কারও জীবন রক্ষা করে,সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। আমার পয়গম্বরগণ বনি ইসরাইলের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছে। বস্তুত এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘন করেছে।’ সূরা বনি ইসরাইলের ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,‘সে মানুষকে হত্যা কর না যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন;কিন্তু বৈধ কারণে হত্যা করা ন্যায়সঙ্গত। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়,আমি তার উত্তরাধিকারীকে হত্যার বদলা নেওয়ার বা কাসাসের ক্ষমতা দান করি। অতএব,সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।’ আবু সাবাহ্ কানানী নামের এক ব্যক্তি হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করেন,‘আমার এক প্রতিবেশী আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে খারাপ কথা বলে,তার ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমতি দেবেন কি?’ তিনি বললেন,‘তুমি কি কিছু করতে পারবে?’ সে বলল,‘আল্লাহর কসম! আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে তার আশপাশে কোথাও গোপনে অবস্থান নেব এবং নাগালের মধ্যে আসা মাত্রই তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করব।’ ইমাম তাকে বললেন,‘হে আবু সাবাহ! তোমার এ কাজ তো গুপ্তহত্যা বা সন্ত্রাস এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) তা নিষেধ করেছেন। ইসলাম অবশ্যই গুপ্ত হত্যা বা সন্ত্রাসের বিরোধিতা করে।’ মাসুম ইমামগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে,ঈমান গুপ্তহত্যা বা সন্ত্রাসে বাধা দেয়। একজন মুমিন কখনও সন্ত্রাসে বা গুপ্ত হত্যায় জড়িত হয় না।’ পবিত্র কুরআনের এসব আয়াত ও এসব নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে বোঝা যায়,একজন খুনী,অপরাধী বা হত্যার যোগ্য অপরাধী বা কাফির সেনাকে কেবল ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার অনুষ্ঠানের পর প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার কাজও হতে হবে প্রকাশ্যে বা কোন রাখ-ঢাক ছাড়াই। এ ধরনের শাস্তির উদ্দেশ্য হল,সমাজে শৃঙ্খলা বিধান ও জনসাধারণের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা। অন্যদিকে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো হয় রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে। জননিরাপত্তা ও জনগণের শান্তি-শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটানোর উদ্দেশ্যেও গোপনে এ ধরনের হামলা চালানো হয়। কোন ইমাম এ ধরনের তৎপরতার অনুমতি দেননি। মহান আল্লাহ্ সূরা নিসার ৮৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন,‘যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে;আর যারা কাফির তারা তাগুতের (শয়তানের) পথে লড়াই্ করে;তাই তোমরা জিহাদ করতে থাক শয়তানের পক্ষাবলম্বনকারীদের বিরুদ্ধে,(দেখবে,) শয়তানের ষড়যন্ত্র একান্তই দুর্বল’ ইসলামী জিহাদের উদ্দেশ্য হল,দুর্বল,বঞ্চিত ও নিপীড়িত লোকদের কুফরি বা তাগুতি শক্তির হাত থেকে মুক্ত করা। শিয়া রাজনৈতিক ফিকাহ শাস্ত্রে সন্ত্রাস বলতে ভয় দেখানোর জন্য অস্ত্র ব্যবহার,প্রতিপক্ষকে অসচেতন বা অসতর্ক অবস্থায় হত্যা করা এবং শত্রুকে আশ্রয় দেওয়ার পরও হত্যা করা বা তার ওপর নির্যাতন করাকে বোঝায়। গোপন প্রতিহিংসা ও অযৌক্তিক বা অন্ধ-বিদ্বেষ এ ধরনের তৎপরতায় প্রেরণা যোগায়। শিয়া ফিকাহ অনুযায়ী এ ধরনের তৎপরতা তথা সন্ত্রাস পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের খেলাফ।’ পাশ্চাত্যের বিশিষ্ট ইসলাম বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড লুইসও মনে করেন ইসলাম খুব স্পষ্টভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে। এমনকি ইসলাম আত্মহত্যারও বিরোধিতা করে। ইসলামের যুদ্ধনীতি মোতাবেক সব অবস্থাতেই শিশু,বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও বেসামরিক মানুষকে যুদ্ধের সময় নিরাপত্তা দিতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে রাসায়নিক ও পরমাণু বোমার মতো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারও হারাম। বার্নার্ড লুইস বলেছেন,‘ঐতিহ্যবাহী ধারার ইসলামী আইন অনুযায়ী ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতা উসামা বিন লাদেনের নেই। কারণ,তিনি আলেম নন। বিন লাদেনের ফতোয়া দেওয়া হিটলার কর্তৃক পোপ নিয়োগ দেওয়ার কিংবা লেনিনের মাধ্যমে রাশিয়ার অর্থডক্স গীর্জায় নির্দেশনামা জারি করার সমতুল্য।... পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সন্ত্রাস নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তালেবান ও আলকায়দার মতো দলগুলো মুসলিম বিশ্বে আত্মঘাতি হামলা চালিয়ে বা বোমা হামলা চালিয়ে নিরপরাধ ও বেসামরিক মুসলমানদের হত্যা করছে। আর এসব কাজে কুরআন ও হাদীসের সমর্থন রয়েছে বলে দাবি করেছে। আসলে এটা সঠিক বাক্যকে ভুল কাজে ব্যবহারের দৃষ্টান্তের মতো। ‘জিহাদ ধর্মের অন্য কাজগুলোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ’-এমন মত দেওয়া হয়েছে লেখক ইবনে তাইমিয়ার আসসিয়াসাত আশ শারিয়া গ্রন্থে। উগ্র ইসলামপন্থী মৌলবাদীরা ওয়াহাবীদের সৃষ্ট নানা বিদ‘আতে প্রভাবিত হয়েছেন। আর এরই আলোকে অনেকে ইসলামী সন্ত্রাসের ওপর তত্ত্ব বা থিওরি দাঁড় করাচ্ছেন। এসব তত্ত্বের না আছে বুদ্ধিবৃত্তিক বা যৌক্তিক ভিত্তি,না আছে কুরআন বা হাদীসের বর্ণনার সমর্থন। ফলে পবিত্র জিহাদ বা ইসলামী জিহাদ যে সন্ত্রাসের বিরোধী সেই ধারণা ধোঁয়াশাযুক্ত বা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আসলে ইসলামের নামে প্রচলিত যেসব ধারা ইসলামের মূল চেতনা তথা তাওহীদের চেতনার সাথে সমন্বিত নয় সেসব ধারা আধুনিক মতবাদগুলোর খপ্পরে পড়বে,এটাই স্বাভাবিক। অতি উগ্র ইসলামী মৌলবাদীদের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। আল কায়েদার ‘পছন্দের ইসলামে’ লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসাবে সন্ত্রাস সমর্থনযোগ্য। অথচ প্রকৃত ইসলামে সৎ বা অসৎ যে কোন উদ্দেশ্যে সন্ত্রাস বৈধ নয়। পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত,রাসূলল্লাহ (সা.)- এর তৎপরতা ও পবিত্র ইমামগণের বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি দিবালোকের মতই স্পষ্ট। (সুত্র প্রত্যাশা:সংখ্য-২ বর্ষ-২)

  চলমান বিশ্বে ইসলামের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি, জঙ্গিপনা কোন অবস্থায় কোরান-হাদিসের আলোকে অনুমোদিত নয়।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন