শেখ হাসিনার "একটি বাড়ী একটি খামার প্রকল্প" দারিদ্রতা মোচনের দলিল।

শেখ হাসিনার "একটি বাড়ী একটি খামার প্রকল্প"--দারিদ্রতা মোচনের দলিল।
         (রুহুল আমিন মজুমদার)
     

      নিরবে, নির্বিত্তে, সংগোপনে দারিদ্রবিমোচনে সর্ববৃহৎ এবং যুগান্তকারি পরিবর্তন এনে দিয়েছে পল্লি অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের জন্য গৃহিত জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব মেধা ও মনন থেকে উৎসারীত "একটি বাড়ী একটি খামার প্রকল্প।" প্রতিষ্ঠালগ্নে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবায়নের লক্ষ অর্জন এবং উপকৃত পরিবার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিদগ্ধ জনেরা সমুহ সন্দেহ পোষন করলেও সময়ের ব্যবধানে তাঁর কোন লেশমাত্র নেতিবাচক উপসর্গ কারো চোখে ধরা পড়েনি।
        দুর্নীতি, অর্থ হরিলুট, ঘুষ ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধাজনিত নেতিবাচক  বড় ধরনের কোন উপসর্গের সৃষ্টি হয়নি। সঙ্গত কারনে প্রকল্পটি আশাতীত সাফল্য অর্জনের কারনে নিম্নবিত্ত পরিবারে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেকগুন বেড়ে জাতীয় পয্যায়ে দারিদ্রবিমোচন সুচকের অগ্রগতিতে বড় অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ঋনবণ্টনে স্বচ্ছতা, কর্মকর্তাদের সততা, ঋনব্যবহারে কর্মকর্তাদের পয্যবেক্ষন সহায়ক ভুমিকা পালন করেছে।উদ্দেশ্য ও লক্ষের সমন্বয়, সঙ্গে উত্তম ব্যবস্থাপনা যুক্ত হলে যে কোন লক্ষ অর্জন সম্ভব " একটি বাড়ী একটি খামার তার প্রকৃষ্ট প্রমান।
   মুক্তিযুদ্ধের পর হ'তে অদ্যবদি রাষ্ট্রীয়ভাবে সবুজ বিপ্লব, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, কৃষিতে স্ব-নির্ভরতা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পথ শিশুদের ভাগ্যন্নয়ন লক্ষে নেয়া পথকলি সহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। একটি প্রকল্পও শতভাগ সফলতার উদাহরন সৃষ্টি করতে পারেনি। উচ্চ স্তর হতে নিম্নস্তর পয্যন্ত- দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, অর্থ আত্বসাৎ ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাবে প্রকল্পগুলি শেষাবদি কাগজে কলমে আমলাদের টেবিলে এবং মাঠপয্যায় কর্মচারী কর্মকর্তাদের হ্যান্ডনোটে সীমাবদ্ধতায় রুপান্তরীত হয়েছে। অন্যদিকে সরকারিভাবে গৃহিত প্রত্যেকটি প্রকল্প লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়ে দুর্নীতির সুচককে উধ্বমূখি করতে সহায়ক ভুমিকা পালন করেছে। বার বার দেশ দুর্নীতির শীর্ষপদের অধিকারি হয়ে বিশ্বময় বাঙ্গালী জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে।
         স্বাধীনতা পরবর্তী জাতীর জনকের নতুন সরকারের নেয়া "সবুজ বিপ্লব" দিয়ে শুরু করে সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের "ছাগল প্রকল্প" পয্যন্ত দারিদ্র বিমোচন, স্বনির্ভরতা, আর্থসামাজিক উন্নতি অগ্রগতি অর্জনের লক্ষে নেয়া পদক্ষেপ সমুহের মধ্যে একটিও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।ফলে সরকারের জনকল্যানের উদ্দেশ্যও সাধিত হয়নি।মাঝখানে সরকারি অর্থ, বিদেশী সাহায্য ও ঋনের টাকায় একশ্রেনীর মানুষ রাতারাতি আঙ্গুল ফুঁলে কলাগাছে পরিণত হয়েছে ; দারিদ্র যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।
      ১৯৯৬ ইং অনুষ্ঠিত সাধারন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় এবং তাঁর নির্দেশনায় "একটি বাড়ী একটি খামার" প্রকল্পটি গ্রহন করা হয়।শুরুতে উক্ত প্রকল্পের থীম হিসেবে চারটি স্তর নির্ধারন করা হয়। (১) মাঠ ফসল (২) পারিবারিক বাগান (৩) বনজ, ফলজ, ঔষধি বাগান (৪) গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী ইত্যাদি প্রতিপালন।২০০১ ইং সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে "আওয়ামী লীগের প্রকল্প" ধরে নিয়ে "চার দলীয় জোট সরকারের" আমলে একরকম পরিত্যাক্ত হয়ে যায়।ফলে প্রকল্পটির কায্যক্রম প্রায় সাত বছর মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
        ২০০৮ ইং সালে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করলে সংশ্লিষ্ট মহল প্রকল্পটির দ্বিগুন উৎসাহে কায্যক্রম শুরু করে।ভবিষ্যতে কোন সরকার "আওয়ামী দলীয় প্রকল্প" মনে করে যাতে পরিত্যাক্ত ঘোষনা করতে না পারে তজ্জন্য  সরকারি উদ্যোগের আওতায় আনার কায্যক্রমও হাতে নেয়া হয়।এইজন্য মাননীয় প্রধান মন্ত্রী প্রকল্পটিকে সমুদয় কায্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার প্রতি মনযোগি হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ ইং সালে একনেক বৈঠকে ১১৯৭ কোটি টাকা উক্ত প্রকল্পের ব্যয় ধরে প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
      ২০১৪ সালে উক্ত প্রকল্পকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার লক্ষে "পল্লি সঞ্চয় ব্যাংক" আইন পাস করা হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহন করা হয়।   অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় খামার প্রকল্পের তৃতীয় দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। খরচ বেড়েছে মূল প্রকল্প ব্যায়ের প্রায় সাতগুন। মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার ১০ কোটি টাকা।বাংলাদেশ রেশম বোর্ড প্রকল্পটির সাথে সংযুক্তির ফলে উহার পরিধি বেড়েছে সংঙ্গে ব্যয় ও অনেকটা বেড়ে গেছে। প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত যথার্থ।
    উল্লেখ্য, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি ৬৪ জেলার ৪৯০ উপজেলার ৪০ হাজার ৯৫০টি গ্রামে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামের পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে তৈরি করা হয়। ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বর্তমানের ২২'০৮ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যেই এ প্রকল্প নেয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় গরিব মানুষকে বিনিয়োগের জন্য অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। আবার তাদের সঞ্চয় রাখার ব্যবস্থাও করা হয়।সঞ্চিত অর্থ থেকে পরিবার সমুহ ঋন নিতে পারবে মাত্র ৮শতাংশ সার্ভিস চার্জ প্রদান করে। অত্যন্ত বাস্তবানুগ ও কার্যকর প্রকল্প হিসেবে এটি এরই মধ্যে সর্বমহলে প্রশংসা অর্জন করেছে।
      ব্যাংক আইনের ৩৯ ধারায় বলা হয়, ২০১৬ সালের ৩০ জুনের পর একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প বিলুপ্ত হবে। বিলুপ্ত প্রকল্পের সব সম্পদ, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, অর্থ, কর্মসূচি এবং দায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের হাতে চলে যাবে।  প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনীতে এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যাংকটি এ কার্যক্রমের সঙ্গে 'সম্পৃক্ত থাকবে' বলে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, কিছু জটিলতা রেখেই প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
   "সম্পৃত্ত থাকব" বিষয়টি ভবিষ্যতে বড় কোনো জটিলতা সৃষ্টি করবে কিনা, তা অনুধাবন জরুরি।প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর ফলে নেতিবাচক কিছু বিষয় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। সমিতিভুক্ত সদস্যদের আমানত এমনিতেই একটি ব্যাংক পরিচালনার জন্যে যথেষ্ঠ বলা যায়।এর সাথে সরকারি বিনিয়োগ যুক্ত হলে ব্যাংকের স্থীতির পরিমান অত্যাধিক বেড়ে অলস স্থীতিতে পরিনত হতে পারে। তখন সুফলের চাইতে কুফলের পাল্লা ভারী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। বিষয়টি অভিজ্ঞ জনদের পুণ:ভাবনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।
বাংলাদেশের সামনে দারিদ্র্যবিমোচনের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ অপেক্ষমাণ। কারণ এখনও বাংলাদেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। এজন্য টেকসই নানা কর্মপন্থা আবশ্যক। এ বিবেচনায় একটি বাড়ি একটি খামার একটি জুতসই উদ্যোগ। কোনো আইনি জটিলতা কিংবা পরিকল্পনার দুর্বলতার কারণে যাতে প্রকল্পটির কার্যক্রম ব্যাহত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা উল্লেখিত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নৈতিক দায়িত্ব মনে করি।
       "শেখ হাসিনা" মানব শক্তির সর্বোত্তম ব্যাবহার তথা জীবিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প” বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।কোন অজুহাতেই যেন এই প্রকল্প থমকে না দাঁড়ায় সেদিকে লক্ষ রাখা সংশ্লিষ্ট মহলের দায়িত্ব।শেখ হাসিনা দর্শন দিয়েছেন দারিদ্র মোচনের; সংরক্ষন করার দায়িত্ব প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের।
স্মরণে থাকা উত্তম-জাতীর জনকের "সবুজ বিপ্লব" মেজর জিয়ার "যুব কমপ্লেক্স" এরশাদের "পথকলি ট্রাস্ট" খালেদা জিয়ার "ছাগল প্রকল্প" শেখ হাসিনার "একটি বাড়ী একটি খামার প্রকল্প" নিশ্চিত আগামীদিনের ইতিহাসের অংশ হয়ে দারিদ্র বিমোচনে অবদানের স্বীকৃতির সূচক নির্ণিত হবে। এর মধ্যে অনেক "রাষ্ট্র নায়ক আগামীর ইতিহাসবীদ
দের 'হাসির পাত্রে' পরিণত হবে, কারো অবদান 'কৃতজ্ঞচিত্তে' বিশ্লেষিত হবে। সুতারাং কোন অবস্থায় শেষ পয্যায়ের ভুলের কারনে সফল প্রকল্প যেন অসফলতার কালিমায় লুপ্ত হয়ে অতীতের ধারাবাহিকতায় পয্যবসিত না হয়; সেদিকে মনযোগ দেয়াই হবে সময়ের দাবি পূরণের উত্তম পন্থা।
ruhulaminmujumder27@gmail.com


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

বেয়োনেটের খোঁচায় জিয়াই শুরু করেন রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতপন বিশ্বাসদৈনিক জনকন্ঠ(মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ১৭ পৌষ ১৪২০)পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর অন্য কোন সরকার আর এই বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে আবারও যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দেশজুড়ে।স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে নানান মিথ্যাচার করে চলেছে। ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ক্ষমার আওতামুক্তরয়ে যায়। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল(অব) জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত ২০, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৬২ যুদ্ধাপরাধীসহ মোট ৭৫২ সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারকে মুক্ত করে দেন। এর পরই শুরু হয় এ দেশে রাজাকার পুনর্বাসন কার্যক্রম।রাজাকার পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় সামরিক ফরমান দিয়েসংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি তথা রাজাকারদের প্রকাশ্য রাজনীতির পথ উন্মুক্তকরেন। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।১৯৭৫ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) বিচারপতি সায়েম এক সামরিক ফরমান বলে ‘দালাল আইন, ১৯৭২’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত সারাদেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। একই সামরিক ফরমানে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই দালাল আইন বাতিলের ফলেট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সহস্রাধিক মামলা বাতিল হয়ে যায় এবং এ সকল মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ১১ হাজার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস মুক্তি পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, ৬২ যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পেয়ে যায় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকাররা বীরদর্পে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতা বহির্ভূত ছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর সরকারী যে ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল তার মুখবন্ধে এবং উক্ত ঘোষণার ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যারা বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইন, ১৮৬০ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি আইন, ১৮৬০ এর অধীন নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারা এ আদেশ দ্বারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়বেন না। এগুলো হলো- ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো); ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র); ১২৪ক (রাষ্ট্রদোহিতা); ৩০২ (হত্যা); ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা); ৩৬৩ (অপহরণ); ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ); ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা); ৩৭৬ (ধর্ষণ); ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি); ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তির কালে আঘাত); ৩৯৫ (ডাকাতি); ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি); ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি); ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন); ৪৩৬ (বাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার) এবং ৪৩৭ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান, পৃষ্ঠপোষকতা বা নেতৃত্ব দেয়া বা প্ররোচিত করা)।সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার অভিযুক্ত দালাল আইন, ১৯৭২ সালে বাতিল হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে রয়ে যাওয়া আরেকটি শক্তিশালী আইন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এ দুর্বল ভাষার ব্যবহার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বের একটি কারণ। আইনটির ৬ ধারায় বলা হয়েছে “দ্য গবর্নমেন্ট মে, বাই নোটিফিকেশন ইন দ্য অফিসিয়াল গেজেট, সেট আপ ওয়ান অর মোর ট্রাইব্যুনালস” অর্থাৎ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এই আইনের কার্যকারিতা। সরকার ইচ্ছা করলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। কিন্তু এই ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইন শর্তসাপেক্ষে প্রণয়ন করারফলে এর কার্যকারিতা দুর্বল হয়। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হতো তা হলে এটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব বাড়ত। আইনটি কার্যকর বা বলবত করতে তারিখ দিয়ে যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজন ছিল ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদের আগে তা করা হয়নি।১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে দালাল আইন, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর মধ্যে প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বেই বেকসুর খালাসপেলেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতার বাইরে থাকা পূর্বোল্লিখিত গুরুতর কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত ও আটকঅবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদেরও জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে। সে সময় এদের মধ্যে যেসব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের রায়ে ইতোমধ্যে সাজা ভোগ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর পরবর্তী কোন কোন সরকারের শাসনকালে রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ নামে কোন ভূখন্ডই চায়নি।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ‘বাংলাদেশ দালাল আইন, ১৯৭২” প্রণয়ন করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ অপরাধীর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ড প্রাপ্তহয়েছিল ৭৫২ অপরাধী। বাকি ২ হাজার ৯৬ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পায়। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০ রাজাকারকে। পরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং দালালির দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কিংবা তাদের বিচার বা শাস্তি প্রদানের বিষয়টি ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সালের আগে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের আর কোন ঘটনা বাংলাদেশে ইতোপূর্বে ঘটেন