সর্বগ্রাসী দূর্নীতির উৎপত্তি; টি আই বি'র ভূমিকা--বর্তমান সরকারের দূর্নীতি বিরূধী মনোভাব। (সপ্তম কিস্তি)


রুহুল আমিন মজুমদার:--কালক্রমে দূর্নীতির বিষবৃক্ষ ডালপালা ছড়িয়ে সারা দেশকে আচ্ছন্ন করে পেলেছে। দূর্নীতির শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে বাঙ্গালী জাতীর রক্ত প্রবাহের সঙ্গে।অনৈতিকতা, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি সর্বক্ষেত্রে নীতিহীনতা জাতীয় পয্যায় পাথরসম শক্ত হয়ে জাতীকে  আষ্টে পৃষ্টে বেঁধে নিয়েছে।সর্বক্ষেত্রে বাঙ্গালী জাতির বোধদয় লোপ পেয়েছে, চেতনা লোপ পেয়েছে, নীতিনৈতিকতা লোপ পেয়েছে। বর্তমান সময়ে এসে কোন কাজটি দূর্নীতিযুক্ত, অবৈধ--কোনটি নয় অনুধাবন করার শক্তি জতি হারিয়ে পেলেছে।চোট কয়েকটি উদাহরণ দিলে পাঠকদের বুঝতে আরো সহজ হবে। অনে করি। যেমন:--

     মান্ধাতার আমলের 'মহাজনী সূদের ব্যবসা' হাল আমলে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে অফিস দখল করে 'মাল্টিপারপাস' ব্যাবসা নামধারন করেছে। ডিজিটাল সাইনবোর্ডে নামের আগে 'আল' শব্দযুক্ত অথবা ইসলামী শরিয়া ভিত্তিক খোদাই করে ধর্মীয় নিম্নতম প্রতারনার আশ্রয় নিয়ে  চড়া সুদের রমরমা ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে।উক্ত ব্যাবসার একচেটিয়া মালিক 'জামায়াতের ইসলামী বাংলাদেশ' দলের অনুসারী নেতাকর্মীদের।আমরা সবাই বলি 'জামায়াত' একটি ইসলামী আদর্শ অনুসরনকারী 'রাজনৈতিক দল'।

        দারিদ্রতা বিমোচনে কতিপয় এনজিও বাংলাদেশব্যাপী ব্যাপৃত রয়েছে। কাগজে কলমে দরিদ্র মহিলাদের ঋন দিয়ে স্বাবলম্বিতা অর্জনে  সহযোগীতা করাই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। যেমন--'গ্রামীন ব্যাংক, ব্রাক ব্যাংক, আশা ব্যাংক' সহ আরো কতিপয় এনজিও।স্বল্পসূদে দরিদ্র মহিলাদের ঋন দিয়ে তাঁরা সাপ্তাহিক কিস্তিতে পরিশোধের  সময় সীমা নির্ধারন করে দেয়। নির্দিষ্ট দিনে কিস্তির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে 'ঋনগ্রহিতার গরু, ছাগল হাড়িপাতিল' নিয়ে টানাটানি শুরু করে। স্বল্প সুদের ঋনের আড়ালে সুদের হার ৬০/৭০ টাকা পয্যন্ত হয়ে থাকে এই সমস্ত এনজিও গুলীর।এই এনজিও মালিকদের আমরা সবাই বলি বুদ্ধিজীবি--এদের মধ্যে অনেকেই দেখা যায় আন্তজাতিক পয্যায় সবচেয়ে দামি নোবেল প্রাইজেও ভূষিত হয়।লক্ষনীয় বিষয়টি হচ্ছে--'তিনি কাজ করেন কথিত দারিদ্র বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋন নিয়ে, নোবেল পুরস্কার পান 'তথাকথিত শান্তিতে'। আমরা সবাই তাঁদের বলি আন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব!!

     এই একটিমাত্র ঘটনাও যদি চিন্তা করা যায়--তাহলেও অনূধাবন করা যায়, মূলত: বাংলাদেশে বহুজাতিক সংস্থাগুলী কি চায়।বহুজাতিক সংস্থার নিয়ন্ত্রক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রয়োজন পড়েছিল।

     ঘুষকে নতুন নামে ডাকি পরিশ্রমের উপরি পাওনা(খোদ বর্তমান সরকারের মন্ত্রীর মূখেও শুনেছি)। চাঁদাবাজি, মাস্তানী, প্রভাব বিস্তারকে বলি রাজনীতি। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানী, চিনতাই মামলায়  জেলে গেলে বলি 'জেলফেরৎ দলের ত্যাগী নেতা'! ঐসমস্ত পাড়া মহল্লার ত্যাগী নেতার 'জেলমূক্তিতে সম্বধনার আয়োজন চলে আবারও চাঁদার টাকায়। আমরা তাঁদের বলি দলের প্রভাবশালী নেতা!!

     দখলবাজি, টেন্ডারবাজীকে বলি নেতা বহু গুনে গুনাম্বিত---"টাকা পয়সা, ধন  সম্পদ অর্জনে সফল নেতা। কালবাজারীকে বলি এপার ওপার  প্লাইং ব্যবসা। বড় পুঁজিদার ব্যাবসায়ী হলে বলি--"আমদানী-রপ্তানী জগতের 'ম্যাগনেট'!! সফল ব্যাবসায়ী!! ঐ সমস্ত দূর্নীতিবাজের অনৈতিক অহরনের টাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে অনন্তকাল কবরে নেকী যুক্ত করার চেষ্টাকারীকে বলি দানবীর!! আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গগন বিদির্ণ করে মাঠজুড়ে হুজুরের সাথে তালমিলিয়ে "মারহাবা"য় শরিক হতেও দ্বিধা করিনা!!

     ভাবতে অবাক লাগে--"বাঙ্গালীর  বিবেচনা বোধ, চেতনাবোধ, সততার অহংবোধ "পুঁজিবাদী অর্থনীতির কল্যানে তথা খোলা বাজার অর্থনীতির কল্যানে কোথায় নেমে গেছে"--রুচিবোধ, ধর্মীয় চেতনাবোধ কত নিম্ন পয্যায়ের অস্ত্রে ভোঁতা করে দিয়েছে!!
 
       কেউ যদি বলে 'বর্তমান সরকারের সফলতা রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে উধ্বমূখী, তথ্যমন্ত্রনালয় তথ্য প্রকাশ করেছে--আপনি কি একমত? আপনি কি মনে করেন সরকারের কোন খাতেই ব্যার্থতা নেই? আমি সোজা   তাঁকে উত্তর দিতে কুন্ঠিত হবনা-"অবশ্যই ব্যার্থতা  আছে--"সেই ব্যার্থতা সরকারের সফলতার যতগুলী খাতের সূচক উধ্বমূখী চিহ্নিত করে তথ্য প্রকাশ করেছে;ঠিক ততগুলী উধ্বমূখী খাতের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, শিরা উপশিরায় ''দূর্নীতি নামক অনৈতিক ব্যাধির জার্ম''   প্রবাহিত হচ্ছে। সরকার বাৎসরিক খাত ওয়ারী উধ্বমূখী  সূচকের রেখচিত্র প্রদর্শন করেছে--"দূর্নীতির "এক্স-রে" রিপোর্ট প্রকাশ করেনি"!!

      সরকারের উন্নয়ন বাজেটের অতিসহজ একটি উদাহরণ দিয়ে উল্লেখিত বক্তব্যের সত্যতা তুলে ধরছি-- "দূর্নীতি"র ধরন কত ব্যাপক, নিলজ্জ, সর্বব্যাপি যে কেউ হতভম্ব না হয়ে উপায় থাকেনা।  উন্নয়ন প্রকল্পের বছর বছর ব্যায়বৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে দেখুন--কি পরিমান অর্থ সরকারের উন্নয়ন বরাদ্ধে দুর্নীতি হয়। এমন সব প্রকল্পের নাম  বলা যায়--'শুরুতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধ দেয়া হয়েছিল শেষ পয্যন্ত কাজের পরিধি না বাড়িয়ে ব্যয় বরাদ্ধ  তিন চার গুন বাড়ানোর পরও উক্ত প্রকল্পের কাজ হয়তোবা এখনো সমাপ্ত করা যায়নি।"

       বিশেষ ভাবে  উল্লেখ্ করতে চাই--প্রকল্প গ্রহন করার সময় আনুষাঙ্গীক খরছ সহ ১০% হারে ঠিকাদারের লভ্যাংশ যুক্ত করে ব্যয়বরাদ্ধ নির্ধারন করা হয়েছিল।বছরান্তে তিন চার বার ব্যয় সংশোধনের কি কারন থাকতে পারে-? বলতে পারেন মূল্য স্ফীতির কারনে ব্যয় বরাদ্ধ বাড়াতে হয়েছে-- অবান্তর নয়, এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে কত পার্সেন্ট মূল্যস্ফীতি ঘটলে  প্রকল্পব্যায় দ্বিগুন হতে পারে? আপনি কি কখনও শুনেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোন অর্থবছর মূল্যস্ফীতি দ্বিগুন আকার ধারন করেছিল?

     এই প্রসঙ্গে ১১ই ডিসেম্বর ২০১৬ ইং সালে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার উপ সম্পাদকীয় কলামে জনাব আবু নোমান বিস্তারীত এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন।নিবন্ধে দূর্নীতির ভয়াবহতা এবং ক্ষমতাসীন সরকারের উদাসীনতার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।  উক্ত নিবন্ধের দুটি চরন পাঠকদের উদ্দেশ্যে হুবহু কপি পেষ্ট তুলে দিলাম।

  তৎসময়ের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান 'নজিবুর রহমান' একটি পরিসংখ্যানে বলেছেন, রফতানিকারকদের দেয়া বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ যে পরিমাণ বন্ড সুবিধার অপব্যবহার হয় তা ঠেকানো গেলে বছরে ২টি পদ্মা সেতুর সমপরিমাণ অর্থায়ন করা সম্ভব। ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, রাষ্ট্রের সব খাত মিলিয়ে দুর্নীতির পরিমাণ কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশ। যাতে ক্ষতির পরিমাণ ৬৫ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার কম নয়।

       বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতি সম্পর্কে উদাসীনতার কয়েকটি উদাহরন পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন-- ‘নিজেদের লোকদের সমর্থনের কারণে সোনালী ও বেসিক ব্যাংক অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি পারেননি’। শেয়ার কেলেঙ্কারির কারণে ৩৪ লাখ বিনিয়োগকারী পথে বসলেও অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন-- ‘আমি শেয়ারবাজার বুঝি না’। হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই করার কিছু নেই বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী। এমনকি তিন বা চার হাজার কোটি টাকা Its Nothing  বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরির ব্যাপারে এফবিসিসিআই সভাপতি সরকারের আস্থাভাজন আবদুল মাতলুব আহমেদ বলেছিলেন, ‘এটা কোন বিষয় না--‘অত বড় চোর নয়, ছেঁচড়া চোর’।

   এবার বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ এই সম্পর্কীত বিষয় কি বলেছিল-- সেদিকে নজর দিয়ে দেখি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন--''সবাই পায় সোনার খনি, তেলের খনি--আমি পেয়েছি চোরের খনি"। যারেই যেখানে দায়িত্ব দেই--"সে কেবল চুরি করে’।
(চলমান পাতা:--৭)
      ruhulaminmujumder27@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন