জঙ্গী সংকট সহ অন্য সকল সমস্যা সমাধানে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার পুর্ণ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নাই।

    জঙ্গী সংকট সহ সকল সমস্যা সমাধানে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকার পুর্ণ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নাই।
______________________________________________


    বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে ব-দ্বীপে আমাদের এই বসতি গড়ে উঠেছে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। প্রাচীন জনপদ হলেও সভ্যতা তেমন বিকশিত হতে পারেনি এই জনপদে। তবে একটি স্বতন্ত্র  বৈশিষ্টে অত্র অঞ্চলের কৃষ্টিও সংস্কৃতি টিকে রয়েছে যুগে যুগে। প্রকৃত অর্থে কোনো পর্যায়েই কখনই সম্পূর্ণ স্বাধীন ও একতাবদ্ধভাবে আপন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি এ জনপদ। তবে ব্যতিক্রমী ধ্যান-ধারণা ও বৈশিষ্ট্যের কারণে কখনো কারো সম্পূর্ণ অধীনতাও স্বীকার করেনি এ জনপদের মানুষ। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় অনেক বিদ্রোহের জন্ম হয়েছে এ অঞ্চলে। প্রকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল বারবার লুণ্ঠিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্টির দ্বারা। শেষাবদি ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠীর দ্বারা শাষিত ও শোষিত হয়েছে প্রায় দুই শত বছরের কাছাকাছি। ফলে স্থানীয় ও বিদেশি শাসক দ্বারা শাসিত হওয়ার কারনে মজ্জাগতভাবে এ অঞ্চলের মানুষ ভিন্ন জাতি গোষ্টির সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখা যায় অতি সহজে।

খ্রিস্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ দীর্ঘ সময় শাষন করে অত্র অঞ্চল।  পরবর্তীতে খুব কম সময়ের জন্য শশাঙ্ক নামের একজন স্থানীয় রাজা ক্ষমতা দখল করে নিতে পেরেছিল। পরবর্তী প্রায় একশ বছরের অরাজকতা, বিশৃংখলা, অধ:পতন, শাষনকর্তাহীন অবস্থায় থাকতে হয়েছিল এই অঞ্চল।শেষতক অরাজক পরিস্থীতির সুযোগ নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী 'পাল রাজবংশ' প্রায় চারশ বছর শাসন করেছে অত্র অঞ্চল।

   বৌদ্ধ শাষনকে পরাজিত করে 'সেন রাজবংশ' ক্ষমতায় আসে। সেনদের শাষনের সময় বিচ্ছিন্নভাবে আরবের মুসলিম সেনাপতিরা বার বার হানা দিয়েছে অত্র অঞ্চলে। যাওয়ার সময় লুটপাট করে যাহাই পেয়েছে হাতের কাছে তাই নিয়ে গেছে।স্থায়ী শাষনের জন্য আক্রমন রচনা করেনি কোন অধিপতি-বাংলার সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লুটপাট করার জন্য রচিত হত এই সমস্ত আক্রমন।পরবর্তিতে দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে চুড়ান্ত  সামরিক অভিযান চালায় আরবীয়রা এবং রাজা 'বল্লাল সেনকে' পরাজিত করে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।

    আরবীয় অধিপতি 'বাদশাহী' শাষন শোষন চলে দ্বাদশ শতকের শেষ দিক থেকে ষোড়ষ শতকের প্রথমার্ধ পয্যন্ত। আরবীয় মুসলিম শাষকদের 'বাদশাহী সুখে' গা ভাসিয়ে দেয়ার দুর্বলতার সুযোগে মোগলেরা হানা দেয় অত্র অঞ্চলে। মোগলীয়রা আরবদের পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, অতিমাত্রায় আরাম আয়েসের সুযোগে আরবের মুসলিম শাষকদের চরমভাবে যুদ্ধে  পরাজিত করে  শাষনভার নিয়ে যায় অত্র অঞ্চলের এই ষোড়ষ শতকেই।

     ষোড়শ শতকে মোগল শাসকদের হাত থেকে ষড়যন্ত্র, বেঈমানীর কারনে 'ব্যবসা করার অনুমতি প্রাপ্ত' ইংরেজ বেনীয়াদের হাতে ক্ষমতা চলে যায় অত্র অঞ্চলের।মুলত: ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে নবাবের প্রধান সেনাপতি  মীর জাপর আলী খাঁ সহ অন্য আরো কতক পাইক পেয়াদার নবাব সিরাজের সংঙ্গে মিরজাপরী, বেঈমানীর কারনে অনায়াসে ইংরেজেরা  যুদ্ধ জয় করে বৃটিশ রাজ কায়েম করে।

বৃটিশ রাজপরিবারের নিয়োগ দেয়া লর্ডদের মাধ্যমে বাংলার শাসনকায্য চলতে থাকে। দীর্ঘ প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশ শাসনের পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বাস্তবতায় এই অঞ্চল ত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ইংরেজ বেনীয়া শাষকদের। তখনি অত্র অঞ্চলে দানা বেঁধে উঠে স্ব-শাষনের নিমিত্তে জাতিগত স্বাধীনতার। বাংলা ভাষাবাসি অধ্যুষিত বিশাল বাংলাকে পুর্ব ও পশ্চিমে দুইভাগ করে বাঙ্গালীরা স্বাধীনতা পাওয়ার আক্ষাংকায়  গড়ে তোলে 'বঙ্গভঙ্গ' আন্দোলন। সর্বস্তরে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন গৃহিত হলে কুচক্রি মহল অকস্মাৎ ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টি করে। ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গকে পাস কাটিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম দুইগোষ্ট্রির দুইধর্ম ভিত্তিক বিভাজন সৃষ্টি করে। মুলত: অত্র অঞ্চলকে পশ্চিমাদের করতলগত করার হীন উদ্দেশ্যে চতুর শিয়া ধর্মালম্বি পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ "দ্বিজাতিতত্ত্ব" নামে ধর্মভিত্তিক এই তত্ব হাজির করে। ধর্মীয় সুরাপানে বেঁহুস বাঙ্গলা ভাষাবাসি মসুলমানদের নিয়ন্ত্রন করে  শেষ পয্যন্ত ষড়যন্ত্রকারিরাই সফল হয়। 'দ্বিজাতি তত্বের'  ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে দুই অঞ্চল একিভুত করে স্বাধীনতা লাভ করে। ব-দ্বিপ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে এবং পশ্চিমাঞ্চল পশ্চিম পাকিস্তান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দুই অংশ সম্মিলীত ভাবে স্বাধীন 'পাকিস্তান' রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

     "উল্লেখীত সংক্ষিপ্ত আলোচনায় চার হাজার বছরের ইতিহাসে 'কোন অংশেই কোন বাঙ্গালী মুসলিম বা হিন্দু সম্মিলিত বা পৃথকভাবে নিদেন পক্ষে অত্র অঞ্চলে বসবাসরত: অন্য জাতিগোষ্টির শাষন চোখে পড়েনা। অত্র অঞ্চলে দীর্ঘ বসবাসের কারনে অঞ্চল্প্রীতি জাগরুক আছে (যেকোন জাতি গোষ্টির হোক)তেমন ব্যাক্তি বা গোষ্টি অত্র অঞ্চলের অধিবাসির পক্ষ থেকে শাষক শ্রেনী সৃষ্ট্রি হয়ে শাষন করার দৃশ্যমান কোন উদাহরন নেই।"

     আলোচনায় স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায় যে--বঙ্গবসাগর বিদৌত অত্র ব-দ্বিপের জনগন অদৌ কখনই স্বাধীন ছিলনা এবং স্বাধীনতা কি বস্তু জানেনা। সুতারাং স্বাধীনতার মর্মবাণী বুঝার কথাও নয়। বিভিন্ন জাতি গোষ্ট্রির তাঁবেদারি করার কারনে মজ্জাগত ভাবে দাসত্বের সুপ্তবাসনা লুকায়িত রয়েছে প্রত্যেক নাগরীকের চারিত্রিক বৈশিষ্টে। সেই বৈশিষ্টই টেনে নিয়ে যায় তাঁদের মনের অজান্তে ভীন দেশী কোন আদর্শ বা মতবাদে অথবা ব্যাক্তি বা জাতির গুনগানে। চোখের সামনে স্বর্নের খনি পড়ে আছে সেই দিকে আদৌ খেয়াল করার প্রয়োজন আছে--তাও মনে করেনা।" কথাটি অকাট্য হলেও বাস্তব-।"

      হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্ট্রি করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও অত্র অঞ্চলের মানুষ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঔপনিবেশিক পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গন্য করা শুরু করে। প্রথমেই তারা আঘাত হানে বাঙালির মাতৃভাষার ওপর। ভাষা রক্ষার আন্দোলন মুলত: সংস্কৃতিক কৃষ্টিগত আন্দোলন। তাই ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

'ভাষা আন্দোলন যদিও 'অ-রাজনৈতিক' সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয় তথাপি এই আন্দোলনই বাঙ্গালীদের চোখ-কান খুলে দিয়েছিল। বাঙ্গালী হিন্দু মুসলিম নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন পশ্চিমাদের সাথে এই অঞ্চলের বসবাস সম্ভব হবেনা। এই কারনেই বলা হয়  ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়ছিল।'

   ভাষা আন্দোলনে হিন্দু মুসলিম বাংলা ভাষাবাসী সকল শ্রেনী পেশার মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহন করেছিল। একতাবদ্ধ অংশগ্রহন করার কারন 'বাংলাভাষা অত্র অঞ্চলের মুসলিম বাঙ্গালীদের যেমন মাতৃভাষা তেমনি বাঙ্গালী হিন্দুদেরও মাতৃভাষা।' ধর্মভিত্তিক তত্ব 'দ্বিজাতিতত্বের' মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম বৈরীতা সৃষ্টি করে কুচক্রি মহল একই সংস্কৃতি, কৃষ্টি লালনকারি বাঙ্গলা ভাষাবাসির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। শুধু তাই নয়,  "উদ্দেশ্যমুলক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে সেই বিভাজনকে একে অপরের প্রতি 'প্রচন্ড ঘৃনার'   বীজ এ রুপান্তরীত করেছিল। "পাকিস্তানের২৩ বছর  শাষনে 'উদ্দেশ্যমুলক সীমান্তযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দুধর্মালম্বিদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে ধর্ম্ম পালনে অঘোষিত নিষেদাজ্ঞা, সম্পদ হস্তান্তরে ইউনিয়ন বোর্ডের নজরদারী আরোপ' করে বাঙালী মসুলমানদের মননে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছে যে-- "হিন্দুদের জন্য 'হিন্দুস্থান' শুধু মসুলমানদের জন্য পাকিস্থান।"
 
    ধর্মীয় চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষে আবাসস্থলের যে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছিল পাকি শাষকেরা- সেই বিভাজন রেখা কালক্রমে রুপ নিয়েছে 'পাকিস্তান-ভারত বিদ্বেসে।' বিদ্বেসের মাত্রা এতবেশী কায্যকর তাঁদের মননে--ভারতে বসবাসরত:  ত্রিশকোটি মসুলমানের জীবন ও সম্পদের  চিন্তাও মাথায় আসেনা। তাঁরা মনে করে পাকিস্তানের এগারকোটি মসুলমানই তাদের জাতভাই অন্যরা সব ভীন্নজাতি।

    ভাষা আন্দোলন সেই বিদ্বেস এবং বিভাজন রেখাকে অতিক্রম করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা বোধের চেতনাকে ধীরে ধীরে প্রকট করে তোলে।ধীরে হলেও ধর্ম্মীয় বিভাজন লোপ পেয়ে বাংলা ভাষাবাসির একক  জাতীসত্বার উদ্ভব হতে থাকে। অত্র অঞ্চলের সংখ্যাধিক্য হিন্দু-মসুলমানের একই জীবনধারা, একই খাদ্যাভ্যাস, একই আচার-আচরন, একই ভাষা, একই সংস্কৃতি ও কৃষ্টি, একই পোষাক আসাক ব্যবহার করে।তাই প্রকৃতিগত ভাবেই ২৩ বছর আগের ভীন্ন জাতির শাষনকালে যে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে  ভাবধারা বিরাজমান ছিল-সেই ভাবধারা ফিরে আসতে থাকে ক্রমান্বয়ে ফিরে আসতে থাকে।

    বাঙালী হিন্দু-মসুলমান আদিকাল থেকেই শান্তিতে বসবাসরত ছিল। চার হাজার বছরের ভীনদেশী শাষকদের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তেমন কোন উদাহরন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে খোঁজে পাওয়া যায়না। পাকিদের সৃষ্ট দর্শন "দ্বিজাতি তত্ব" অত্র অঞ্চলে অশান্তির বীজ রোপন করে দিয়ে গেছে--তাঁদের তাঁবেদার এই দেশীয় দোষরেরা সেই বীজ ধর্মরক্ষার অজুহাতে কখনও ভারত বিরুধীতার অজুহাতে, কখনও ভারতে হিন্দু কতৃক মসুলমান নিয্যাতনের কাল্পনিক অজুহাতে আজও রক্ষনা বেক্ষন করছে--ধর্মীয় উম্মাদনায় পরিপুষ্টতা দিয়ে চলেছে।  

এদেশীয় হিন্দুদের যেমন সাংগঠনিক ভিত্তি আছে তেমনি ভারতে বসবাসরত: ত্রিশ কোটি মসুলমানেরও সাংগঠনিক ভিত্তি আছে।এদেশের হিন্দুদের সংগঠন যেমন আন্তজাতিক মহলে অত্যাচার নিয্যাতনের অভিযোগ উত্থাপন করে তেমনি ভারতের মসুলমানগন অদ্য পয্যন্ত সংখ্যাগুরু হিন্দু কতৃক নিয্যাতন- নিস্পেষনের কোন অভিযোগ আন্তজাতিক মহলে প্রকাশ করেছে তেমন কোন উদাহরন নেই। ভারতের ত্রিশকোটি মসুলমানের অভিযোগ না থাকলেও এদেশে তাঁদের উপলক্ষ করে একশ্রেনীর অশুভ শক্তি, জিন্নাহ  দর্শনের অনুসারি হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয্যাতন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এই অত্যাচার নিয্যাতন যতটা না ধর্মরক্ষা তাঁর চেয়ে বেশী পাকিপ্রেম।ধর্মীয় উদ্দেশ্যেই যদি হ'ত তাহলে ভারতের ত্রিশকোটি ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের কথাও তাঁদের চিন্তা চেতনায় ধারন করত।
 
   বাঙ্গালীরা তাঁদের জাতিসত্বা বিকাসের লক্ষে যতবেশী সংঘটিত হতে থাকে ততবেশী অশুভ শক্তি পাকিশাষকেরা দিশেহারা হয়ে উঠে।পাকিস্তানের জুলুম নিয্যাতন, শোষন শাষন যতই তীব্রতর হতে থাকে  বাঙ্গালীর চেতনাবোধ ততই শানীত হতে থাকে। বাঙালী ফিরে যেতে থাকে তাঁর হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের চেতনায় গড়া বন্ধনের দিকে।
এই বাঙ্গালী চেতনাকে শানীত করার পিছনে বহু বাঙ্গালী মনিষী,জাতীয় নেতা, কবি সাহিত্যিক, আউল বাউলের ত্যাগ তিতিক্ষা,সংগ্রাম সাধনার ইতিহাস রয়েছে। অনেকের অবদান থাকলেও সকলকে ছাড়িয়ে যাঁর অবদানে জাতিসত্বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল,বাঙ্গালী তাঁর নীজের শাষন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অত্র ভুখন্ড সার্বভৌম ভুখন্ড হিসেবে জয় করতে পেরেছিল, তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। দীর্ঘ তেইশ বছরের সংগ্রাম সাধনায় তিনি জাতিকে "সাম্প্রদায়িক  ধর্ম্মান্ধ 'দ্বি-জাতি তত্বের' দর্শনের বিপরীতে ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠা 'অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষতার দর্শনে' ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন।"কুচক্রি মহল বাঙালী জাতীয়তা বোধের এই ঐক্যবদ্ধতাকে কোন অবস্থায় ধর্মীয় সুরাপান, ভারত বিদ্বেসী তকমা ব্যবহার করেও চিড় ধরাতে না পেরে অবশেষে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ইং সালের কালরাতে সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয়।

"শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ।বাঙালী জাতীয়তা বোধে উদ্ভোদ্ধ নিরস্ত্র বাঙ্গালী মহুর্তেই সসস্ত্র যোদ্ধায় রুপান্তরীত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশ্চিমা হায়নার বিরুদ্ধে। দীর্ঘ নয়মাস বাঙ্গালী পশ্চিমা শাষন শোষনের কবল হতে 'মুক্তির জন্য যুদ্ধ' অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অশুভ ধর্মান্ধ শক্তি এবং তাঁদের এদেশীয় দোষরদের চরমভাবে পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।"

স্বাধীন বাংলাদেশের শাষনভার গ্রহন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা ঐক্যবদ্ধতার আলোকে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকারের ভিত্তিতে- বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা,গনতন্ত্র ও শোষন হীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষে সমাজতন্ত্রকে মুলভিত্তি গন্য করে সংবিধান রচনা করেন।যাহা সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম লিখিত সংবিধান হিসেবে বিশ্ববাসীর নিকট প্রসংশীত ও পরিচিতি লাভ করে।

 কুচক্রি অশুভ ধর্মান্ধ  মহল ধর্মনিরপেক্ষতাকে 'ধর্মহীনতা' শোষনহীন সমাজ কায়েমের লক্ষে সমাজতন্ত্রকে 'কমিউনিজম' বলে অপপ্রচারের সুযোগ গ্রহন করে।

সুপ্রীয় পাঠক বন্ধুরা, ধর্মান্ধমহলের অপপ্রচারের বিষয় সমুহকে ইসলামের দৃষ্টিতে কতটুকু সামঞ্জস্যতা এবং কতটুকু বৈপরিত্ত আছে  এবার দেখে আসি।

আমাদের প্রীয় নবী করিম (স:) দুনিয়াতে প্রথম আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন,সেই রাষ্ট্র তিনি নিজে শাষন করেছেন,শাষনের জন্য প্রথম লিখিত শাষনতন্ত্র রচনা করেছেন। আরবে বসবাসরত সকল ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে নজীর রেখে গেছেন। মুলত: তখনকার অন্ধকার যুগে তিনি যে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং লিখিত সংবিধান রেখে গেছেন তাহা একমাত্র মহান আল্লাহ প্রদত্ত ঐশ্বরিক হুকুম ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। বর্তমানের যান্ত্রিক যুগেও যে শাষন তন্ত্র নির্ভুল অকাট্য রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল হিসেবে সর্বজাতির নিকট প্রসংশীত হচ্ছে। সেই শাষনতন্ত্রের প্রথম পরিচ্ছেদেই তিনি সব ধর্মের লোকদের নিয়ে জাতি গঠনের কথা বলেছেন কিনা আপনারা বিবেচনা করবেন।

 "আমি আপনাদের বিবেচনার জন্য 'উইকিপিডিয়া' থেকে 'ম'দীনা সনদের' মুল ধারা সমুহ নিম্নে হুবহু তুলে দিলাম। আমি কোন প্রকার মন্তব্য থেকে বিরত রইলাম"--


    সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ একটি জাতি গঠন করবে;--

যুদ্ধ বা হানাহানি শুরু হবার মতো তীব্র বিরোধ তৈরি হলে বিষয়টি আল্লাহ এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ন্যস্ত হবে;
কোন সম্প্রদায় গোপনে কুরাইশদের সাথে কোন প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদীনা বা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের কোনরুপ সাহায্য-সহযোগীতা করতে পারবে না;
মুসলিম, খ্রীস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে, কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোন রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না;[৬][৭][৮]
মদিনার উপর যে কোন বহিরাক্রমণকে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে এবং সেই আক্রমণ কে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে;[৯]
অমুসলিমগণ মুসলিমদের ধর্মীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে না;[১০]
রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে;
অসহায় ও দূর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে;
সকল প্রকার রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদীনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে;
কোন লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে, তজ্জন্য অপরাধীর সম্প্রদায় কে দায়ী করা যাবে না;
মুসলমান, ইহুদী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরষ্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে;
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক;
মুহাম্মদ-এর অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না;
মুসলমানদের কেউ যদি অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, নিজ সন্তান বা আত্নীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না।"

আপনাদের বিবেচ্য---
-----------------------
  "নবী করীম (স:) কতৃক রচিত সংবিধান কি বলে, রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি কি নির্দেশনার নজীর রেখে  গেছেন? তাঁর রচিত সংবিধান ধর্মভিত্তিক নাকি ধর্ম নিরেপেক্ষ? 'বিসমিল্লাহ' কোন ধারায় সংযোজন করেছিলেন?কোন ধারায় "রাষ্ট্র ধর্ম" ইসলাম অনুমোদন দিয়েছিলেন?

ইসলামকে আল্লহ রাব্বুল আলামীন পাঠিয়েছেন সমগ্র মানবব্জাতির কল্যানে সার্বজনীন ধর্ম হিসেবে। আমাদের ধর্মীয় নেতারা ইসলামকে শুধুমাত্র মসুলমানদের একক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবন বাজী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। তারা কি আল্লহ এবং তাঁর রাসুলের নির্দেশীত পথকেও চেলেঞ্জ করতে চান?

   

            *জয়বাংলা    জয়বঙ্গবন্ধু*

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন