`তিস্তার  অভিশাপে  বদর হিরামণি`  
                                     রুহুল আমিন মজুমদার

[অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত এই ধারাটি বিভিন্ন নদীপ্রবাহের মাধ্যমে গঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হতো। কথিত যে, ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের অতিবৃষ্টি একটি ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করেছিল এবং সেই সময় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়েছে। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিমি, তার মধ্যে ১১৫ কিমি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। তিস্তা একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এর অংশবিশেষ এখনও বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত।
    লেখকের কথা:-- শতবছর তিস্তা নিয়েছি যত দিয়েছিল তাঁর দ্বিগুন। তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০১৪ ইং সাল থেকে এককভাবে তিস্তা শুধু নিচ্ছেই,  ফিরিয়ে দেয়ার নাম নেই।তিস্তার ভাঙ্গনে শতবছরে বিলীন হয়েছে হাজারো জনপথ, ফিরিয়ে দিয়েছে নতুন নতুন বসতি।সর্বশান্ত করেছে লক্ষকোটি পরিবার,আমীর বানিয়েছে হাজার হাজার।তিস্তায় চলেছে নৌকা, জাহাজ আর এখন-- গরুর গাড়ীর চাকার নিছে পিষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত তিস্তা অববাহিকার লক্ষ মানব সন্তান। তিস্তার অভিশাপের বলি হয়ে জীবিকার সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েছে শহর, বন্দর, গ্রামে--'কাটছে তাঁদের জীবন মানবেতর।' গজল ডোবা বাঁধ তিস্তার দদুইকূলের মরণ ফাঁদ, উজানকে করছে শষ্যশ্যামল, ভাঁটিতে ঢেলে দিয়েছে তাঁর যত অভিশাপ।]

                     
                                       পর্ব (এক)        
     
    তিস্তা পাড়ের মেধাবী ছাত্র বদর। তাঁর মায়ের পুরাতন কঠিন এক হাঁপানী রোগ আছে।যখন রোগটি দেখা দেয়--তখন বদর ছাড়া আর কেউ দেখার নেই। অবশ্য বদর আলীর আরো দুই ভাই বর্তমান আছে। কিন্তু তাঁদের সংসার বড়। সময়মত ঔষদ পথ্য দিয়ে মা'য়ের সেবা আত্তি করবে, সেই সামর্থ্য কারো নেই। তাঁদের এলাকাটা এমনিতে গরীব এলাকা। বৎসরের বেশীর ভাগ সময় মঙ্গা লেগেই থাকে। ইদানিং তিস্তায় পানি না থাকায় দুর্যোগ বেড়েছে আগের চেয়ে বহুগুন। একদিন কাজ মিলে তো তিনদিন কাজ থাকে না। মাসের বেশীর ভাগ সময় পরিবার নিয়ে উপোষ করে কাটাতে হয়। বৃদ্ধ মা'কে সেবা শুশ্রুসা করার ইচ্ছা থাকলেও সামথ্যের অভাবে অন্য দুইভাই তেমন ভাবে এগিয়ে আসেনা।

    বদর আলী মা'য়ের ছোট ছেলে। বদর জম্ম নেয়ার তিনমাস আগে তার বাবা কলেরায় মারা গেছে। সে যে মা ভিক্ষায় নেমেছে--'আজো তার ভিক্ষার ঝুলি কোমর থেকে নামাতে পারেনি'। দুইছেলে পিঠাপিঠি জম্মের দীর্ঘ পাঁঁছবছর পর, আল্লাহর দরবার থেকে বদরকে খুঁজে এনেছে বদরের মা। বদর গর্বে আসার সাত মাসের মাথায় বদরের বাপ অকস্মাৎ কলেরায় মারা যায়। স্বামী হারিয়ে বদরের মা তরিকুন্নেছার, যারপরনাই চোখে মুখে অন্ধকার নেমে আসে।দুই ছেলের খাওয়া, পরা আগত ভবিষ্যতের সুস্থ্যভাবে পৃথিবীর আলোর মূখ দেখা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ে। ধারদেনা করে মৃত স্বামীর কল্যানে সম্ভব সবকিছুই করা হয়েছে। শরীরের এই অবস্থায় কারো বাড়ীতে ঝি, চাকরানির কাজও করা সম্ভব নয়। বদর জম্ম নেয়ার সাতদিনও পার হয়নি,শিশু বাচ্চাকে রেখেই  ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে তোলে নিতে বাধ্য হলেন। ভিক্ষার চালে তিন ছেলেকে অতি যত্নে বড় করেছেন। তিন ছেলেই গতর খাঁটার উপযোগি হতে না হতে দুইজন বিয়ে শা'দী করে বউ ঘরে তোলে এনেছে। বাপ মরা সন্তান, বুকে অনেক জ্বালা থাকলেও ছেলেদের মনে কষ্ট যাবে ভেবে, মূখ ফুটে আর কিছুই বলেনি বদরের মা।

     ছেলেরা বউ ঘরে এনে  কিছু কিছু রুজি রোজগার করা শুরু করেছে। মায়ের প্রতি বদরের বড় দুইছেলের কারো ভক্তি শ্রদ্ধার এমনিতে কোন অভাব নেই। ছেলেরা যেহেতু গতর খাটার উপযোগী হয়েছে, কিছু কিছু রুজি রোজগারও ধরেছে। বদরের মা'য়ের মুখে আবছা আবছা হাসির রেখা ফুঁটে উঠেছে। সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করেছে। দুই ছেলেরই একই কথা তাঁরা মা'কে আর ভিক্ষা করতে দিবে না।  ছেলের নির্দেশ, মা তুমি অনেক কষ্ট করেছ, এবার নামাজ কলমা পড়, আল্লাবিল্লা কর, বাড়ীতে থাক, বউদের পয়:ফরমায়েস দিয়ে সংসার চালাও। আমাদের দুই ভাইয়ের রুজীতে ইনশাল্লা আমরা দাঁড়াতে পারব।বদরকেও আগামী বছর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। বদরেরও বয়স কেবল কম হয়নি, এই চৈত্র পার হলে আট বছর পার হয়ে নয় বছরে পড়বে।যদিও শরীর স্বাস্থে আরো একটু বেশিই মনে হয়।বয়স হোক তাতে কি, নতুন করে ছোট ভাইকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।আমরাতো লেখা পড়া করতে পারিনি, বদরকে ইনশাল্লাহ লেখাপড়া শেখাব। বদর চাকুরি করবে, অফিসার হবে, মা তুমি দোয়া কর।

     সুখেই দিনকাল যাচ্ছিল বদরের মা'য়ের।দেখতে দেখতে পাঁছটি বছর কেটে গেল। বদর ও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, ক্লাস ফাইভ পাস দিয়েছে। পাশ ও খুব ভালই হয়েছে, আগের তিনজনকে ডিঙ্গিয়ে এবার বদর প্রথম হয়েছে।বদরের ইচ্ছা হাই স্কুলে ভর্তি হবে।এবার মাসে মাসে বেতন দিতে হবে, বইয়ের দামও অনেকবেশি, স্কুলের নতুন ড্রেস কিনতে হবে।  স্কুলটাও অনেক দূরে, দুই ইউনিয়ন পার হয়ে যেতে হবে।দশ বার মাইল পায়ে হেঁটে স্কুলে আসা যাওয়াও সম্ভব নয়।

    পাশের বাড়ীর মাতব্বরের মেয়ে হিরামনও বদরের সঙ্গে পাস দিয়েছে। মাতব্বরের মেয়ে আগের চার ক্লাসে প্রথম হলেও এবার বদরের পরে রোল নম্ভর চলে গেছে। মেয়েটি চেহারা,গতর খুবই সুন্দর ও নিরহংকারী, বদরের মনে হয়েছে ক্লাসে প্রতিযোগীতায় বদরের নিকট হেরে যাওয়াতে কোন ক্ষোভ জাগেনি হিরামনের। বদর মনে মনে চিন্তা করে হিরামন উপরের গায়ের রং যেমন সুন্দর ভিতরের মনও নিশ্চয়ই সুন্দর। পরিক্ষার ফল প্রকাশের পর সবার আগে মেয়েটিই তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েছে।ধন্যবাদ দিতে এসে বলেছে বদর ভাই--তুমি প্রথম হয়েছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমিতো জান- নভেম্বর মাসটা  আমি খুবই অসুস্থ্য ছিলাম, স্কুলে আসতে পারিনি, পড়ালেখাও তেমন করতে  পারিনি। বদর বলে--আমি তোমার চাচাতো ভাই তমিজ উদ্দিনের কাছে শুনেছি, তুমি অসুস্থ্য ছিলে, কিন্তু কি অসুখ ছিল, সে তো আমাকে বলতে পারেনি।এই কথা শুনে হিরামন লজ্জাবনত: চিত্তে মুচকি হেসে বলে- "ছেলেদের ঐ সমস্ত অসুখের কথা শুনতে নেই"।

    অল্পবয়স হলে কি হবে, লম্বায় এবং স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বদর এমনিতে ক্লাসের সবার উপরে, চেহারা নাদুসনুদুস, সুন্দরও বটে।তার উপর ক্লাসে এবার প্রথমও হয়েছে সে।যে কোন মেয়ে প্রথম নজরে পছন্দ করার মত সব গুনাগুন বদরের মধ্যে উপস্থিত রয়েছে। সরলতা, বিশ্বস্ততা, আচার, আচরন, ব্যবহার, জ্ঞান, উপস্থিত বুদ্ধি যে কোন খুঁতখুঁতে মানুষকেও আকৃষ্ট না করে পারেনা। ক্লাসেও বরাবর ভাল ছাত্র হিসেবে সবাই সমীহ করে কথা বলতো আগে থেকে। গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে এমনিতেই ছাত্রছাত্রী সংখ্য নগন্য।

    মঙ্গা পীড়িত অভাবি এলাকার বাবা মা, ছেলে মেয়েদের স্কুলে না পাঠিয়ে  তিস্তার চরে মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙ খোঁজাকেই লাভজনক মনে করে। দুপুরের একবেলা ভাতের চুক্তিতে ছেলেরা মহাজনের গরুর পাল নিয়ে তিস্তা পার হয়ে ভবের চরে চলে যায়।সকালে মহাজনের ঘর থেকে ভাসন ভর্তি পান্থাভাত সাথে কয়টি লালমরিচ সাথে নিয়ে গোশালা হতে গরু নিয়ে বের হয়।তিস্তা তিস্তা পাড়ে পরনের ছেড়া লুঙ্গি,গায়ের গেঞ্জীটা দিয়ে হাতে নেয়া ভাতের ভাসন উপোড় করে বেধে নেয়।বড় গরুটার শিংয়ের মাথায় ভাসনটি প্যাচ দিয়ে বেঁধে দিয়ে অন্য আর একটি গরুর লম্ভা লেজ ধরে, তিস্তা পাড়ি দিয়ে ওপারের চরে যেতে হয়।, সারাদিন গরু চরানোর ফাঁকে, খেলাধুলা আর মাছ, ব্যাং, কাঁকড়া খুঁজে বেড়ানোই তাঁদের সব রাখালের কাজ। চরের ফাঁকে ফাঁকে তির তিরে পানির নালায় প্রচুর মাছ, ব্যাং, কাঁকড়া পাওয়া যায়।সারা দিনমান যাই খুঁজে পায় বাচ্চা ছেলেরা, তাতে অন্তত: বাবার সারাদিনের খাঁটা খাঁটুনীর পর, যে কয়টা টাকা গৃহস্ত হাতে গুজে দেয়, তাঁর সাথে ভাঁজ দেয়া যায়। মহাজন ক্ষেতে কামলার বিনিময়ে যে টাকা দেয় সে টাকায় চারজনের পরিবারের  একদিনের চাল কেনার টাকাও অনেক সময় হয়না। ছেলেদের কুড়ানো মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙ পাশের হাটে বিক্রি করে অন্তত: বাকি টাকার অভাব, নিদেন পক্ষে একপদ শাক লতাপাতার টাকা যোগান দেয়া সম্ভব হয়।মেয়েরা তিস্তার তীরে শাফলা, শালুক, চিংড়ির পোনা, ছোট ছোট মাছ কাপড় বিঁচিয়ে যা পায়, তাতেও কেবল মন্দ টাকা হয়না। পাঁছ, সাত টাকা হাটে সহজেই বিক্রি করা যায়। স্কুলে দিলে তো আর সেই টাকাটা পাওয়া যাবে না।

    অল্প বয়সের বদর হিরামণির মুচকি হাসির তাৎপয্য তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারেনি, অবশ্য তেমন ভাবে বুঝার চেষ্টাও করেনি সেদিন। বদর স্কুল আঙ্গিনায় খুবই ব্যস্ত সময় পার করেছে।এদিক সেদিক থেকে বন্ধুরা সবাই ডাকাডাকি করে তাঁদের মনের উৎফুল্লতা প্রকাশ করছিল, শিক্ষককেরাও খুশী প্রকাশ করতে কার্পন্ন করেনি।একদিকে গ্রামের স্কুলের পাঠ শেষ, সকল বন্ধুবান্ধবের বিদায়ের পালা। অন্যদিকে এক নম্বরে পাস দেয়াতে তার বেলায় আলাদা আর একটা গুরুত্ব যুক্ত ছিল। সবমিলিয়ে  বদরের যারপরনাই হাঁসফাঁস অবস্থা। হিরামণির ইঙ্গিতপূর্ণ হাসির মর্ম সন্ধানের সময় কোথায়?

    সেদিন স্কুলের সব শিক্ষক অন্যদিনের তুলনায় খুব বেশীই যেন আদর করেছে, উপদেশ দিয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে বদরকে যে কোন উপায়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে তাঁর বাড়ীতে যাওয়ার কথাও বলেছে। বিদায় বেলায় দু'শ টাকা হাতে গুজে দিয়ে বলেছে--এই টাকাটা রাখ বাঁছা। আমি তোমাকে এমনিতেই দিলাম, তোমার মা'য়ের জন্যে কিছু বাতাসা কিনে নিও।তোমার মা'  খুবই খুশী হবে।প্রধান শিক্ষিকা জানতেন-বদরের হাই স্কুলে পড়ার সামথ্য নেই, যদি ছেলেটা লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়, অকালে একটা মেধা সমাজ থেকে ঝরে যাবে।

      এই কয়দিন হাজারো ভাবনার মধ্যে বদরের, একটি ভাবনাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে--প্রধান শিক্ষিকার শেষ কয়টি উপদেশ। যে কোন মুল্যেই তুমি লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। বিশেষ অসুবিধায় তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করবে। প্রয়োজনে আমার বাড়ীতে যাবে।তোমাকে অনেক বড় হ'তে হবে, দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। তোমার ছায়ায় আমি সেই আশ্বাস পাচ্ছি, তুমি অবশ্যই পারবে, আমি প্রানভরে তোমার জন্যে দোয়া করব।

      ভাবনায় কি আর সফলতা আসে? এমনিতে অভাবের তাড়নায় মা'কে রেখে বাকি দুই ভাই চলে গেছে বউ পোলাপান নিয়ে অজানা উদ্দেশ্যে।গত একবছর মা'য়ের শরীরটাও খুব বেশি ভাল যাচ্ছিল না।একদিন ভিক্ষায় যায় তো তিন দিন পড়ে থাকে বিছানায়। পুরাতন হাঁপানিটা যেন কিছুতেই ছাড়ছে না। এক এক বার ধম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।গত তিনমাস মা'য়ের জন্যে একটি ট্যাবলেটও এনে দিতে পারেনি বদর।পরিক্ষার পর ছুটির ফাঁকে তিস্তার তীরে কাপড় বিছিয়ে যা সামান্য মাছ ধরেছে, সেই মাছ বিক্রি করে মা-ছেলের একবেলা ভাতের টাকাও হয়নি, মায়ের ঔষদ আনবে কিভাবে। মা'য়ের শরীর ভাল থাকলে  ভিক্ষা করে কিছু চালপাতি পাওয়া যেত, গত তিনমাসে তাও সম্ভব হয়নি।
    মাতব্বর তাঁর মেয়েকে আনা নেয়ার জন্যে কলিমুদ্দিনের গরুর গাড়ী চুক্তিতে ভাড়া নিয়েছে।বদরই এই খবর বলেছে  তাঁর মা'কে। যাহাই হোক,  ভাইকে যতটাকাই খরছ হোক লেখাপড়া শিখাতে হবে।

     বদরেরও গাঁ-গতর খাটার সময় হয়েছে। দুই ভাইয়ের ছেলে সন্ততিতে ঘর সরগরম হয়ে উঠেছে। নাতি, নাতনিদের নিয়ে বদরের মা সর্বক্ষন মেতে থাকা যেন অভ্যেসে পরিনণত হয়েছে।সুখের সংসারে অকস্মাৎ বিপদের হাতছানি। ময়ালময় মঙ্গার হাতছানী, কাজ নেই কোথাও। পানির অভাবে ক্ষেতে খামারে চাষাবাদ একরকম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একদিন গ্রামের পাশ ঘেঁষা বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদী স্বপ্নের তিস্তায় পানির স্রোত স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের মানুষ বলাবলি করছে ভারতের উজানে সরকার বাঁধ নির্মান করেছে, সুতারাং তিস্তায় আর পানি কখনই আসবেনা।অনেকের ধারনা, বাঁধ হয়েছে তো কি হয়েছে, সময়মত পানি অবশ্যই আসবে। অপেক্ষার পালা শেষ হয়না, তিস্তা শুকাতে শুকাতে কাঠ হয়ে গেছে, পানিতো আর আসে না। অঞ্চলময় খাদ্যের অভাবে প্রতিটি পরিবার দিশেহারা, ইতিমধ্যে অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে অজানা পথে।কেউবা আশ্রয় নিয়েছে চার পাঁছ দিন পায়ে হেঁটে ঢাকা শহরের কোন কোন বস্তিতে।
     তিস্তার অববাহিকার মঙ্গার ছোবল বদরের পরিবারকে ক্ষনে ক্ষনে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে।ঘরে তোলে আনা ছেলের বউরা আর শাশুড়ীকে খাওয়া পড়া দিতে রাজী নয়।তাঁদের সাফ কথা, আমাদের ও সংসার আছে, ছেলে পুলে আছে। এখন থেকে কিছু জমাতে না পারলে সংসার চলবে কি করে ? দুই বউয়ের নিত্য খোঁটার মুখেও বদরের লেখাপড়ার চিন্তা করে মা কোন কথা বলা থেকে বিরতই থাকে।

         মঙ্গার ছোবলে বদরের মায়ের পরিবারে দুয্যোগের হাওয়া যেন একটু বেশিই লেগেছে।গ্রামের অন্যদের দেখাদেখি দুই ছেলে অজানার উদ্দেশ্যে মা,ভাইকে রেখে চলে গেছে।অভাবের তাড়নায় বৃদ্ধ রোগগ্রস্ত মা এবং সরকারি কর্মকর্তা বানানোর বিলাসী ভাবনার আদরের ছোট ভাই বদরের কথা ভূলে গেছে।গত একবছর যাবৎ বদর ভাইদের খবর নেয়ার চেষ্টা করেও পায়নি। ভাইয়েরা মাকে ফেলে যাওয়ার পর, মা আবারও ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে রোজ সকালে গাইবান্দা শহরে চলে যায়,ফিরে অনেক রাত। মায়ের কষ্ট দেখে বদর সিদ্ধান্ত নেয় পঞ্চম শ্রেনীর বার্ষিক পরিক্ষাটা দিয়ে, সে আর লেখা পড়া করবেনা। অসুস্থ্য মা ভিক্ষা করে আনবে, সে লেখা পড়া করে অফিসার হওয়ার কোন দরকার নেই। তার চাইতে বরং সে নিজে মহাজনের বাড়ীতে কাজ করবে,মা ঘরে বসে চারটা ভাত রান্না করে দিলেই হবে।আর মাত্র চার মাস পর পরিক্ষা,চার মাসের জন্যে এখনই পড়া লেখা ছেড়ে দেয়া উচিৎ হবেনা।

        বার্ষিক পরিক্ষার মাঝামাঝি মা'  ভিষন অসুখে পড়ে, কি আর করা।সারা রাত মায়ের সেবা করে সকালে পরিক্ষা দিয়ে এসেই নদীর ধারে চলে যায় বদর।সন্ধায় ছোটমাছের চালান, চিংড়ি মাছের পোনা নদীর খুব কিনারায় চলে আসে, ভাল একটা জাল পেলে বেশ কিছু মাছ ধরা সম্ভব হ'ত। তাতো নেই- অগত্যা মায়ের পুরাতন ছেড়া কাপড় দিয়ে ছেঁকে ছেঁকে যা পায় সেই গুলী কোন কোন দিন রাতে আর বিক্রি হয়না, অনিচ্ছা সত্বেও বদর নিজেই রান্না করতে হয়।যেদিন মাছ রান্না করার প্রয়োজন হয়, সেই দিন আর বই নিয়ে বসতে পারেনা।পড়া লেখা যেহেতু আর করা সম্ভব হবে না, এত ভাল ফলাফলের প্রয়োজনই বা কি। যাই পারে তাই দিয়ে তাড়াতাড়ি পরিক্ষার হল ছেড়ে নদীতে যাওয়াই মূর্খ্য হয়ে উঠে বদরের নিকট। পরিক্ষা শেষ করেই বদর গ্রামের মহাজনের বাড়ীতে যায়,যে বাড়ীতে বদরের বাপ দাদা আমৃত্যু কাজ করেছে।ছাগলের পাল, গরুর পাল, ক্ষেতের কাজ যে কোন একটি কাজ হলেই হল।মহাজন জানে বদরের গৃহস্তি কোন কাজের পুর্ব অভিজ্ঞতা নেই, মহাজন তেমন আগ্রহ দেখায় না।এমনি করে আসপাশের গ্রামের প্রায় সব মহাজনের বাড়ীতেই ধর্ণা দিয়েছে কিন্তু কেউই কাজে রাখেনি বদরকে।

       বদরকে কাজ না নেয়ার কারন শুধু অভিজ্ঞতা নেই তাই নয়,মহাজনদের অনেকেই গরু,ছাগলের পাল বিক্রি করে দিয়েছে।তিস্তার চরে আগের মত ঘাস এখন আর নেই।তিস্তা শুকিয়ে ধুঁধুঁ বালুচর হয়ে গেছে।চাষাবাদ প্রায় বন্ধ।প্রমাত্ম তিস্তা রুপ নিয়েছে তির তির স্রোতের নালার রুপে। ঐ টুকুন পানিতে তিস্তার বালুচরে আলু, গম, মশারি, খেসারি ছাড়া ধান চাষ করা যায়না। জোরদার মহাজনেরা চর দখল করে সেখানে আলু পটলের চাষাবাদ শুরু করেছে।আগের মত একাধিক কাজের মানুষ, মহাজন বাড়ীতে আর এখন দরকার পড়ে না। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কাজের সন্ধানে অজানা উদ্দেশ্যে আগেই বেরিয়ে গেছে।যারা আছে তারাও যাই যাই অবস্থায়।বদরের বন্ধুদের অনেকেই চলে গেছে, বদরও চিন্তায় আছে বেরিয়ে পড়বে কিনা।ঘরে মাকে অসুস্থ্য রেখে বদর বের হতেও পারেনা,অসুস্থ্য মাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াও ঠিক হবে বলে মনে করেনা বদর। বদরের মনের এই চঞ্চলতা মা টের পেয়েছে। মা বদরকে কাছে নিয়ে বলে-বাঁছাধন তুই সারাদিন কোথায় যাছরে বাবা, কেন তুই কাজের সন্ধানে প্রতিদিন বের হয়ে যাছ?আমি ভাল হয়ে যাব,শহরে চলে যাব, কারো বাসায় ঝিয়ের কাজ করব বাবা--তুই পড়া লেখা কর।তোর কাজের চিন্তা করার দরকার নাই--রে বাবা।

    ইতিমধ্যে মায়ের অসুখ আরো বেড়ে গেছে, স্কুলের ফল প্রকাশের সময়ও ঘনিয়ে এসেছে।ফলের প্রতি তেমন আগ্রহ এখন আর বদরের মনে ঠাঁই পায়না, মায়ের অসুখই বদরের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে।যে করে হোক মা'কে সুস্থ্য করতেই হবে।মা সুস্থ্য হলে মাকে নিয়ে বদর শহরে চলে যাবে।শহরে নাকি  হোটেল, গার্মেন্টস, বাসাবাড়ীতে অনেক কাজ পাওয়া যায়।গত তিনমাসে মায়ের জন্য কোন ঔষদ পথ্য বদর কিনে আনতে পারেনি। বদরের মর্মপীড়ায় রাতে একফোঁটা ঘুম চোখে আসেনা। দুনিয়াতে মা ছাড়া বদরের আর কেউ নেই,মাকে হারালে তাঁর বেঁছে   থাকার  কি মুল্য? দুই ভাই মা'কে ছেড়ে চলে গেছে,বদরও যদি চলে যায়, মা কাকে নিয়ে বাঁঁচবে।

      বদরের মানষিক যন্ত্রনা মা বুঝতে বাকি রইলনা।তিনি কঠিন সিন্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন,যে কোন ভাবেই হোক বদরকে লেখাপড়া শিখাবেন।অন্যদিকে বদরও কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে মাকে ভিক্ষায় রেখে সে কোন ভাবেই পড়ালেখা করতে পারেনা।মহান আল্লাহ মা, ছেলের এমন অঙ্গিকার দেখে দূর থেকে মনে হয় মিটি মিটি হাসছিল।রাতেই বদরের মা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখে, তিনি গ্রামের মাতব্বরের নিকট গিয়ে শেষ চেষ্টা করবেন।এতে যদি বদরকে বিনিময়ে কোরবানীও দিতে হয় তারপরও তিনি বদরকে লেখাপড়া শেখাবেনই।

  পরের দিন বিকেলে ঠিক মজলিশের সময়ে বদরের মা হাঁপাতে হাঁপাতে লাঠির উপর ভর করে মাতব্বরে বৈঠক খানার এককোনে গিয়ে ছেড়া মলিন কাপড়ের একোনা ওকোনা কোনরকমে টেনেটুনে বসে পড়েন। মাতব্বর তখন মজলিশে বসে গ্রামের সবার সাথে তিস্তার ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করছিল।আগামী দুই একবছরের মধ্যে তিস্তা সংকট সমাধান না হলে অত্র এলাকা বালুভুমিতে পরিনত হবে।রাজধানীর সংঙ্গে যোগাযোগ করে  তিস্তার বর্তমান সংকট সরকারের দৃষ্টিতে নেয়ার দায়িত্ব গ্রামবাসি মাতব্বরের উপর দিতে চায়।মাতব্বর এতে একেবারেই রাজী হচ্ছেন না। রাজী না হওয়ার কারন ও তিনি সবাইকে সামনা সামনিই বলে দিয়েছেন। তিনি কোন রাখ ঢাক করে কথা বলেন না। যাকে যা বলার সামনেই বলে দেন।এই কারনে অনেকেই তাঁর সমালোছনা করেন। অবশ্য  অকপটে সত্য কথা সামনে বলার জন্য মনে মনে অনেকেই খুশিও হন। গেলবার ইউপি পরিষদ নির্বাচনে এই গ্রামের মানুষ আমাকে ভোট দেয়নি।বেশির ভাগ মানুষ তাঁর বর্গা জমি চাষ করে, তাঁর গরু, ছাগলের পাল অনেক পরিবারের বাচ্ছারা লালন পালন করে। কিন্তু ভোটে দাঁড়ানোর পর তাঁকে অনেকেই ভোট দেয়নি।পাশের গ্রামের দবির উদ্দিন তাঁর নিজ কেন্দ্রে দুইশ ভোট বেশি পাওয়ার কারনে জিতে গেছে।এখন এই গ্রামের মানুষের সমস্যা দেখার দায়িত্ব নির্বাচিত প্রতিনিধির।আমি গেলেও কোন কাজ হবে না, সুতারাং আমার উপর দায়িত্ব দিয়ে গ্রামবাসির কোন লাভ হবেনা।

    আপনারা তিস্তা বিষয় আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হব।তিস্তা পাড়ের লাখ মানুষের ভাগ্যের সাথে আমার ভাগ্যও জড়িত,সবার অ-মঙ্গল হলে আমারও অ-মঙ্গল হবে। তিস্তা ব্যাপারটি আন্তদেশীয় সমস্যা।বিগত দিনে অনেক সরকারই তো বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল---কেউ তো ভারত সরকারের নিকট বাংলাদেশের জীবনমরন সমস্যা, তিস্তা সম্পর্কে আলোচনা করেনি।বর্তমান সরকার আপাত: দেখা যায় খুব জোর প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে--দেখা যাক কি হয়।৪০ বছর যেখানে কষ্ট করেছি, সেখানে ৪ বছর ধৈয্য ধরায় সমস্যা  হওয়া উচিৎ নয়।আযান হয়েছে চলেন সবাই নামাজ পড়ি বলে মজলিশ আজকের মত তিনি ভেঙ্গে দিয়ে বৈঠক ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

    কক্ষ থেকে বের হতেই বদরের মায়ের উপর চোখ পড়ে, কি বদরের মা, তুমি কখন আসলা।বস বস, আমি নামাজ পড়ে আসি।নামাজ আদায় করে এসে বারান্দায় চেয়ার টেনে বদরের মা'কে ডাকলেন মাতব্বর।বদরের মা লাঠি ভর দিয়ে পায়ের কছে বসে বলতে লাগলেন---মাতব্বর সাহেব, সারাজীবন বদরের বাপ আপনার বাড়ীতে কামলা খাইটা গেছে।আমিও যতদিন শক্তি ছিল ততদিন আপনাদের কাজ করে দেয়ার চেষ্টা করেছি।কোন দিন তো কিছুই চাইনি।আজ একটা আবদার নিয়ে আপনার কাছে এলাম।যদি দয়া করেন আমার ছেলে বদর আপনার বদন্যতায় লেখা পড়াটা করতে পারবে।বদর এবার স্কুলে বড় পাস দিয়েছে, ওরে আমি লেখা পড়া শেখাবার চাই।তাঁর ভাইয়েরা তাঁরে রাইখা চলে গেছে।বদর কয়--সে আর লেখাপড়া করবে না।হাই স্কুলে অনেক টাকা খরছ পাতির দরকার হয়।

    মাতব্বর সব কথা মনযোগ দিয়ে শুনে বলেন--দেখি আমি কি করতে পারি, তুমি চিন্তা করনা।এখন তুমি যাও, বদরকে তুমি আমার কাছে দুই চার দিন পর পাঠিয়ে দিও। বদরের মায়ের যেন অর্ধেক অসুখ ভাল হয়ে গেছে। লাঠি ভর করে বাড়ী আসতেই বদর বলে--মা আমি কতক্ষন থেকে তোমারে ডাকছি, তুমি কই গেছিলে। তোমার জন্যে ঔষদ আনছি, এই নাও এটা খেয়ে শুয়ে পড়, আমি নদীর ধার থেইক্কা ঘুরে আসি, দেখি কয়টা মাছ পাওয়া যায় কিনা।

     মাতব্বর সাহেব বদরের মা'কে বিদায় দিয়ে অন্দরে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে।মাতব্বরে মাত্র দুটি মেয়ে। ছোট মেয়ে পরিমনী জম্মের দুই মাস পর হঠাৎ রক্তবমন শুরু হয় তাঁর মায়ের। জেলা শহর গাইবান্ধায় ডাক্তারের নিকট পৌঁছানোর আগেই মৃত্যু বরন করে।দুই মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয়বার আর বিয়ের করার সাহষ করেননি।পৈত্রিক সুত্রে তিস্তার ভাঙ্গনে বহু সম্পত্তি বিলীন হওয়ার পরেও, এখনো দুইশ একরের উপর চাষাবাদ যোগ্য ভূমি আছে। এই সমস্ত ভূমি তাঁর অবর্তমানে দেখাশুনার জন্যে ভাল একটা ছেলে বহুদিন আগে থেকে মনে মনে খুঁজছিলেন।বদর সম্পর্কে লোক মুখে যাহাই শুনেছে, মনে হচ্ছে ছেলেটা মন্দ নয়।হিরামনির সাথে নাকি একই ক্লাসে পড়ে। ছেলেটাকে যদি রেখে দেই কেমন হবে--।

      পরিমনি এখনও ছোট সবেমাত্র তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে।তাঁকে সকাল বিকাল পড়ানোর জন্যেও একজন গৃহ শিক্ষকের প্রয়োজন আছে।শুনেছি বদর ছাত্র হিসেবে খুবই ভাল।ইংরেজি, বাংলা, আরবি সবকিছুই পড়ানোর যোগ্যতা রাখে। হিরামনি এতদুরের হাইস্কুলে যাওয়া আসা করবে, তারও একজন সঙ্গি হলে নিশ্চিতে থাকা যাবে।আপাতত: গৃহ শিক্ষক হিসেবে রেখে দিলে পরবর্তিতে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহন সম্ভব হবে। মাতব্বর চিন্তামগ্ন হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন বুঝতেও পারেননি। হিরামনি কয়েকবারই এসেছে রাতের ভাত খাওয়ার জন্যে বাবাকে উঠাতে, কিন্তু ডাকার সাহষ পায়নি।

    বদর অল্প কিছু ছোট মাছ নিয়ে নদী থেকে বাড়ীতে এসেছে।মায়ের শরীর খারাপ ভেবে আর জাগায়নি।নিজেই বসে বসে মাছগুলি কেটে কুটে ধুয়ে রান্নায় বসিয়েছে। মাছ পাতিলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে রাধতে রাধতে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহোদয়দের উপদেশ গুলি নিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছে।আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে--সে আর লেখাপড়া করবে না।মা সুস্থ্য হলে সে শহরে চলে যাবে।ভাল কোন কাজ পেলে মা'কেও পরে সাথে নিয়ে যাবে।এদিকে কখন যে পাতিলের পানি শেষ হয়ে মাছ পোঁড়া ধরেছে বুঝতেই পারেনি।মাছ পোঁড়া গন্ধে মা ঘুম থেকে জেগে বদরকে ডেকে ডেকে বলে- বদর চুলায় কি পড়েছে দেখতো বাবা।কি পোঁড়া গন্ধ বের হয়েছে দেখ দেখ।মায়ের কন্ঠের আওয়াজে বদরের সম্বিত ফিরে আসলে দেখে বরবাদ হয়ে গেছে। মাছ পূঁড়ে পাতিলের তলায় আগুন জ্বলছে।তাড়াতাড়ি পাতিলটাকে কাঠ দিয়ে ঠেলে চুলার বাহিরে ফেলে দেয়।ভাতও পাতিলের নিছে পোঁড়া ধরেছে। ভাতের পাতিল নামিয়ে চিন্তা করে মা এবার ভাত খাবে কি দিয়ে।ঘরেতো তেমন কিছুই নেই। দুইটি শুকনা মরিছ আগুনে ধরে পূঁড়িয়ে নিয়েছে।মাকে ডেকে ভাত নিয়ে মা  ছেলে মরিছ দিয়ে চারটা মুখে দিয়ে পানি খেয়ে কোনরকম আজকের রাতটা কাটিয়ে দিল।

    সকালে মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে চোখ দুটি ধুয়ে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলে মা জিজ্ঞেস করে---কোথায় যাস বাবা।বদর বলে দেখি মা, পশ্চিম পাড়ার চৌধুরী সাহেব  বাড়ী এসেছে, উনার কাছে গিয়ে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।মা বলে বদর, তোমার এখনও চাকুরির সময় হয়নি, এত অল্প লেখা পড়ায় চাকুরি হয়না বাছা। তুমি আরও লেখাপড়া কর।তুমি হাইস্কুলে ভর্তি হবে।আমি মাতব্বরকে বলেছি, তোমাকে দেখা করার জন্যে বলেছে মাতব্বরের সাথে। মায়ের সারাদিনের ভিক্ষায় বদর কখনও কিছু মনে করেনি---নিয়তির লিখন মেনে নিয়েছে।মাতব্বরের বদন্যতার কথা শুনে বদরের আঁতে যেন ঘাঁ লেগেছে।

    অন্যের সাহায্যের উপর নির্ভর করে বদরকে লেখাপড়া করতে হবে, এই যেন মেনেই নিতে পারছেনা।বদর মা'কে সরাসরিই বলে--"মা আমি আর পড়বো না, মাতব্বরের সাথে দেখা করার প্রয়োজন নেই।"এই কথাটি বলেই বদর হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চৌধুরী বাড়ী কেবলই কাছে নয়, অনেকটা দূর পথা হেটে যেতে হয়।বদর হাঁটা পথেই একাএকা চিন্তায় পড়ে গেছে।চোখের সামনে ভেসে উঠেছে হিরামনির চেহারা। 'ছেলেদের জানতে নেই মেয়েদের অসুখের কথা' বলে মুছকি হাসিটা সেদিন কেন দিয়েছিল হিরামনি? হিরামনি কি বুঝাতে চেয়েছিল সেদিন? ধুৎ আমি কি চিন্তা করি বলে--নিজেই নিজের উপর বিরক্তি ঝেড়ে, জোর কদমে পথ চলতে থাকে।

    চৌধুরী সাহেবের ফটকে পৌঁছে বদর গেইট কিপারকে জিজ্ঞেস করে সাহেব ভিতরে আছেন কিনা।গেইট কিপার বলেন- সাহেব এক্ষুনি ঢাকায় রওয়ানা দেয়ার জন্যে রেডি হচ্ছেন।ভেতরে যেতে চাইলে গেইট কিপার বলেন সাহেবের অনুমতি নেই,আপনাকে কি সাহেব কার্ড দিয়েছে আগে দেখা করার জন্যে?বদর বলেন না, উনার সাথে আগে কখনই দেখা হয়নি।গেইট কিপার বলেন--কার্ড ছাড়া দেখা করার কোন সুযোগ নেই, আপনি যেতে পারেন। বিফল মনরথ হয়ে বদর বাড়ীর পথে পা বাড়ায়।

      বাড়ীতে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেছে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুদা।মাকেও সকালে কিছু খেতে দেইনি বদর।তাড়াতাড়ি উননে ভাত চাপিয়ে উঠানের দক্ষিন পাশে বারমাসি বেগুন আনতে যায় বদর।এমন সময় বাড়ীর মূখেই সুশ্রি একটা মেয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে আর এগুচ্ছে।বদর প্রথমে চিনতে পারেনি মেয়েটি কে? বদরের হাতে বেগুন রাখার খলি, দুইটা বেগুন সবেমাত্র তুলে খলিতে রেখেছে।এমনি মেয়েটি ডাক দিয়ে বলে--"বদর ভাই মেহমান আসতেছি।বেগুন দিয়ে খাবনা, মোরগ পোলাও খাওয়াতে হবে"। দাওয়াত করে এনে বেগুন কেন তুলতে গেলে। বদর সাহাস্য বদনে এগিয়ে এসে বলে---মেহমান যখন এসেই গেছে একটা কিছু তো খাওয়াতে হবেই।কি ব্যাপার তুমি এই সময়ে কোত্থেকে এলে? কোথাও গিয়েছিলে নাকি? হিরামনি বলে না কোথাও যাইনি,আব্বু পাঠিয়েছে তোমাকে ডেকে নিয়ে যেতে।তুমি নাকি আব্বুর কাছে গিয়েছিলে, কি কাজের জন্যে? বদর বলে সেতো একমাস দেড়মাস আগের কথা, এতদিন পরে কেন ডাকবেন? হিরামনি বলে--সে আমি কি জানি,তখন হয়ত কাজ ছিল না,এখন কাজ হয়েছে, এমন হতে পারে!  বদর বলে তুমি বস, আমি মায়ের জন্যে ভাত গুলো রেঁধে তারপর একত্রে কথা বলতে বলতে দুইজন যাব।হিরামনি বলে---আব্বু তো আমাকে বলেনি একত্রে যেতে,বলেছে ডেকে নিয়ে আসতে।বদর বলে ঐ একই কথা।কেন আমার সাথে যেতে কি তোমার সমস্যা আছে? হিরামন বলে, অবশ্যই সমস্যা আছে।তোমার সাথে কেন যাব,আমি একা এসেছি একাই যাব।তুমি তোমার সময় করে যাবে। এতক্ষন বদরের মা তাঁদের দুইজনের কথাই শুনছিলেন।এবার হিরামনিকে ডেকে বলে---মনি এদিকে আয় মা, বস,  বদর যাবে, এক্ষুনি যাবে।বদর তুই যা আমি ভাত রাঁধতে  পারব বাবা।দুপুর হয়ে গেছে মেয়েটি মনে হচ্ছে ভাত খায়নি, দোকান থেকে কিছু নাস্তা এনে দেনা বাবা।হিরামনি বলে না থাক নাস্তা এখন খাবনা--বদর ভাই দাওয়াত করে ভাত না খাওয়ালে বাড়ীতে যাইয়াই  খাব।

     বদর হাতের খলিটা রেখে ঘরে এসে গেঞ্জিটা গাঁয়ে দিয়ে দোকানে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। এমনি হিরামনি বলে---তুমি যদি এখন দোকানে যাও, আমি এদিক দিয়া চলে যাব,তোমার নাস্তা কে খাবে? ভাত খাওয়ালে খাব, নাস্তা পাস্তা কিচ্ছু খেতে চাইনা।হিরা জানে এই মহুর্তে বদর তাকে কোন অবস্থায়ই ভাত খাওয়াতে পারবেনা। ভাত সবে মাত্র উনুনে বসিয়েছে, ,তরকারি এখনও কূটা হয়নি, খাওয়াবে কিভাবে? বদরের মা বলে--বদর তুই তাঁর সাথে পারবি নারে বাপ, বরং তুই যা, আমি ভাত রাঁধতে রাঁধতে মাতব্বরের কথা শুনে এসে ভাত খাবি।

   এতক্ষন পয্যন্ত হিরামনি বলেনি তাঁর বাবা বসে আছে বদর সহ একত্রে বসে ভাত খেতে খেতে কথা বলবে বলে।হিরামনি জানে ভাতের কথা শুনলে বদর পরে আসব বলে হিরামনিকে বিদায় করে দিবে। বদর ঘরে গিয়ে সার্ট গাঁয়ে চাপিয়ে রওয়ানা দিয়েছে।যেতে যেতে কথা বলবে মনে করে কোন কথাই আর বলতে পারেনি।হিরামনিও বার বার তাকিয়েছে বদরের মুখের দিকে কিন্তু কোন কথাই বলেনি।বাড়ীর সদর দরজায় মাতব্বর সাহেব দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বদর আসার অপেক্ষায়। দুইজন একত্রে বাড়ীতে ডুকার সময়েই মাতব্বর মেপে নিয়েছে দুইজনকে কেমন মানাবে।মনে মনে ভাবে সোনায় সোহাগা হবে ইনশাল্লাহ।ততক্ষনে মাতব্বর ভাবের রাজ্যে আনমনা হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে--'কোন সাড়াশব্দ নেই।'হিরামনি সামনে গিয়ে বলে উঠে--'বাবা- বদর ভাই  এসেছে"। মেয়ের আওয়াজ শুনে মাতব্বরের সম্ভিত ফিরে আসে।ও ও হ্যা হ্যা-- টেবিলে  ভাত নিয়ে আয় মা, তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।বদর আস আস, আগে ভাত খেয়ে নেই,পরে কথা হবে।

    হিরামনি বদরকে আনতে যাওয়ার আগেই সব কিছু রেডি করে রেখে গিয়েছিল। বদর টেবিলে বসার আগেই হিরামনি ভাত নিয়ে হাজির।বদরের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, হিরামনি তাঁদের বাড়ীতে এত তাড়াহুড়ো করার উৎস কি। টেবিলে মাছ, মাংস, ডিম, পোলাও, আস্ত কবুতরের রোষ্ট সহ অনেকগুলি আইটেম থরে থরে সাজাতে লাগলো হিরামনি।বদর এতসব কে রেঁধেছে তখন মাতব্বর সাহেবের সামনে বলতে পারেনি, তবে মনে মনে ভাবে হিরা শুধু নামেই হিরা নয় কাজেও হিরা বটে।একটু খানি মেয়ে এতগুলি আইটেম প্রস্তুত করা চাট্রি খানি কথা নয়, হিরা এক্কেবারে পাক্কা রাঁধুনি।এত খাবার বদর জীবনেও কোন দিন দেখেনি,  খাওয়া তো দুরের কথা।

    বদর আদবের সহিত বসে প্লেট টেনে খাওয়া মুখে দিতেই মাতব্বর বলে উঠে- তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি।আগামি পরশু থেকে হিরা সহ একত্রে দুইজন গাড়ীতে স্কুলে যাবে। তুমি রাতে পরিমনিকে পড়াটা দেখিয়ে দিও, রাতের ভাত খেয়ে এখানে থাকলেও থাকতে পার, বাড়ীতে গেলেও অসুবিধা নাই, তোমার ইচ্ছা।সকালে কিছুক্ষন পরিকে পড়িয়ে হিরাকে নিয়ে স্কুলে চলে যাবে।আগামি পরশু তোমাদের প্রথম ক্লাস শুরু হবে।বদর চুপ করে থাকে,বদরের কেন জানি মনে হচ্ছে সব কিছুই অনেক আগে থেকে পাকাপাকি কথা হয়ে আছে।বদর লজ্জায় চোখ তোলে হিরামনির দিকেও তাকাতে পারছেনা।হিরামনি অবশ্য একটি পাখা নিয়ে বদর এবং বাবাকে একত্রেই বাতাস করে চলেছে।পরিমনি একবার এদিকে যায় আর একবার ওদিকে যায়, বদরের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসে।বাবার চোখ পড়ার ভয়ে কিছুক্ষনের জন্যে আড়ালে চলে যায়।মাতব্বর পরিমনিকে ঢেকে বলে--পরি তোমার জন্যে টিচার এসেছে,আর দুষ্টামি চলবেনা,এখন থেকে সন্ধার সাথে সাথে পড়তে বসবে। বদর এক দৃষ্টিতে ভাতের থালায় তাকিয়ে ভাতই খাচ্ছে। মাঝে মাঝে মাতব্বর এটা সেটা পাতে তুলে দিচ্ছে, না  করতে পারছে না,  হাতও ধরতে পারছে না। লজ্জায় বিমূড হয়ে আছে।মাতব্বর অবশ্য বুঝতে পেরেছে---'বদর লজ্জায় জ্ঞান হারা হয়ে আছে'।

     খাওয়া শেষে বদর চলে আসার জন্যে নিসফিস করছিল, আর এক মহুর্তও বদর দাঁড়াতে পারছে না।মাতব্বর বদরের চঞ্চলতা বুঝতে পেরেছেন। তিনি নিজেই বলে উঠেন--কি বদর এখনি চলে যাবে? বদর বলে জি চলে যাব, মায়ের জন্যে ভাত চুলায় দিয়ে এসেছি, দেরি হলে ভাত গুলি পুড়ে যাবে। কেন! হিরা তোমাকে ভাত খেতে এখানে সকালে বলে আসেনি! বদর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।হিরা ভেতর থেকে বলে উঠে--না বাবা সকালে যেতে পারিনি, এখন ডেকে আনতে গেছি। মাতব্বর বলেন-- তাহলে যাও যাও, তাড়াতাড়ি যাও। হিরামনি টিপিনকারটা এনে দেয় বদরকে। হিরা টিপিনকারটি বদরের হাতে ধরিয়ে দিল, মাতব্বর বলেন এখন থেকে তুমি খেয়ে যাওয়ার সময় রোজ তোমার মায়ের জন্যে ভাত নিয়ে যাবে।

    বদর আসতে আসতে চিন্তার সাগরে ডুবে গেছে, কিছুক্ষন আগের ঘটে যাওয়া সব গুলি ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।বিগত এক ঘন্টাখানেক সে স্বপ্নে ছিল, নাকি বাস্তবে ছিল, বুঝে উঠতে পারছেনা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘরের দরজায় এসে গেছে, বদর বুঝতে পারেনি।তখনও আনমনে বিড় বিড় করে কি যেন বকছিল।মায়ের ডাকে আচমকা সম্ভিত ফিরে পায়।হাতের টিপিনকারটি মায়ের হাতে দিয়ে চুলার কাছে গিয়ে দেখে চুলার উপর ভাত তরকারি কিছুই নেই। তাঁর মা বলে উঠে আমি রেধে ঘরে নিয়ে এসেছি বাপ।বদর বলে তুমি উঠলে কিভাবে মা।বদরের মা বলেন,--কেন বাবা?  তুই ঐদিকে রওয়ানা দেয়ার সাথে সাথে আমি ভাল হয়ে গেছিরে বাপ। তুই লেখাপড়া করতে পারবি, এই খুশিতে আমি ভাল হয়ে গেছি, আমার জন্যে তোর আর কোন চিন্তা নেই

    বদর জামা কাপড় খুলে টিপিন কার থেকে মাকে পোলাও কোরমা,রোষ্ট বের করে খেতে দেয়,বদরের মায়ের চোখ ছানাবড়া, কি রে বাপ,এত কিছু আমি কি ক্ষেতে পারব? তোর জন্যে কি এত কিছু রান্না করেছে মেয়েটা? বদর বলে হ্যা মা করেছে,আমার গুলো আমি খেয়ে এসেছি, এই গুলি তোমার জন্যে দিল।বদরের মা খেতে পারে না,চিমটি দিয়ে অল্প মাছ, আর গরু মাংস তুলে মুখে দিয়েছে।বাদবাকি সব গুলি রাতে বদর খাবে বলে রেখে দিয়েছে।বদর দেখে মাকে বলে- মা তুমি এই গুলি খেয়ে পেল,আমি রাতে ঐ বাড়ীতে খাব।মাতব্বরের ছোট মেয়ে পরিকে পড়াব,রাতেও তোমার জন্যে খানা নিয়ে আসব।ছেলের কথা শুনে মা এত যে খুশী হয়েছে মনে হচ্ছে যেন দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম।বদরের মা খাওয়ার লোভে এত খুশী হয়নি,বদর যে মাতব্বরের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে, বদরের পড়া লেখা করার মতি ফিরেছে সেই কারনে মা এত খুশী।সন্ধায় বদর মাকে বলে মাতব্বরের বাড়ীর উদ্দেশ্যে  রওয়ানা করে। পরি মনিকে কিছুক্ষন পড়ানোর পর চলে আসতে চাইলে হিরা ভাত টেবিলে দিয়েছে, খেয়ে যাওয়ার জন্যে বলে।বদর বলে আমার আজ আর ক্ষুদা নেই, ভাত খাবনা।আমি এখন আসি, সকালে আসব। তুমি কি স্কুলে যাবে আগামীকাল? হিরামনি হ্যা সূচক জবাব দিয়ে আবারও ভাত খেতে বলে।বদর প্রতি উত্তর না করে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে।

    বাড়ীতে পৌঁছে মায়ের জন্যে সবকিছু গরম করে, মাকে খেতে দেয়।বদর পাশে বসে মালকে চিমটি দিয়ে তুলে তুলে এটা সেটা খাওয়াচ্ছে।মা বার বার বলছে, বাবা আর পারিনা,তুই খেয়ে নেয়,আমি আর খাবনা।জোর করে বদর কবুতরের কলিজাটা বের করে মায়ের মুখে ফুরিয়ে দিয়ে বলে, শুধু এই টুকুন খাও লক্ষি মা--। কোনরকমে মুখে নেড়েচেড়ে মা কলিজাটা গেলার পর, পানি এনে হাত মূখ ভাল করে ধুয়ে দিল বদর।কোলে করে বিছানায় রেখে ছেড়া কাঁথাটা মায়ের গায়ে টেনে দিয়ে বলে-এবার ঘুমাও।আজ আর মায়ের স্বাসকষ্ট একেবারেই নেই। শরীরটাও বেশ ভালই মনে হল, বদরের নিকট।মা বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে চাইল,বদর বলে উঠছ কেন মা, ঘুমিয়ে পড়, রাত অনেক হয়েছে।বদরের মা বলে বাছা--"আজকে তুই আমার সাথে ঘুমা বাবা, আমি তোকে বুকে নিয়ে ঘুমাব"।বদর তেল স্যাতস্যেতে বালিশটা হাতে করে নিয়ে এসে, মায়ের পাশেই শুয়ে পড়ার জন্যে কুপি বাতিটা নিভাতে গেল, মা নিষেদ করে বলে, বাতি নিভাস না বাপ, বাতি নিভালে আমি তোকে দেখব কি করে। বদর বাতি না নিভিয়ে শুয়ে পড়ে, মা বসে বসে বদরের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, মাথায় হাত বুলাতে থাকে।কখন যে বদরের ঘুম এসেছে, বদর নিজেও জানেনা।

     সকালে হিরাদের বাড়ীতে যাবে মনে করে কাক ডাকা ভোরেই ঘুম থেকে উঠে গেল বদর।হাত মুখ ধুয়ে, জামাটা গায়ে দিয়ে বদর, মাকে  বলে যাওয়ার জন্যে ঘুম থেকে জাগাতে, মায়ের বিছানার পাশে যায়। বদর দেখে মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ডাকবে কি ডাকবেনা--বদর বুঝতে পারছেনা।গতকাল শোয়ার আগে বদর বলেনি আজ নতুন স্কুলে যাবে, সেখানে মাতব্বর তাঁকে ভর্তি করে দিয়েছে। নাবলে চলে গেলে মা--ঘুম থেকে উঠে বদরকে ডাকাডাকি করবে। নাপেলে রাস্তার দ্বারে বসে থাকবে, একে ওকে জিজ্ঞাসা করবে। তার চেয়ে বরং জাগিয়ে বলে গেলেই ভাল হবে। বদর কয়েকবার ডাক দেবার পরও মায়ের ঘুম ভাঙ্গেনা, এবার আরো জোরে জোরে ডাক দেয় তবুও মায়ের ঘুম ভাঙ্গেনা। প্রতিদিন মা বলার আগেই মায়ের ঘুম ভেঙ্গে জবাব দেয়, আজ এত ডাকাডাকির পরও মায়ের ঘুম ভাঙ্গেনা কেন?এবার বদর আরো কাছে গিয়ে মায়ের গায়ে হাত দিয়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে ডাক দেয়,মায়ের সারা শরীর নড়ে উঠে, কিন্তু মায়ের ঘুম ভাঙ্গেনা।কাঁথাটা একটু সরিয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখে বরফের মত মায়ের কপাল ঠান্ডা হয়ে আছে।বদরের বুঝতে বাকি রইলনা---"মা চিরনিদ্রায় তাঁর বদরকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।"

     দেখতে দেখতে পাঁছ বছর প্রায় শেষ হয়ে এল। বদর ও হিরামনি সর্বক্ষন ঘরের মধ্যে মারামারি, চিমটা চিমটি, হৈ, চৈ করে দিন কাটিয়ে দেয়।বদরের স্বাস্থ্য চেহারা তুলনামূলক রাজপুত্রের চেয়েও অধিক সুন্দর।হিরামনিরও যৌবনে টই টুম্বুর। দুই জনের সম্পর্ক আপন ভাই--বোন নাকি স্বামী--স্ত্রী বিশেষজ্ঞ দিয়ে গভেষনা করেও নির্ণয় করা সম্ভব নয়।প্রেমিক প্রেমিকা বললেও ভুল হবে।তাঁদের দুই জনের সম্পর্ক মর্ত ছেড়ে স্বর্গের পথেই আছে।কেউ কাউকে একসেকেন্ড না দেখলে থাকতে পারেনা। আবার সামনে গেলে মারামারি, চিমটা  চিমটিও সমান তালে চলতে থাকে।ক্ষনে ক্ষনে রাগ, ক্ষনে ক্ষনে অভিমান, ক্ষনে ক্ষনে আদর,ক্ষনে ক্ষনে মারামারি এই যেন এক অভিনব স্বর্গীয় এক অনবদ্য পবিত্র সম্পর্ক।কেউ কাউকে ভাল বাসেনা, কেউ কাউকে না দেখলে থাকতে ও পারেনা। কেউ কাউকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেনা, কেউ কাউকে অপমান অপদস্ত ও করেনা। কেউ কাউকে ছাড়া খায়না, কেউ কাউকে ছাড়া পড়তেও বসেনা। কেউ কাউকে রেখে স্কুলে যায় না,কেউ কাউকে পছন্দও করেনা। কেউ কাউকে অপছন্দ করেনা, কেউ কাউকে ছাড়া রাতে ঘুমাতেও যায়না। একই খাটের উপর দুই জনই ঘুমায় দুই জনের কেউ বুঝেও না জৈবিক তাড়না কি জিনিষ।দুই জন একে অপরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে কেউই বুঝেনা শারিরীক চাহিদা কেমন। সকালে কথা শুরু হলে তার পরের দিনও কথা শেষ হয়না-- চলছে তো ছলছেই। দুই জনেই মাতব্বরকে বাবা ডাকে, দুই জনেই সেবা করা নিয়ে ঝগড়া করে। তাঁদের দুই জনের এই হাল হকিকত বাবা মাতব্বর বেশ উপভোগই করেন, আনন্দও পান। ছোট বোন পরিমনি একবার বদর পক্ষ আরেক বার হিরামনি,  আপুমনি পক্ষ।সেও দুইজনকে উপভোগ করে প্রানভরে।

    মাতব্বর আনন্দের মধ্যে আবার ইদানিং কিছুটা শংকাও অনুভব করা শুরু করেছেন। তাঁদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বাবা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করেও নির্ণয় করতে পারেননি। তবে দুই জনের কেউ কাউকে ছাড়া একসেকেন্ডও থাকতে পারেননা তা কিন্তু হাঁড়ে হাঁড়ে বুঝতে পেরেছেন। বাবা যে মনে মনে প্রথম থেকেই স্থীর করে রেখেছেন, তাঁদের দুইজনের মধ্যে বিয়ে দিবেন, তাঁরা দুই জনের কেউই ঘুনাক্ষরেও জানেনা। মাতব্বর স্থীর সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন চার মাস পর তাঁদের দুই জনের মেট্রিক পরিক্ষার পরের দিনই বিয়ে দিয়ে দিবেন। এখন থেকে সেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছেন বাবা।

    যথারীতি পরিক্ষা শুরু হয়ে অদ্য বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। রাতে ভাত খাওয়ার পর বাবা দুই জনকে ডেকে কাছে নিয়ে এলেন।তখনও একজন আরেকজনের চুল ছঁড়ায় ব্যাস্ত। উভয়কে ছাড়িয়ে নিয়ে বাবা দুই জনকে দুই পাশে বসিয়ে নিজে মাঝখানে বসলেন। তাঁরা দুই জন দুই জনের দিকে চাওয়া চাউয়ি করছেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। কিছুক্ষন পর বাবা দুই জনকে সামনে রেখে চেয়ার ঘুরিয়ে মুখামূখী হলেন। দুই জনকে তাঁর দিকে তাকাতে বললেন। এবার তাঁরা দুইজনের মধ্যে উভয়ের মনে ভীতির সঞ্চার হচ্ছে উভয়ে অনুভব করছে।  বাবা কোন প্রকার ভূমিকা গ্রহন না করেই সরাসরি বলে দিলেন আগামী কাল শুক্রুবার জুম্মার মসজিদে তোমাদের দুই জনের বিয়ের আকদ হবে। পশ্চিমের কক্ষে সব কিছু প্রস্তুত আছে তোমরা দুই জনেই নিজের মত করে  জুম্মার আগে আগে সেজে নিবে।

    দুইজনের মধ্যে একই সময়ে একই সমান,একই আড়ষ্টতা তৎক্ষনাৎ সৃষ্টি হয়েছে, দুই জনেই  সমানতালে আড়ষ্টতা অনুভব করতে শুরু করেছে। মারামারি কাটাকাটি দুরের কথা কেউ কারো দিকে তাকাতেই পারছেনা।বাবা যখন বলল, যাও তোমরা ঘুমিয়ে পড়।দুই জন দুই দিকে মুখ করে, দুই দিকে হেঁটে-দুই কক্ষে দুই জায়গায় বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

     সকালে ঘুম থেকে উঠে বদর  চোখে মূখে পানি দিয়ে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসে।আজ আর হিরামনি নাস্তা এনে দেয়নি।পরিমনি নাস্তা দিয়ে বদরের পিঠের উপর সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে গেছে।পরিমনি আগে কখনও এভাবে বদরের সাথে ব্যবহার করেনি,হয়তো বা হিরামনির কারনে সুযোগ পায়নি। অন্যভাবে বলা যায়, বদর তাঁর টিচার হিসেবে দূরে দূরে ছিল।আজকে হঠাৎ করে তাঁর আচরনে আমূল পরিবর্তন গতকাল বাবার বলা কথাগুলি মনে করিয়ে দেয় বদরকে। মনের অজান্তে বদরের লজ্জায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে বদর রাতের ঘুমানো কক্ষে নিরিবিলি বসে পড়ে।কিছুক্ষন পরেই লক্ষ করে ধীরে ধীরে সারা বাড়ী সরগরম হয়ে উঠছে।দলে দলে চতুর্দিক থেকে নারী পুরুষ মেহমান আসা শুরু হয়েছে। টেক্সি, রিক্সা, প্রাইভেট গাড়ীর গরগর শব্দও বেড়ে চলেছে। বাবুর্চির পাতিলের ঝনঝনানি, ছেলেমেয়েদের কলকাকলি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বৃদ্ধিই পাচ্ছে।

       হিরামমনি অন্দর মহলে, বদর বাহিরের পটকে নিবৃত্তে বসে কল্পনার সাগরে ডুবে আছে,এত আয়োজন বাবা কখন করেছেন।বাবা কিভাবে বুঝতে পেরেছেন আমরা দুইজন একে অপরকে ছাড়া বাঁঁচবোনা। চিন্তার খুব বেশী সময় পায়নি, হুড়মূড় করে গ্রামের, আশেপাশের, আত্মীয় স্বজনের ছেলে মেয়েরা কক্ষে ঢুকে হৈ হুল্লোড়, চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। সেই এক অবর্ণনীয় আনন্দের হিল্লোল বাড়ীময়। যথাসময় কাজী এসে সাক্ষীসহ হিরামনির মতামত নিয়ে গেছে। জুম্মা মসজিদে মোনাজাতে উভয়ের দাম্পত্য জীবনের সুখ,শান্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত সমাপনের পর বাড়ীর বাহির পটকে সবাই খাওয়াদাওয়া শুরু করেছেন।

       নানা আনুষ্ঠানিকতায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধের পর বদর এবং হিরামনির উভয়ের মনের মধ্যে অন্যএক অনুভূতির আমেজ অনূভব হচ্ছে।যাহা বিগত ৫টি বছর একত্রে বসবাসের পরও কেউ কোনদিন টেরও করতে পারেননি।এত কাছের আপনজন যেন নিমিষেই হাজার মাইল দুরত্বের অচেনা অজানা কোন এক রাজকুমার রাজকুমারির স্বপ্নে দেখা মানব মানবি।

       দিনযায় দিন আসে, শুভদিনে জম্ম নিয়েছে হিরামনির কোল আলোকিত করে তাঁদের প্রেমের অমুল্য রত্ন ইসাবেলা।ঠিক যেন বদরেরই প্রতিচ্ছবি।গ্রামজুড়ে আনন্দ উল্লাসে নতুন অতিথীকে বরন করে নিয়েছে, পাঁড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন।মাতব্বর খুশীতে একরকম পাগলই হয়ে গেছেন।কি করবেন, কোথায় রাখবে, কিভাবে রাখবেন যেন বুঝেই উঠতে পারছেননা। সারা বাড়ীময় স্বর্গীয় আনন্দের ঢেউ ভয়ে গেল একনাগাড়ে পনরদিন।মাতব্বর ১৫ দিনের মধ্যেই নতুন অতিথীর আগমনে এলাকাব্যাপি অগুনতি মানুষকে দাওয়াতের মাধ্যমে ১৫টি বিশালকায় গরু জবাই দিয়ে সেই আনন্দের বহি:প্রকাশ ঘটান।

   সুখ, আনন্দ, উল্লাসের অপর পৃষ্টে লেখা আছে দু:খ্য, বেদনা, দুর্গতির দাঁত বের করা হাসি। বদর হিরামনির আনন্দ উপাখ্যান মনে হয় বিধাতার বেশিদিন সহ্য হয়নি। আনন্দ, উল্লাসের রেশ কাটতে না কাটতে একদিন কাকডাকা ভোরে সকলকে কাঁদিয়ে মাতব্বর চলে গেলেন না পেরার অন্তিম গগনে। গ্রামবাসি যেন মাতব্বরের  মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন। 'জোর যার মুল্লুক তার' কথাটির বাস্তব প্রতিপলন পাওয়া গেল মাত্র তিনমাসের মধ্যে, স্বর্গীয় মাতব্বর  সাহেবের একমাত্র জীবিত দুই কন্যার বেলায়।

     প্রকৃতিগত তিস্তার নিয়মিত ভাঙ্গনে কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়নের কালি খামার গ্রামের সীমানায় এসে থেমেছে।তাঁর আগে চলে গেছে তিস্তার পেটে হাজার একর চাষাবাদের জমি।কালি খামার,ছয়গরিয়া গ্রামের আশপাশে বাদবাকি একহাজার একরের উপরে চরাঞ্চলের জমি আশপাশের জোতদারের লাঠিয়াল বাহিনী দখলভকরে নেয় ফসল উঠার আগেই।বদরের নিকটতম আত্মীয়স্বজন কালি খামার গ্রামে আগে থেকেই তেমন ছিলনা।যারাই ছিলেন অর্থবিত্তে তেমন বলিয়ান কেউ না থাকায় কোনপ্রকার প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি বদর।বাড়ীর আশপাশের খালি পড়ে থাকা খালবিলের জমিটুকুও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি প্রতিবেশিদের হিংসাত্মক মনোভাবের কারনে।প্রতিবেশিদের হিংসার মূলকারন বদর ভিখারীনির ঘরে জম্ম নিয়েছে এই তার অপরাধ।কেউই সহ্য করে নিতে পারেনি গতকালের ফকির বদর আজকে জমিদারি করে তাঁদের উপর চড়ি ঘুরাবে। বদরের দু:খ্যের দিনে পাড়া প্রতিবেশিদের কেউই এগিয়ে আসেনি সামান্যতম সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে।

     দীর্ঘবছর বিশাল ভূসম্পত্তির মধ্যে বেড়ে উঠা হিরামণি ও পরিমণির আগাম বিপদ সম্পর্কে বদর শংকিত হয়ে পড়ে।বিলাসি জীবন যাপন করা পরিবারের সন্তান দিনমজুরের ঘরে হাঁপিয়ে উঠার আগেই বদর কিছু একটা করার চিন্তায় অস্থীর হয়ে উঠে।বদর যেকোন অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করতে পারবে কিন্তু তাঁর হিরা,ছোটবোন পরি কি পারবে?এদিকে বিগত ছয় সাত বছরের মধ্যে হিরামণিকে ছেড়ে বদর কোথাও একদিনও অতিবাহিত করেনি,পারবেতো তাঁর প্রানপ্রিয় সহধর্মিনীকে ছেড়ে থাকতে?হাজারো চিন্তা যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনই বড় হয়ে দেখা দেয় হিরা-পরির আসন্ন গরিবী হাল সে কিভাবে সামলাবে।তাঁর ঔরশে জম্ম নেয়া সোনিয়ারই বা কি হবে।না তাঁকে একটা কিছু করতেই হবে।

    মাতব্বর সাহেব জীবিতবস্থায় জমানো টাকা পয়সা যাই ছিল অল্প সময়ের মধ্যে সেই টাকা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মাতব্বরের ছোট মেয়ে পরিমনিও বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে।পরিমনি গতবছরই পাঁছ ক্লাস পাশ দিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল। হিরামনি বদরের সাথে সেও একই গাড়ীতে এত দিন স্কুলে আশা যাওয়া করেছে।বদর হিরামনি মেট্রিক পাশ করে চলে আশায় সে এখন একা স্কুলে যেতে হবে।তাঁর লেখাপড়ার খরছ যোগানো বদরের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠে।বাধ্য হয়ে তার লেখাপড়ার ইতি এখানেই টানতে বাধ্য হয়।  গ্রামে বা তার আশপাশে বদরকে কেউ কাজ দিতেও রাজি নয়, কি করবে, হিরামনিকে কি খাওয়াবে চিন্তায় বদর অস্থির হয়ে পড়ে।

      অবশেষে হিরামনির পরামর্শে বদর শহরে চাকুরির সন্ধানে চলে যাবে মনস্থীর করে। প্রানপ্রিয় হিরামনি কলিজার টুকরা সোনিয়াকে রেখে বাড়ী থেকে বের হতে নিয়তি তাঁকে বাধ্য করেছে মনে করে, সেও সংকল্পে দৃড হয়ে পড়ে। শুভদিনে বাড়ী থেকে বের হয়ে রাজধানীর উদ্দেশ্যে গাড়ীতে উঠে বসে বদর।দির্ঘ তিনমাস না খেয়ে, পিছঢালা পথের ধারে রাত কাটিয়ে কেটে দেয়, কোথাও তাঁর সেকেন্ডারি পাশ সার্টিফিকেটে চাকুরির সুযোগ মিলাতে পারেনা বদর। অবশেষে ঢাকার রাজপথে না খেয়ে, পথে ধারে রাত কাটিয়ে তিনমাস সময় পার করার পর জুনায়েদ, ৩৩/গুলশান নামে বাড়ীর কেয়ার টেকার পদে চাকুরির বিজ্ঞপ্তি বদরের চোখে পড়ে। বিজ্ঞপ্তি পাওয়া মাত্র রাত বারটায় কমলাপুর রেলওয়ে জংশন থেকে হেঁটেই রওয়ানা দেয় গুলশানের উদ্দেশ্যে বদর। যথাসময়ে জুনায়েদ সাহেবের বাসায় পৌঁছে বদর সাক্ষাৎকার দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, জুনায়েদ সাহেব অনুমোদন দিয়ে পরের দিন শুক্রুবার তাকে যেতে বলে।
       
                                       পর্ব---(দুই)

       ইতিমধ্যে অঞ্চলময় ছড়িয়ে পড়েছে,গ্রামের মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে কেউ বা একাকি জিবিকার তাগিদে অজানা উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে।কালিখামার বদরের নীজ গ্রামের অনেক পরিবার পাড়ি জমিয়েছে।গাইবান্ধার কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়ন সহ আশপাশের বিশ বাইশটি ইউনিয়নই তিস্তার অভিশাপে খুব বেশি অভিশপ্ত। কালিবাড়ী, ছয়গরিয়া গ্রামের একটি পরিবারেরও একদিনের খাদ্য যোগাড় করার কোন উপায় রইলনা।বেশির ভাগ পরিবার পাড়ি জমিয়েছে নিয়তির উপর নির্ভর করে অজানা অচেনা জনপদে।

     গ্রামের বাকি পরিবারের মধ্যে উপার্জনক্ষম যারা ছিল তারাও কোথাও না কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।পাশের বাড়ীর ছমিরনের মা তাঁর বিবাহযোগ্য তিন মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় বস্তি ভাড়া নিয়েছে, গ্রামে খবর পাঠিয়েছে, মেয়ে তিনটাকে গার্মেন্টসে ভর্তি করে দিয়েছে। ছমিরনও ভাল একটি চাকুরি পেয়েছে। আগামী দুইমাস পর রমজানের ছুটিতে বাড়ী আসবে। তিনমেয়ের গার্মেন্টে খুব ভাল চাকুরি হয়েছে, ম্যানেজার, মালিক সবাই খুব ভাল মানুষ,তাঁর মেয়েদের খুব আদর করে। প্রথম তিনমাস ম্যানেজার বলেছে টাকা পয়সা দিবেনা,কাজ শেখার পর বেতন ধরবে।ছমিরনের মা ফকিরাপোলের আবাসিক হোটেলে ঝাড়ুদারের কাজ পেয়েছে।মধ্যবয়সি ছমিরনের মার গায়ের রঙ কিছুটা ফর্সা হলেও গ্রামে অভাবের তাড়নায় চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। প্রথমদিন বস্তির এক বড় ভাইয়ের সাথে হোটেলে গেলে হোটেল বয় ছেলেগুলি  ঈঙ্গিতপূর্ণ  কিছু কথা বলেছে। কিন্তু ছমিরনের মা তখন তাদের কথা  বুঝতে পারে নাই।হোটেলে আরো চার পাঁছজন তাঁর মতই মধ্যবয়সি মহিলা ঝাড়ুদারের কাজ করে। তাঁদের বেশভূষা, আচার আছরন ছমিরনের মায়ের কাছে কিছুটা সন্দেহ জনকই মনে হয়েছে।ঝি চাকরানীর কাজ করে অথছ কাপড় পরার ধরন, সাজগোজ এমন কেন হবে! ছমিরনের মায়ের যে বেতন হোটেল ম্যানেজার বলেছে, এতে তাঁর বস্তির ঘর ভাড়ার অর্ধেক টাকাও হবেনা। কোথাও উপস্থিত কাজ না পেয়ে অল্প বেতনে আপাতত: হোটেলেই কাজ করার মনস্থীর করে কাজটি নিয়েছে। ম্যানেজার বাবু অবশ্য বলেছে- ভাল সার্ভিস দিতে পারলে মাসে দশ/বার হাজার টাকাও কামাতে পারবো।হোটেল থেকে মাত্র পাঁচ'শ টাকা এটা কিছুইনা, টাকা আয় নির্ভর করবে আমার সার্ভিসের উপর।অথছ আজ প্রায় বিশদিন কাজ হয়ে গেছে, একটি টাকাও রুজি হয়নি। ম্যানেজার বলেছিল ভাল কাজ করলে অনেক টাকা, আমি তো কাজে কোন গাফেলতি করিনি, আমাকে কি দশ/বার হাজার টাকা দিবে? নাকি মাত্র পাঁছ'শ টাকাই পাব।
     এদিকে মাসের বাকি আর মাত্র আট/ নয় দিন । মুদি দোকানীর বাকি তিন হাজারের উপর, বস্তির ভাড়া তিনহাজার টাকা। পাঁছ' শ টাকা দিয়ে কি আর ছয় হাজার টাকার অভাব পুরণ করা সম্ভব?

   নতুন কাপড় পরে আসার নির্দেশ কেন দিল ম্যানেজার রাতভর এই চিন্তায় ছমিরনের মায়ের ঘুম হয়নি।এপাস ওপাশ করে কোনমতে রাতটি কাটানোর পর সকালে ঘুম আজানের সঙ্গে সঙ্গে বস্তি থেকে বের হয়ে অনতিদুরে রেললাইনের উপর চলে গেছে ছমিরনের মা। বড় মেয়ে ছমিরন মায়ের এপাস ওপাস করা এবং সারা রাত ঘুম না যাওয়া লক্ষ করেছে।সুয্য দেখা দেয়ার পর তিনমেয়েই মা'কে বিছানায় না দেখে হতভম্ভ।এদিক সেদিক চাইতে দেখা গেল অদুরে রেললাইনের পাশে ঘাসের উপর এক মহিলা বসে আছে, তিন বোনই সেখানে গিয়ে দেখে তাঁদের মা বসে আছে। মেয়েরা জিজ্ঞাসা করে মা তুমি এখানে কেন বসে আছ, কি হয়েছে তোমার? মায়ের চোখে পানি--কোন কথাই বলেনা মা। তিন বোন জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।অগত্যা মা উঠে তিন মেয়েকে নিয়ে বস্তিতে ফিরে আসে।বস্তিতে ছমিরনকে মা গোপনে সব খুলে বলার জন্যে ইঙ্গিতে বাহিরে যাওয়ার জন্যে বলে।
     ছমিরন কিছুটা লেখাপড়া জানা মেয়ে, মা বলার আগেই বুঝে গেছে, মা কি বলতে চায়। ছমিরন বলে--মা তুমি বলতে হবে না, আমি জানি তুমি কি বলবে।বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা এমনিতেই ভাগ্য বিড়ম্ভিত.। ঢাকায় যখন এসেই গেছি টাকার জন্যে, তবে টাকাই রুজি করব। আমিও আজ থেকে গার্মেন্টসে যাবনা। ওরা দুই জন চাকুরি করবে, আমি অন্যকিছু করব, যেখানে বেশিটাকা পাব, সেখানেই আমি যাব। ছমিরনের কথা শুনে অঝোর ধারায় চোখের পানি পড়তে থাকে মায়ের।মায়ের চোখের পানি যেন বাধ মানেনা,  ধরে রাখতে পারেনা, একি বলে মেয়ে! ছমিরন নীজের নতুন সেলোয়ার কামিজ বাক্স থেকে বের করে মাকে নিজহাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলে--'মা তুমি আজ এই গুলি পড়ে হোটেলে যাবে। ম্যানেজার বাবু যে কাজ করতে বলে সেই কাজই করবে। আমি আমার আর একটা জামা আছে সেটি পড়বো।

      নতুন নতুন গ্রাম থেকে আসার পর বস্তির দুই একজন যুবক ভাল কাজের প্রস্তাব নিয়ে ছমিরনের কাছে এসেছিল, সমিরন পাত্তা দেয়নি।পাসের বস্তির জুলেখা, শিরিন, নুসররাত, আকাশি, বেলার মা প্রত্যেকদিন দুপুরের পর সাজগোঁজ করে কোথায় জানি চলে যায়।তাঁদের কাপড় চোপড়, চলাফেরা উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের চাইতেও অনেক উন্নত। প্রত্যেকের হাতে বড় বড় দামী মোবাইল সেট।সারা রাত কাটিয়ে সকালে আসতে না আসতে আবারও ফোন পেলে তাড়াহুড়ো করে অনেকে বেরিয়ে যায়। কেউ কেউ দুপুর পয্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে বস্তিতে। গত তিন শুক্রুবার ছুটির দিনে ছমিরন ভালকরে তাঁদের গতিবিধি পয্যবেক্ষন করেছে।অনেককে অবশ্য জিজ্ঞাসা করেছে,আপু আপনি কোথায় চাকুরি করেন? তাঁরা যে সমস্ত চাকুরির কথা বলেছে এতে কেউ সঠিক কথা বলেছে বলে ছমিরনের মনে হয়নি।

      বেলার মা'কে জিজ্ঞাসা করার পর সে বলেছে তুমি জানতে হবে না, ইচ্ছা হলে আমার সাথে যেতে পার, তুমি ভাল কামাই করতে পারবে।তোমার চেহারা ছবি, বয়স সবমিলে তোমার চাহিদা সবার থেকে আলাদাই হবে। কিসের চাহিদা---জিজ্ঞেস করলে বেলার মা অবশ্য কিছু না বলে চলে গেছে। পিছু পিছু তাঁর বস্তিতে যেতেও পারেনি,বেলাকে নিয়ে বেলার বাবা খেলা করছে বস্তির দরজায়। বেলার মায়ের সব বিষয় বেলার বাবা অবশ্য জানে, সেও বস্তির অন্য মেয়েদের নিয়ে কোথায় কোথায় যায়।অনেক সময়ে দামি পাজেরো গাড়ী বস্তির সামনে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, বেলার বাবা বস্তির অল্প বয়সি ছুকড়িদের নিয়ে সেই গাড়ীতে উঠে বসলে-গাড়ী অজানা উদ্দেশ্যে ছেড়ে চলে যায়। মেয়েগুলির খাওয়া দাওয়া চলাফেরা, কথাবার্তা সবকিছুই অন্যধরনের, বস্তির কাউকে পাত্তা দিয়ে কথা বলেনা। মুদি দোকানীও খুব সমীহ করে মেয়েগুলির সঙ্গে কথা বলে। ছমিরন আজ মনে মনে সিদ্ধান্তই নিয়েছে, বেলার মায়ের সাথে সেও আজ যাবে। ছমিরন-- মা, দুই বোনকে কাজে পাঠিয়ে বেলার মায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।

     ছমিরনের মা--মেয়ের জামাকাপড় পরার পর তিনমেয়েই হাসতে হাসতে দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। ছমিরন বলে--'মা--কে বলেছে তোমার তিনমেয়ে? তোমার তো বিয়েই হয়নি।ছোট মেয়েটি বলে-- মা তোমার জন্যে আজই একটা বর খুঁজে আনতে হবে, তোমাকে যা লাগছেনা মা! মেঝ মেয়ে এমনিতে একটু চাপা স্বভাবের, সে সবার সাথে হাসিতে অংশ নিলেও কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে। ছমিরনের মা বস্তির ভেড়ার সাথে আটকানো ভাঙ্গা আয়নার ধারে গিয়ে শেষ প্রস্তুতি দেখে নিতে যায়।কোথাও কোন খুঁত আছে কিনা। চুল বাঁধাটা ঠিক আছে কিনা, লিপিষ্টিকের রঙ জামার রঙের সাথে মিলেছে কিনা,চুলের বেনীটা ঠিকমত গোঁছানো হয়েছে কিনা।

      একি!  তাঁর ছবি কই, দেখা যায় কাকে! স্বপ্নে পড়েনি তো! সকালে তো ঘুম থেকেই উঠেছে, নিজকে চিমটি কেটে দেখে সে নিজে কিনা, নাক,চোখ কান ছুঁয়ে দেখে, ঠিক সে কিনা।ছমিরনের মায়ের বিশ্বাসই হচ্ছেনা-আয়নায় দেখা যাওয়া অল্প বয়সের সুন্দরী মেয়েটি সে নিজে। না-তো ঠিক আছে তো সব, এইতো আমার ছমিরন, বোনদের মাথা আঁছড়ে দিচ্ছে! আমি! আমি কি  এত সুন্দর! মেয়েরা তো এমনি এমনি হাসি ঠাট্রা করেনি, সত্যিই তো, আমাকে যে খুব অন্যরকম স্মার্ট লাগছে!! শাড়ীতে মনে হচ্ছে নতুন বউয়ের মতই দেখাবে!

    ছোট বস্তি ঘরে কখন যে ছমিরনের মা' কল্পনার জগতে চলে গেছে টেরই পায়নি।একদৃষ্টিতে ভাঙ্গা আয়নার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় মগ্ন। আজ যদি ছমিরনের বাবা বেঁছে থাকতো, কি যে খুশি হত। কোনদিন মেয়ের বাবাকে এত সুন্দর সাঁজ দেখাতে পারেনি।কখন যে চোখ গড়িয়ে পানি ধরধর করে গড়িয়ে পড়া শুরু করেছে--সে দিকে কোন খেয়াল নেই। বিনা সাজে, ছেঁড়া কাপড়ে ছমিরনের বাবা কোনদিন তাঁকে অবহেলা  করেনি।প্রত্যেক দিন কাজ শেষে বাড়ী ফিরে মেয়েদের লুকিয়ে কপালে, ঠোঁটে একবার হলেও চুমু দিতে ভুল হতনা। মেয়ের বাবা বাড়ীতে প্রবেশ করার সাথে সাথে ঘরের কোন এক কোনে, নির্জন স্থানে যেতে হত, কাজের ব্যাস্ততায় দেরি হলে অভিমান করে সেদিন আর ভাতই খেতে আসতে  চাইতো না। যতক্ষন না দ্বিগুন আদর করতে না পারতো ততক্ষন ভাত খাওয়ানো কোন অবস্থায় সম্ভব হ'তনা।গভীর রাতে মেয়েগুলি ঘুমিয়ে পড়লে, আস্তে করে বিড়ালের ভঙ্গিমায় বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে বুকে নিয়ে, আদর করে- তাঁর পর ঘুমাতো।কখনও আদর করা ছাড়া ঘুমিয়ে পড়েছে এমন নজির মনে পড়েনা। শতকষ্টে, অভাবে, অনটনে জ্ঞানশুন্য অবস্থায়ও চোখ রাঙিয়ে কথা বলেনি, রাগের বসে কোনদিন গাঁয়ে হাত তুলেনি। পাগলের মত ভালবাসতো। অসুখ বিসুখে মাথার কাছে বসে থেকে রাত পার করে দিত।শতবার বলেও স্বামীকে উঠাতে পারেনি কোনদিন।একা রেখে কোনদিন ভাত খেয়েছে ছমিরনের মা'য়ের মনে পড়ে না।ছমিরনের বাবা আজ যদি বেঁছে থাকতো, পাগলের মত বুকে জড়িয়ে নিত। সুন্দর কাপড়, তেল, সাবান, স্নো,পাউড়ার কিনে দিয়ে সাজিয়ে রাখার চেষ্টার কোন ক্রুটি ছিলনা, অভাবের তাড়নায় সব চেষ্টাই সকল সময়ে বিফল হয়ে যেত।

    মায়ের চোখের পানি দেখে মেয়েরা চিৎকার করে মা'কে ডাকতে থাকে।মায়ের সেদিকে কোন খেয়াল নেই।ছমিরন ছোট বোনের মাথার বেনীটা হাত থেকে রেখে মাকে জড়িয়ে ধরে, মা তুমি কথা বলনা কেন? এত ডাকি তুমি শুননা কেন? এতক্ষনে মায়ের সম্ভিত ফিরে আসে,ছমিরনের হাত ছাড়িয়ে বলে--কই তোরা আমাকে ডেকেছিস। সামনের ওড়নায় চোখ পড়তে দেখে অর্ধেক ভেজা।মা বলে উঠে,  কি রে ছমিরন, তোর ওড়না ভেজা কেন? ছমিরন বলার আগেই নিজের চোখের পানি বুঝতে পারে।নিজেকে সংযত করে ওড়না  গুছিয়ে  বস্তি থেকে বেড়িয়ে পড়ে। বস্তি থেকে হোটেল আধা ঘন্টার হাটা পথ। রিক্সায় দশ টাকা মাত্র ভাড়া, কোন দিনও রিক্সায় ওঠেনি ছমিরনের মা।দশ টাকা কোথায় পাবে? আজ একটু বস্তি থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেছে, রিক্সায় উঠবে কি উঠবেনা চিন্তা করছে। যেতে দেরি হলে ম্যানেজার বাবু কাজ করতে যদি না দেয়--। রিক্সায় উঠবে কিভাবে, ভাড়া তো একটাকাও নেই। আজ একটু জোর গতিতেই হাঁটা শুরু করেছে ছমিরনের মা।সময় খুব বেশি লাগেনি, জোর কদমে হাঁটায় কপালে, মুখে গামের ফোঁটা ফোঁটা জমেছে। মুছতেও পারছে না---পাছে লিপিষ্টিক, পাউড়ারের প্রলেপ যদি নষ্ট হয়ে যায়। ছমিরন কত পরিশ্রম করে সাঁজিয়ে দিয়েছে মা'কে, ঘাম মুছতে গেলে ছমিরনের পরিশ্রমই পন্ডশ্রম হয়ে যাবে।ঘাম না মুছেই তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিত্যদিনের মত ম্যানেজারের কক্ষে প্রবেশ করে।

    ম্যানেজার বাবু হলে কি হবে, তিনি আবার হুজুর। পাঁছ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ছমিরনের মা যে কয়দিন হোটেলে আছে, এই কয়দিনে এক ওয়াক্ত নামাজ হুজুরের ক্বাজা হতে কোনদিন দেখেনি।হোটেলের মালিক, কর্মচারি, বয়, বেয়ারা, নিত্য আসা বোর্ডার সবাই ইজ্জত করে ম্যানেজার বাবুকে।যদিও বাবু হিন্দুদেরকে বলে--হুজুরের আগে যিনি ছিলেন এই চেয়ারে, তিনি হিন্দু ছিলেন। তাঁকে ম্যানেজারবাবু ডাকতে ডাকতে সবার একরকম অভ্যেস হয়ে গেছে। হুজুরকেও হুজুর না ডেকে সবাই ম্যানেজার বাবুই ডাকে।এতে হুজুরের কোন আপত্তি নেই,কাউকে নিষেদও করেনি কোনদিন। নিষেদ করবে কেন? -সেতো হুজুর নয়, এমনিতে দাঁড়ি রেখেছে,লম্ভা জামা গাঁয়ে দিয়েছে। হুজুর চার মেয়ের বিয়ে শা'দী দিয়েছে--জামাই, বেহাই, বেয়াইন হয়েছে। তাঁদের সম্মানার্থে হোক, আর লজ্জা থেকে বাঁছার জন্যে হোক, দাঁড়ি রাখা কর্তব্য বিধায় রেখেছে।দাঁড়ি রাখার অন্য অনেক উপকারও আছে, মানুষ ইজ্জত করে, সব ধরনের মানুষের সালাম পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ যে কোন কাজে দাঁড়িওয়ালা মানুষকে সহজে বিশ্বাস করে। ঠেকায় পড়ে হোক আর সম্মানের আশায় হোক  দাঁড়ি রাখতে হয়েছে, রেখেছে। নামাজ? সে তো মুসলমান হিসেবে নামাজ পড়া একান্ত কর্তব্য। ছোট বেলায় মক্তবে পড়ার সময় নামাজ পড়া ধরেছেন, এই পয্যন্ত কখনও আর নামাজ ছেড়ে দেননি।
   
    ছমিরনকে দেখেই ম্যানেজার আশ্চায্য--কপালে মুখে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম যেন ইলেকট্রিক আলোর বিকিরনে এক একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার আলো হয়ে জ্বলছে। দোতলার ফ্লোরে বয়ের দায়িত্বে ছলিম, বোয়ার দায়িত্ব পেয়েছে কুলসুম নামের নতুন আশা চিপচিপে সুন্দর মেয়েটি।ম্যানেজার সাহেবের ইচ্ছা ছিল কুলসুমের সাথে আজ কিছুক্ষন সময় কাটানোর।সকালে  বয়, বুয়াদের দায়িত্ব বন্টনের সময়ে ম্যানেজার ইচ্ছা করেই ছমিরনের মায়ের নাম কেটে কুলসুমার নাম দোতলার ফ্লোরে বসিয়ে দিয়েছে।ছমিরনকে কুলসুমার দায়িত্ব আট তলায় ভি,আই,পি ফ্লোরে দিয়েছে। কুলসুমা হোটেলে আসা অবদি উপরের তিনটি ভি,আই,পি ফ্লোরেই ঘুরে ফিরে দায়িত্ব পালন করেছে, তাঁর সার্ভিস ভি, আই, পিদের  খুব খুশি করেছে। ম্যানেজারবাবু আজ কাজে যাওয়ার কথা না বলে চুপ হয়ে বসে আছে।ছমিরনের মা ভিতরে ভিতরে একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন, প্রত্যেক দিন আসার পর খাতা, প্যাড ঠেলে দেয় ম্যানেজার টিপ দিয়ে ঝাড়ু নিয়ে কাজে যেতে, আজকে কেন বসিয়ে রেখেছে? দেরিও হয়নি আসতে, যে টুকু দেরি হওয়ার কথা ছিল, জোর কদমে হেঁটে সেই সময় কাভার করেছে। ছলিম এসে ঝাড়ু নিয়ে যেতে কয়েক বারই বলেছে, কিন্তু ম্যানেজার আগেরমত আসামাত্রই টিপ  নিয়ে বিদায় দিচ্ছে না।  ঘন্টা খানেক পর ছলিমকে ম্যানেজার ডাক দেয়, ছলিম আসার পর জিজ্ঞাসা করে ২০৮ নং কক্ষের ছেলেটা বের হয়েছে কিনা। ছলিম বলে--সে তো আপনি আসার আগেই চলে গেছে। ম্যানেজার ঐ কক্ষে নতুন বিছানা পাতি দেয়ার জন্যে ছলিমকে নির্দেশ দেয়। ছলিম আলমারি থেকে বিছনা চাদর, বালিশের কভার বের করে সেই কক্ষ রেডি করে ম্যানেজারকে রিপোর্ট করে। ম্যানেজার ছমিরনের মা'কে সেই কক্ষে গিয়ে বসার কথা বলেন।ছমিরনের মা টিপ দিয়ে যাবে বলায়, ম্যানেজার বাবু মুছকি হেসে বলেন---"তোমার আজ টিপসই দিতে হবে না, এমনিতেই আজ চারগুন বেশি বেতন পাবে" ।
   
    ম্যানেজারবাবু (হুজুর)পাশের বার্থরুমে গেলে ছমিরনের মা ২০৮ নম্ভর রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করে। ছলিম আর ফ্লোরের আজকের দায়িত্বপ্রাপ্ত আয়া কুলসুম বেগম সহ দুইজন কোনায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিল।ছমিরনের মা ২০৮ নং কক্ষের দিকে হাঁটা দিলে, উভয়ে মুছকি হেসে কি যেন ফিস ফিস করে বলাবলি করছিল।ছলিমের একটি কথার মৃদু আওয়াজ ছমিরনের মায়ের কানে লেগেছে--"হুজুর ঠিকই ইনটেক্ট চেনে"।ছমিরনের মা ইন্টেক্ট এর অর্থ কি জানে না, কোনদিন শব্দটি শুনেছে বলে মনেও হয়না। কক্ষে বসার পর হাজারো চিন্তা ছমিরনের মা'কে গ্রাস করে বসে। কেন ম্যানেজার মুছকি হাসি দিল?, ছলিম কুলসুমা কি বলাবলি করছিল? হুজুর  ইনটেক্ট চেনে কেন বলল ছলিম ইত্যাদি খুঁটিনাটি তৎসময়ে নাটকীয়ভাবে ঘটে যাওয়া বিষয়সমূহ অন্তরে অন্তরে বিশ্লেষন করতে লাগল।

    বিগত ২১/২২ দিন চিন্তা ছিল  মাস শেষে ঘরভাড়ার টাকা, বস্তির মুদি দোকানীর বাকি টাকা কোথায় পাবে। চিন্তায় কখন যে আনমনা হয়ে যেত ছমিরনের মা বুঝতেও পারতো না।ম্যানেজারের ধমক খেয়ে সম্ভিত ফিরে এসে ঝাড়ু নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কাজে লেগে যেত।গ্রাম থেকে আসতে আচল ছেঁড়া যে কাপড়টি দিয়ে শরীরটা ঢেকে ঢাকায় এসেছিল, সেই কাপড়টি গত দুই মাস পরনে রয়ে গেছে।হোটেলের কাজ শেষ করে বস্তিতে ফিরে বড় মেয়ের সেলোয়ার-কামিজ গায়ে জড়িয়ে, বাংলা সাবানের দুই ঘষা দিয়ে কয়েকবার ধুঁয়েছে অবশ্য। এতে কি আর নতুনের মত দেখায়? ম্যানেজার সাফ জানিয়ে দিয়েছে আগামীকাল হোটেলে আসতে নতুন কাপড় এবং সাজগোঁজ করে আসতে, না পারলে চাকুরি থেকে বিদায় করে দেবে। গত প্রায় একমাসের কাছাকাছি ঢাকায় থেকে, চেহারায় কিছুটা উজ্জলতা এসেছে, নতুন কাপড় চোপড় গাঁয়ে জড়ানো থাকলে, এবং সাজগোজ করা থাকলে, হোটেল বর্ডারদের মনোরঞ্জন করার মত চেহারা ফুটে উঠেছে ছমিরনের মা'য়ের।ম্যানেজার বাবু নিয়োগ দেয়ার সময় লক্ষ করেছিলেন চেহারার প্রতি, কিছুদিন ঢাকায় বসবাসের পর ছমিরনের মাকে বোর্ডারদের সেবায় সাময়িক কাজে লাগানো যাবে কি না।
 বিভিন্ন কাজে গ্রাম থেকে আসা ঢাকা শহরের অধিকাংশ লোক ডরভয়ে পেশাদার মেয়েদের প্লাটবাড়ীতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে না।যে কয়দিন হোটেলে থাকার প্রয়োজন হয়, সেই কয়দিন ঝাড়ুদার মধ্যবয়স্ক মহিলাদের সঙ্গে সস্তায় তাঁদের জৈবিক তাড়না মিটাতে চায়। যে সমস্ত হোটেলে মালিকের কড়াকড়িতে মহিলা ঝাড়ুদার রাখা সম্ভব হয়না, সেই সমস্ত হোটেলে বোর্ডার তো থাকেই না-- হোটেল বয়, ম্যানেজার সহ অন্যান্ন কর্মচারিরাও চাকুরি করেনা।ঝাড়ুদার মহিলাদের হোটেল বোর্ডাদের সাময়িক সেবার বিনিময়ে পাওয়া টাকার সিংহভাগ ফ্লোরে কর্মরত: বয় ও ম্যানেজারের পকেটে চলে যায়।কিয়দংস যা পাওয়া যায় এটাও কেবল কম নয়, চাকুরি শেষে হোটেল থেকে যে বেতন দেয়া হয়, তার দশগুনেরও বেশী, বৈ কম নয়।
     
        মা এবং দুই বোনকে সাজিয়ে গুছিয়ে বস্তি থেকে বিদায় দিয়ে ছমিরন হোগলা পাতার ছাটাই খানা মেঝেতে বিছিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে।রাজ্যের ভার যেন তাঁর বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে আছে,কোনমতেই বুকের ভারী বোঝা কমানো যাচ্ছিলনা।মেঝেতে শুয়ে ইচ্ছামত চোখের পানি ঝরানোর পর বুকটা যেন কিছুটা পাতলা অনুভব হচ্ছে।ছমিরনের মা এবং নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে অজানা আশংকায় বারবার বুক ভারি হয়ে আসে। কিছুক্ষন পরপর চোখের পানি ঝরিয়ে ভারমুক্ত হয়ে ছমিরন উঁকি দিয়ে বেলার মা ভাবীর দরজার দিকে দেখে নেয়, সে এসে পৌছেছে কিনা। আজ কেন এতদেরি হচ্ছে, এমনতো কখনও হয়না।প্রত্যেকদিন সকালেই তো এসে যায় বেলার মা ভাবি, আজ দুপুর হয়ে গেল আসেনা কেন? বস্তি থেকে বের হয়ে দেখে আসারও সাহষে কুলায়না।বেলার বাপ বেলার মা যতক্ষন বস্তিতে না থাকে ততক্ষন যুবক ছেলে পেলেদের নিয়ে বস্তিতে কি যেন খায়,চতুদিকে উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।কোন কোন সময়ে হৈ-হুল্লোড় হতেও শুনা যায়।বেলার মা বস্তির কাছাকাছি আসতেই সবাই শান্ত বিড়াল হয়ে বস্তি থেকে বেরিয়ে পড়ে।
    দুপুর গড়িয়ে যায় যায়, এমনি সময়ে অদুরে বেলার মা আরো তিনটি মেয়ে সহ  চেঁছামেছি করে আসার  আওয়াজ শুনতে পায় ছমিরন।সাথের তিনটি মেয়ে --এই বস্তিতে এর আগে কখনই আর ছমিরন দেখেনি।তিনটা মেয়েই যেন এক একটা পরি। কথা বলার সময় যেন ঝর ঝর করে মুক্তা ঝরে ,অলংকার পাতি কিছুই নেই, তবুও মনে হচ্ছে যেন সাজানো গোছানো সদ্য বিবাহিতা বউ।নিশ্চয়ই এরা উঁছু ঘরের ললনা। তবে বেলা ভাবীর সাথে তাঁদের সম্পর্ক কি! কেনইবা বস্তিতে আগমন তাঁদের। বেলার মা আসার আওয়াজ শুনে ক্ষনিকের মধ্যে তাঁর ঢেরায় বসা যুবকরা যার যার মত বেরিয়ে গেছে।বেলার বাপ বেলাকে কোলে নিয়ে বস্তির সামনে বসে আদর করছিল।বেলা মেয়েটা এতক্ষন কেঁদেছে খাবারের জন্যে,সকাল পার হয়ে বিকাল আসি আসি, মেয়েটার মুখে দানাপানিও পড়েনি। বেলার বাবার সুযোগ হয়নি, মেয়ের হাতে কিছু তুলে দিতে।

    বেলার মা বস্তিতে প্রবেশ করে কাপড় চোপড় পরিবর্তন করে আবার বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতিতে ব্যাস্ত।সকাল থেকে অপেক্ষা করেও ছমিরনের মনের ভাব প্রকাশ করতে না পেরে অস্বস্তিতে পড়েছে।মেয়ে তিনটা বস্তির সামনে মোড়ায় বসে গল্প করছিল।বেলার বাপ বেলাকে নিয়ে দোকানে চলে গেছে।এই সুযোগে ছমিরন যাবে কি যাবে না দ্বিধাদ্বন্ধে পড়েছে। সাথের মেয়ে তিনটাই হাইফাই, তাঁদের তুলনায় ছমিরন নীজেকে তুচ্ছই ভাবছে।গেলে মেয়েগুলো কি মনে করবে।তিন পাঁছ ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় কেটে গেছে।বেলার মাও প্রস্তুত হয়ে আর একটি মোড়া টেনে তিনজনের গল্পে যোগ দিয়েছে। দুর থেকে অনুমান করা যায়, কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চারজনে আলাপরত:। বেলার মায়ের ভুমিকা লক্ষ করা যায় শিক্ষকের ভুমিকায়।বেলার মা হাত নেড়ে কি যেন বলছে অন্য তিনজন সুবোধ বালিকার মত হৃদয়ঙ্গম করছে। এই সময়টিতে সেখানে যাওয়া সমিচিন মনে করছেনা ছমিরন। এই ফাঁকে দোকানী তাঁদেরকে চা নাস্তাও দিয়ে গেছে, সন্ধাও প্রায় ঘনিয়ে আসছে।চারজনই উঠি উঠি ভাব।এমনি সময়ে বুকে সাহষ সঞ্চয় করে ছমিরন বস্তি থেকে বেরিয়ে বেলাভাবির বস্তির উদ্দেশ্যে যেতে উদ্যত হয়। এতক্ষন সারা বস্তিতে কোন তম্বি মেয়ের সাড়া শব্দ নেই, হঠাৎ করে কোত্থেকে সুন্দরী এই মেয়ে উদয় হল। নতুন আসা তিনজনই আশ্চায্য হয়ে তাকিয়ে আছে।বেলা ভাবি এমন সময় ঢেকে বলে, কি রে ছমিরন আজ কি তোর ছুটি?আয় আয় এদিকে আয়।আমার বান্ধবীদের সাথে তোকে পরিচয় করিয়ে দেই।

    বেলার মা ভাবীর ডাক শুনে মনে সাহষ পেয়েছে ছমিরন, ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তাঁদের উদ্দেশ্যে। বেলার মা আর একটি মোড়া আনতে বস্তিতে যায়।ছমিরন নিকটে যেতে যেতেই বলে, না ভাবী,  ছুটি নয়, আর চাকুরী করব না।তুমি কি কোথাও যাচ্ছ? আমার যে কথা ছিল তোমার সাথে। বেলা ভাবী বলে, বলনা- অসুবিধা নেই, ওরা আমার ঘনিষ্ট বান্ধবী, বল অসুবিধা হবেনা।ছমিরন আড়ষ্টতায় ভুগছিল, মুখে কিছুটা জড়তা রেখে বলে-না থাক, কালকে বললেও চলবে।এমন কোন জরুরী বিষয় নয়, এখনই বলতে হবে।তোমার নিশ্চয়ই জরুরী কোন কাজ আছে, তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না।বেলা ভাবী এতক্ষনে কিছুটা আঁছ করতে পেরেছেন, মুছকি হাসি সেই কথাই বলে।বেলাভাবী বলে আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোর ঘরেই যাব, চল। এমনিতেই মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে আচিরনের--" আমি তোমার সাথে যাব"। কথাটি মুখ থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে চার জনই সম্বস্বরে চিৎকার করে বলে উঠে  "ইউরেকা"! সেকেন্ডে পাঁছজনের মজলিশ আনন্দের বন্যায় ভরে উঠেছে। বেলার মা ভাবি বিদুৎ বেগে বস্তিতে প্রবেশ করে স্যুটকেস ভর্তি কাপড়, সাজগোছের সব সরঞ্জাম, পলিথিনের বড় একটি ব্যাগে বাহারি রংয়ের জুতা নিয়ে  এসেছে। সাথে আসা তিনজনকেই নির্দেশ দেয়ার ভঙ্গিতেই বললেন "চট জলদি তাঁকে প্রস্তুত করে নাও।"

    একঘন্টার মধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন।বেলা ভাবির সবছেয়ে দামি সিঙ্গাপুর থেকে এক নব্য কোটি পতি যুবকের উপহার দেয়া জমকালো পোষাকটি ছমিরন কে পরিয়ে দেয়া হল। ছমিরন নিজেকে দেখতে পেলনা, সেখানে কোন আয়নার ব্যবস্থা ছিলনা। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে, বস্তির মেয়ে পুরুষ সবাই আসা শুরু হয়েছে।ছমিরনের দুই বোন করিমন ও অচিকেতাও এসে পৌঁছে গেছে।ছমিররনের  মা আছিয়াও কিছুক্ষনের মধ্যে আসার সময় হয়ে গেছে। বেলার মায়ের ঘরের সামনে তম্বি চার নারীমুখ কেউ আড়চোখে, কেউ কেউ উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছিল। ছমিরনের দুই বোনও এসে দেখে গেছে কিন্তু ছমিরনকে চিনতে পারেনি। ছমিরনের মা বস্তিতে পা দিয়েই ছমিরনকে ডাকা ডাকি শুরু করেছে, ছমিরন কোন জবাব দিচ্ছে না। সবাইকে জিজ্ঞেস করছে ছমিরন কোথায়, আজকে ডিউটিতে ছিল কিনা? সবাই বলেছে দেখেনি। বেলার মায়ের কাছে এসেও খোঁজে গেছে কিন্তু ছমিরনকে তাঁর মা চিনতে পারেনি। ছমিরন বেলা ভাবির সাথে অন্য তিনজন সহ হন হন করে মা বোনের সামনে দিয়ে চলে গেছে, কেউ টেরই পায়নি, পাঁছ জনের মধ্যে ছমিরনও ছিল।এরই মধ্যে সাইনবোর্ড় বরাবর একটি চকচকে লাল রঙা পাজেরো গাড়ী এসে থেমেছে,বেলাভাবি পাজেরোতে উঠার আগেই ছমিরনকে বলে দেয় এখন থেকে তোমার নাম "এঞ্জেল তানিসা।"

    ছমিরনের মা আজ কিছুটা বিমর্ষ তবে শরীর কেন জানি খুবই হালকা হালকা মনে হচ্ছে।ছমিরনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, সেই চিন্তা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি।হোটেল থেকে আসার পর থেকেই যেন রাজ্যের ঘুম চোখে এসে ভর করেছে।দুপুরে হোটেলে আজ একটু ভালই খাওয়া হয়েছিল, রাতে না খেলে,  তেমন অসুবিধা হবে মনে হচ্ছে না।পুরানো কাপড়টা বের করে চাপাকলে আবছা আবছা অন্ধকারে ঝর ঝর করে গোসল সেরে নিয়ে, চুল গুলা ভাল করে ছেঁড়া পুরাতন ন্যাকড়া দিয়ে চিপে চিপে পানি শুকিয়ে হোগড়ার পাতিটি বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে।মেয়েদের বলে রেখেছে ছমিরন এলে দরজাটা যেন খুলে দেয়,মেয়েটা যে কোথায় গেল--।ঢাকায় আসা অবদি বড় রাস্তার ওপাশে কাঁচাবাজারেও কোনদিন যায়নি মেয়েটা। ঘুমের লক্ষি ভাবার সময়টুকুও আজ ছমিরনের মাকে দিতে রাজি নয়।ছমিরনের বাবার মৃত্যুর পর আজই যেন শান্তি সুখের পরম ঘুম তাঁর চোখে ভর করেছে। হোটেল থেকে নামার সময় হোটেলবয় ছলিম বেশ কিছু টাকা হাতে গুজে দিয়েছিল।সেলোয়ারের প্যাচে মোড়ানো টাকা খুলে পুরানো বাক্সে রেখে দিয়েছে, গুনে দেখার সময় টুকু করে উঠতে পারেনি,শরীর টা যেন বিছানায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সকালে গুনে দেখবে মনে করে শোয়া থেকে না উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছে ছমিরনের মা।

     কাক ডাকা ভোরে ছমিরন ও বেলার মা'কে বস্তির সামনের বড় রাস্তায় সাইনবোর্ড়ের সামনে একটি পাজেরো নামিয়ে দিয়েছে।বেলার মা ছমিরনের একটি হাত ধরে ধিরে ধিরে নিয়ে আসছে।ছমিরন বিধ্বস্ত, এলোমেলো চুল, ঘুমের ঘোরে ঢলু ঢলু ভাব,যেন সেখানেই পড়ে যাবে। ছমিরনদের বস্তির কেউ তখনও ঘুম থেকে জাগেনি, ছমিরনের মা প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগে প্লাস্টিক বোতল, চেড়াজুতা, দুধের পট,কাঁচের বোতল কুড়ায় এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে। আজ তাঁরও কোন খবর নেই,ঘুমের ঘোরে আচেতন।ছমিরন আসবে মনে করে তাঁর বোনেরাও কেউ আর ঠেলা দরজায় পাথরের টুকরাটি দেয়নি।ছমিরনকে বস্তি ঘরের দরজায় ছেড়ে দিয়ে বেলা ভাবি নিজের ঘরে চলে যায়।ছমিরন আলতো ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়, সাথের ব্যানিটি ব্যাগটি না গুছিয়েই ছোটবোন অচিকেতার পাশে শুয়ে পড়ে।শুতে যদিও ক্ষানিক দেরি হয়, ঘুম মামা আসতে আর দেরি করেনি।

    প্রতিদিনের ন্যায় সকালে রেলগাড়ীর হুইসেলের আওয়াজে করিমন ও নচিকেতার ঘুম ভাঙ্গে,আজও ব্যাতিক্রম হয়নি।ঘুম থেকে জেগেই দুই বোন আচমকা ভিম্রি খাওয়ার উপক্রম।একি!  কে শুয়ে আছে আমাদের পাশে।উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দুই বোনই চেনার চেষ্টা করছে, এত সুন্দর ব্যানিটি ব্যাগটি কার। কোত্থেকে এল এই সুন্দরী মেয়েটি তাঁদের বস্তি ঘরে।কপাল থেকে হাত সরিয়ে চোখ ছানাবড়া দুই বোনের। এই যে আমাদের ছমিরন বুবু।এই দামি পোষাক, ব্যানিটি ব্যাগ কোথায় পেল, কখন এল! কোত্থেকে এল! ব্যাগ টেনে খুলে দেখে তো বেঁহুশ।এত টাকা জীবনেও কোনদিন দেখেনি।কোথায় পেল বুবু এত টাকা। দুই জন দুই জনের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কি যেন কথা হল, ক্ষনিকের মধ্যে উভয় নিমিষে স্বাভাবিক হয়ে নিত্য দিনের কাজে ফিরে গেল।ছমিরনের মায়ের সুখের ঘুম তখনও ভাঙ্গেনি।

     
                                       পর্ব---(তিন)
                         
             
    জুলেখা বেগমের পুর্ব পুরুষ এই এলাকায় কখন কিভাবে এসেছিল, সে তাঁর কোন ইতিহাস জানেনা।গ্রামের মাতব্বরের দাদা এই এলাকার জমিদার ছিলেন।তাঁদের জমিদারিতে বঙ্গদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এনে রায়ত বসিয়েছেন।প্রত্যান্ত অঞ্চলে কোন লোক বসতি ছিলনা।কালের প্রবাহে ফেনী নদীর  স্রোত বেঁকে বহু দূরে দক্ষিনে ফিরে গেলে অত্রাঞ্চলের বিশাল এলাকা চর পড়ে যায়।জমির মালিকানা না থাকায় মাতব্বরের পুর্ব পুরুষ ভারতের আসাম রাজ্য থেকে কিছু লাঠিয়াল ভাড়ায় এনে প্রত্যান্ত অঞ্চল নীজের দখলে নেয়।কেউ কেউ বলেন বৃটিশ সরকারের ভূমি ব্যবস্থাপনায় চাকুরির সুবাদে অত্র চরাঞ্চল সহজেই মাতব্বরের পুর্ব পুরুষ গন নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। জমিয়ার সেকান্দর সাহেবের পিতা চরের সর্ব দক্ষিনে একটি বিরাটকায় খামার বাড়ী নির্মান করে,  আসামে ফিরে যান। ফি বছর কয়েক শত ভুমিহীন পরিবারকে এনে মূল খামার বাড়ীর অদুরে বসতি গড়ে দিয়ে তাঁদের চাষাবাদের গরু, লাঙ্গল ইত্যাদি কৃষি সরঞ্জাম সহ রেখে, তিনি ফিরে যান আসামে।এভাবে পয্যায়ক্রমে বিশালকায় চরাঞ্চলের চতুর্দিকে আসামীয়,, বাঙ্গালোর, মালদহ এলাকা থেকে ভূমিহীন বাঙ্গালী হিন্দু, মমুসলিম গরীব পরিবার সমুহকে এনে  পুর্ণবাসিত করেন। স্বল্প সময়ে মাতব্বরের পুর্ব পুরুষের জমিদারীতে পরিণত হয়ে অত্র চরাঞ্চল শষ্য, শ্যামল আবাদী ভূমিতে পরিণত হয়। মাতব্বররের প্রপিতা সেকান্দার আলী উক্ত খামারবাড়ীতে স্থায়ী বসত ঘর নির্মান করে স্বপরিবারে আসাম থেকে স্থায়ীভাবে এখানে চলে আসেন।তিনি আসার সময় আছিয়ার প্রপিতাকেও স্বপরিবারে সাথে নিয়ে আসেন।তাঁদেরকে জমিদার বাড়ীর দীঘির উত্তর পাশে ছোটাকারে একটি বাড়ী নির্মান করে থাকার ব্যাবস্থা করে দেন। জমিদার সেকান্দার আলী এবং  আছিয়াদের পরিবারের বংশবৃদ্ধি না ঘটায় শেষ বিকেলে উক্ত বংশদ্বয়ের জমিদার বাড়ীতে মাতব্বর এবং তাঁর তিন ছেলে এবং উত্তারাংশে  আছিয়ার মা' একমাত্র উত্তর সুরি হয়ে বাড়ীটিতে অবস্থান বলবৎ রেখেছেন। মাতব্বরের পুর্ব পুরুষদের জমিদারি ক্রমশ: ছোট হতে হতে বর্তমানে বাড়ী সংলঘ্ন কতেক ভুমি এবং জনহীতকর কাজে খনন করা সাতটি দীঘি সহ তার চতুপাশে তিনশ একর চাষযোগ্য ভূমিতে  এসে স্থীর রয়েছে।
      জুলেখার বয়স যখন সাত আট বছর তখন একই রাতে বিষধর সাঁপের কাঁমড়ে মা বাবা দুই জনই মৃত্যুবরন করেন।সেই থেকে জুলেখা মাতব্বরের জিম্মায় কখনও জমিদার বাড়ীতে, কখনও আপন বাড়ীতে থাকেন।জমিদার বাড়ীর ঘরকন্যার কিছু কিছু কাজও সময়ে সময়ে জুলেখা বেগমের হাতেই নিস্পন্ন হয়।খাওয়া-পরা, অসুখ--বিসুখে মাতব্বর নীজের মেয়ের মতই দেখাশুনা করে থাকেন।মাতব্বরের তিন ছেলে উচ্চ শিক্ষিত সরকারি চাকুরী জীবি। তাঁরা পরিবার পরিজন নিয়ে শহরেই বসবাস করেন।পালা, পার্বনে ছুটি কাটাতে তিনজনই দেশের বাড়ী নোয়াখালীর সোনাগাজীতে বাবার নিকটে আসেন।

   মাতব্বরের প্রপিতা জমিদার সেকান্দার আলী ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের নামাজ আদায় করার জন্যে জমিদারির চতুদিকে বিরাটকায় চারটি মসজিদ, হিন্দুধর্মালম্বিদের জন্যে চারটি পুজামন্ডপ প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যান।পানীয় জলের জন্যে জমিদারি এলাকায় সাতটি দীঘিও খনন করেন।তিনি ছিলেন প্রজাবান্ধব জমিদার, প্রজাদের সুখ দু:খ্যের সাথী।তাঁর জীবিতবস্থায় জমিদারির আওতার বাহিরেও বঙ্গোবসাগরের জেগে উঠা চর তাঁর প্রজাসাধারন জমিদারের অনুকুলে নিয়ন্ত্রন বজায় রাখতেন।তাঁর মৃত্যুর পর পরবর্তি জমিদার গন গ্রামাঞ্চলে বসবাস করতে অনাগ্রহের কারনে প্রজাগন স্ব-স্ব চাষের ভুমি নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে।কালক্রমে জমিদারির আওতা ছোট হতে হতে বর্তমান অবস্থায় স্থীত আছে বিগত পঞ্চাশ বছরের অধিক কাল। বর্তমান  মাতব্বর আলী হায়দার সাহেব তাঁর পিতার একমাত্র সন্তান।তিনি জম্মবদি অত্র এলাকা ছেড়ে কোথাও যাননি।সহজ সরল জীবন যাপন হেতু সমাজে তেমন প্রভাব বিস্তার  করতে না পারলে ও  এলাকাবাসির সম্মান আর শ্রদ্ধার কোন তুলনাই হয়না। তাঁর সুশিক্ষিত ছেলেরা বহু চেষ্টা করেও তাঁকে গ্রামের মানুষ থেকে আলাদা করে শহরে নিতে পারেননি।   বাবা মাকে শহরে নিতে না পেরে তাঁদের বৃদ্ধাবস্থায় চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন।রান্না বান্না করার জন্যে প্রতিবেশী এবং তাঁদের রায়তের বিশ্বস্ত কন্যা জুলেখা থাকলেও বাজার সওদা, কেনাকাটা, বাড়ী রক্ষনাবেক্ষন ইত্যাদি বিষয় দেখাশুনার জন্যে একজন সৎ মানুষের সন্ধান করছিলেন। পত্র পত্রিকায়ও কয়েকবার বিজ্ঞাপন দিয়ে চেষ্টা করেছেন।অনেকেই চাকুরি প্রার্থী হয়ে এসেছেন সত্য কিন্তু জুনায়েদ সাহেব এবং তাঁর ভাইদের আই, কিউতে কেউই যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে ধরা দিতে পারেননি।
      এমতবস্থায় চুতুর্থবারের মত জাতীয় পত্রিকা সমুহে নুন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দেন।উক্ত বিজ্ঞাপনের সুত্র ধরে বদর ঢাকার গুলশানের বাসায় জুনায়েদ আহম্মদ সাহেবের সাথে দেখা করতে যান।প্রথমদর্শনেই জুনায়েদ সাহেবের বদরকে পছন্দ হয়, কিছু সাধারন প্রশ্ন করে দেখেন যে ছেলেটা খুবই মেধাবি।তিনি তাঁকে ফাইনাল কোন কথা না বলে পরের দিন শুক্রুবার সকাল দশটায় আসার জন্যে বলেন।জুনায়েদ সাহেব পরের দিন সকাল দশটায় তাঁর অন্য দুই ভাইকে বাসায় আসতে বলেন।শুক্রুবার সকাল দশটায় তিন ভাইয়ের ঐক্যমত্যে জুনায়েদ সাহেব বদরকে দেশের বাড়ীর কেয়ার টেকার পদে নিয়োগ দিয়ে সোনাগাজীর বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন।

      বদর আলী কাজে নিয়োগপত্র পেয়ে যেদিন নোয়াখালীর  সোনাগাজী থানার চরজব্বারিয়ার জমিদার বাড়ীতে কর্মস্থলে যোগদান দিতে এসেছিল, তাঁর ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক কোন বিষয় চুল পরিমাণও মাতব্বরের নিকট  মিথ্যের আশ্রয় নেয়নি। সে অকপটে স্বীকার করে বলেছে-গ্রামে তাঁর বউ এবং একমেয়ে আছে। তাঁর রুজি রোজগারের উপর তাঁরা নির্ভরশীল। আগে মা জীবিত থাকা অবস্থায় সবসময়ে খাওয়াতে না হলেও অসূখে বিসূখে তাঁর উপর দায়িত্ব পড়তো। তখন মা ভিক্ষাপাতি করে যাই পেতেন তাতে সুন্দর ভাবে চারটা খেয়ে পড়ে কোনমতে চলতে পারতেন। বদর আলীর উপর নির্ভর হ'তে হতনা। এখন মা জিবিত না থাকলেও তাঁর ভালবাসার প্রতিক হিরামণির ঘরে জম্ম নেয়া সোনিয়া মা রয়েছে, তাঁর খরছের জন্যেও তাঁকে মাসে মাসে  রোজগারের টাকা পাঠাতে হবে।

    বদর অত্যান্ত সততা, একাগ্রতা,  বিচক্ষনতার সহিত তাঁর প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করে দুই বছরের মধ্যেই পরিবারের সকলের প্রিয়ভাজন ব্যাক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।এদিকে মাতব্বরের শারিরীক অবস্থা খুব বেশি ভাল যাচ্ছিল না। তাঁর স্ত্রী, জুনায়েদ সাহেবের আম্মাজান ও গতবছর বয়স্কজনিত কারনে ইন্তেকাল করেছেন। জমিদারের বিশাল প্রাসাদে একমাত্র জুলেখা এবং বৃদ্ধ মাতব্বর দুইজনই মনুষ্যপ্রানী। মাতব্বর ইতিমধ্যে বদরের উপর খুব বেশি নির্ভশীল হয়ে পড়েছেন।পারিবারিক হিসেব নিকেশ, লেনদেন কিছুই আর স্মরনে রাখতে পারেননা। একমাত্র এতিম মেয়েটিও বিয়ের উপযুক্ত হয়ে ঘরে বসে আছে।তাঁকে সু-পাত্রে সম্পাদন করা মাতব্বরের নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য। কখন জীবন প্রদিপের আলো নিভে আশে বলাতো যায় না।এতিম মেয়েটি কার কাছে রেখে যাবেন, কে তাঁকে দেখাশুনা করবে।ছেলেরা বাবার খবর প্রত্যহ নেন বটে,  বাড়ীতে এসে তিনমাস ছয় মাসে একবার হলেও দেখে যায়, কিন্তু এতিম মেয়েটি সম্পর্কে চিন্তা করার সময় কোথায় তাঁদের।

     মাতব্বর সাত পাঁছ ভেবে মনে মনে জুলেখাকে বদরের
 হাতে তুলে দেয়ার চিন্তা ভাবনা এক প্রকার পাকাপোক্তই করে ফেলেছেন।বিনিময়ে যা যা করার প্রয়োজন সব কিছু করার অনুমতিও নিয়ে রেখেছেন তিন ছেলে থেকে। প্রথমেই তিনি বদরকে জুলেখার বাড়ী সংলগ্ন ত্রিশ একর এবং পেছনের দীঘিটির কাগজপত্র প্রস্তুত করার জন্যে নির্দেশ দেন। বদর মাতব্বররের নির্দেশ অনুযায়ি তাঁর কাগজপত্র গুলি ঠিক ঠাক করে মাতব্বরকে রিপোর্ট করেন। মাতব্বর পরের দিন  সকালে ঘোড়ার গাড়ী প্রস্তুত রাখার কথা গাড়োয়ানকে বলে রাখেন।সকালে ফজরের নামাজ পড়ে বদরকে নিয়ে মাতব্বর ঘোড়ার গাড়ীতে উঠে সদরের পথে যাওয়ার নির্দেশ দেন।  যথাসময়ে রেজি: অফিসে হাজির হয়ে সমুদয় সম্পত্তি জুলেখার নামে সাফ কবলা দলিল সম্পাদন করে দিয়ে তিনি বাড়ী আসার উদ্দেশ্যে বদরকে নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসেন। বাড়ীতে এসে আছর নামাজ আদায় করে বদর সহ একত্রে খানাপিনা করে ক্লান্তিহেতু সদর দরজার পালংকে শুয়ে পড়েন।

    মাসখানেক পর মাতব্বর একদিন আছর নামাজের পর বদরকে ডেকে নিয়ে বৈঠকখানায় আলাপে বসেন।এদিক সেদিক কথা বলে মাতব্বর মূল কথায় যাওয়ার ভূমিকায় বলেন-- বদর আমি জানি তুমি লোভি নও, তোমার মত সৎ মানুষ খুব কমই মিলে। আমি তোমাকে লোভ লালসা কিছুই দেখাচ্ছিনা,আমি আমার কর্তব্য করছি। বিগত দুই বছর আমার  মনের গোপন আঙিনায় একটি গোপন ইচ্ছা পুষে রেখেছি। তুমি যদি অভয় দাও আমি বলতে পারি।বদর একটু আশ্চায্য হয়ে বলে-- কি বলেন চাচা, আপনি এমন করে কথা বলছেন কেন।আপনি মরুব্বি মানুষ, তাছাড়া আপনি আমার মনিব।যা ইচ্ছা তাই বলবেন, এখানে আমার অভয়ের কি আছে। মাতব্বর বলেন জুলেখার নামে যে সাফ কবলা দিয়েছি তাঁর বাইরেও আমি তোমার জন্য এই বাড়ীর পুর্ব পাশে পাঁছ একর ভুমি  লিখে দিব। আমি একটা অনুরুধ করব, তুমি আমার অনুরুধ রাখবে কিনা শুধু বল।বদর আরো আশ্চায্য হয়ে বলে চাচা আপনি আমাকে অনুরুধ কেন করবেন! আপনি নির্দেশ করবেন, আপনার নির্দেশ মেনে নিতে আমি শিরোধায্য আছি কিনা, শুধু জানতে চাইতে পারেন।মাতব্বর আর একটু অগ্রসর হয়ে বলেন, না, না বাবা, ব্যাপারটা তোমার একান্ত ব্যাক্তিগত কিনা,  তাই বলছিলাম আর কি।

      মাতব্বরের মুখে বাবা উচ্চারন শুনে বদরের কোমলমনে  ক্ষনিকের মধ্যে প্রচন্ড আবেগ ভর করেছে। বদরের জম্মের আগেই বাবা হারিয়েছে, বাবার কি মর্ম বদর বাবাহীন জীবনের প্রতিটি বাঁকে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছে।বদর বলে তৎক্ষনাত আগপর চিন্তা না করেই বলে বসেন--চাচা, আমি জম্মের আগে বাবা হারিয়েছি।মা আমার আরো দুই ভাই সহ তিনজনকে পাঁড়ায় পাঁড়ায় ভিক্ষা করে বড় করেছে।আমি পৃথিবীতে সম্পুর্ণ এতিম, যে কূলে নাও ভিড়াই সেই কুলই ভেঙ্গে পড়ে।এই কয়দিনে আপনাদের যে ভালবাসা পেয়েছি আমার জীবনটা হাতের মুঠোয় এনে আপনাদের  উপহার দিলেও ঋন শোধ হবে কিনা জানিনা।আমি জানি, আপনাদের চাওয়ার মত, আমার কাছে তেমন কিছুই নেই। তাঁর পরেও ওয়াদা করছি---এই মহুর্তে আমার জীবনটাও যদি চান, আপনাদের খেদমতে  তাও দিতে আমি প্রস্তুত।আপনি নির্দ্ধিদ্বায় বলতে পারেন চাচা--

   বদরের মুখে এমন দৃডতা দেখে মাতব্বরের সকল আড়ষ্টতা মহুর্তেই বিলীন হয়ে গেছে।কোন রাখ ঢাক না করেই বলেন-- আমি জানি, তোমার বউ এবং এক ফুটফুটে মেয়ে আছে।তার পর বলব- তুমি আমার এতিম মেয়ে জুলেখার ভার নিয়ে আমাকে ভারমুক্ত কর বাবা।তাঁকে যতক্ষন পয্যন্ত আমি তোমার হাতে তুলে দিতে না পারব ততক্ষন পয্যন্ত আমার অশান্ত মন শান্ত হবে না বাবা।আমি যে মরনেও শান্তি পাবনা।বল তুমি আমার এতিম মেয়েটিকে গ্রহন করবে কিনা।

     বদরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে, কোন কথাই মুখ দিয়ে বের হচ্ছেনা।এক দৃষ্টিতে শুধু মাতব্বরের মুখের দিকে চেয়েই আছে।মাতব্বরের আকুল কাতরতায় বদর কিছুটা সম্বিত ফিরে পায়।বদর আসন ত্যাগ করে মাতব্বরের পায়ের উপর লম্বা হয়ে শুয়েই পড়ে আছে, উঠার কোন নাম নেই।মুখে শুধু একটি বাক্যই বের হচ্ছে, আমার হিরা চাচা। আমার হিরা চাচা।। আমার হিরা।।।
   বদর যে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে মাতব্বর বুঝতেই পারেনি। বদরকে পায়ের উপর থেকে আলাদা করার আপ্রান চেষ্টা করেও মাতব্বর ব্যর্থ হয়ে অবশেষে জুলেখাকে ডাক দেয়। জুলেখা সহ ধরাধরি করে বদরকে আলাদা করেছে সত্য, বদরতো তখন হুশ হারা। জুলেখা দৌঁড়ে ভেতর থেকে একগ্লাস পানি এনে বদরের নাকে মূখে ছিটাতে থাকে। আমার হিরা বাক্যটি বলা অস্পষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে বন্ধ হলেও তখনও হুশ হয়নি। মাতব্বর- জুলেখা আপ্রান চেষ্টা করেও বদরকে মাটি থেকে তোলে বিছানায় নিতে পারেনি। অগত্যা পাশের বাড়ীর নজির,ছমিরকে ডেকে এনে বদরকে বিছানায় তুলতে হয়েছে।সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পার হয়ে পরের দিন সকালে বদর আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসে। মাতব্বরের বিছানায় নিজেকে আবিস্কার করে অপরাধি চোখে হতভম্ব হয়ে, ফ্যাল ফ্যাল করে মাতব্বরের দিকে শুধু একদৃষ্টে  চেয়েই  আছে।
      মাতব্বর মাথায় হাত রেখে বলে---বাবা, এখন তোমার কাছে কেমন লাগতেছে।এতক্ষনে বদর বুঝতে পেরেছে মাতব্বরের বিছানায় সে নিজ ইচ্ছায় ঘুমায়নি।নিশ্চয়ই সে অসুস্থ্য ছিল, কেউ তাকে এখানে এনে শুইয়ে দিয়েছে। বদর মৃদুস্বরে বলে উঠে- ভাল আছি চাচা, ভাল লাগতেছে। মাতব্বর জুলেখাকে ডেকে পানি আনতে বলে  বদর বিছানা ছেড়ে উঠে বলে উঠে পানি লাগবেনা চাচা, আমি নিজেই কলে যেতে পারব।বদর কক্ষ থেকে বের হয়ে হাত, মুখ ধুয়ে এসে বারান্দায় নিজের কর্মের প্রতি মন দেয়ার চেষ্টা করে।জুলেখা চা, নাস্তা এনে টেবিলে রেখে চাচাকে নাস্তা করতে আসতে বলে।মাতব্বর বদরকে ডাক দিয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্যে বসে। মাতব্বর মনে মনে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ছেলেটা যদি মারা যেত বৃদ্ধ বয়সে দেশব্যাপি তাঁর বড় একটা বদনাম রটিয়ে যেত। তিনি নাস্তা খাওয়ার সময়ে ভয়ে আর কোন কথাই বলছিলেন না।বদরই প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করে বলে, চাচা-- আমাকে দুই দিনের ছুটি দিন, আমি তো আপনি প্রস্তাব দেয়ার আগেই ওয়াদা করেছি, আপনি যাই বলবেন--আমি জীবন দিয়ে হলেও পালন করার চেষ্টা করব। সুতারাং আমার তরফ থেকে আপনার সন্দেহ করার আর কোন কারন নেই।আমি জানি আপনারা আমাকে খুব বিশ্বাস করেন।আমি আপনাদের বিশ্বাসের মায্যাদা রাখবো ইনশাল্লা। তার আগে আমার প্রানপ্রিয় হিরার নিকট থেকে আমাকে অনুমতি আনতে দিন। নয়তো আমাকে মৃত্যুর পর দোযগের আগুনে জ্বলতে হবে।

   বৃদ্ধ মাতব্বর বদরের উল্লেখিত কথায় আবেগ সংবরন করে রাখতে পারেননি।তাঁর চোখের পানি টপটপ করে সামনে রাখা নাস্তার উপর পড়তে থাকে। বদরও আবেগাপ্লোত হয়ে কাঁদতে থাকেন।মাতব্বর বদরের চোখের পানি দেখে আসন ছেড়ে উঠে এসে বদরকে পাগলের মত বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে বাচ্ছা ছেলের মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।মাতব্বরের কান্নার আওয়াজ শুনে জুলেখা রান্না ঘর থেকে দৌঁড়ে এসে দেখে, বদরকে বুকে নিয়ে তাঁর চাচা শুধুই কাঁদছে আর বলছে "বাপজান তুমি আমাকে রক্ষা করেছ,বাপজান তুমি আমাকে বাঁছিয়েছ। আমি যে মরেও শান্তি পাব।

    জুলেখা কিছুই না বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে একপায়ে শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। কতক্ষন সময় পার হয়ে গেছে কেউই জানেনা।পটকে একটা ফকির এসে হাঁক দিলে সবার সম্বিত ফিরে আসে।একে অপরকে ছেড়ে দিয়ে নীজ নীজ আসনে অনেকক্ষন বসে থাকে।কারো মুখ থেকে টু শব্দটিও বের হচ্ছেনা। জুলেখাও এত ক্ষন সেখানে হা- করে দাঁড়িয়েই ছিল। ফকির আবারও খুব জোরে ভিক্ষার জন্য হাঁক দিলে জুলেখার হুশ ফিরে আসে। নিজকে নিজেই প্রশ্ন করে, আমি কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছি। মাতব্বর এবং বদর কেউই জানেনা জুলেখা এখানে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছুই অবলোকন করেছে।জুলেখা লজ্জা পেয়ে আস্তে সরে পর্দার আড়ালে গিয়ে বলে উঠে---চাচাজান, আপনাদের খাওয়া শেষ হয়েছে।মাতব্বর জবাব দিয়ে বলে---না আজ আর খাবনা, সব কিছু নিয়ে যা। বদরও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বদর কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর জুলেখা ভাসন কোসন নিতে এসে দেখে, নাস্তা যা দিয়েছিল সব রয়ে গেছে। একি  চাচাজান আপনারাতো কিছুই খাননি।মাতব্বর এখন কিছু আর খাবনা বললে জুলেখা সব কিছু জড়ো করে নিয়ে যায়।

     বদর তাঁর অফিসে গিয়ে দরখাস্ত লিখতে বসে। মাতব্বর সামনের কক্ষ থেকে বের হয়ে সেখানে যায় এবং বদরের সামনে রাখা চেয়ারে বসে বলে, কি করছো বাবা? বদর জবাব দেয় একটা দরখাস্ত লিখছি বাবা, ছুটির দরখাস্ত।মাতব্বর বলে ছেলে বাবার কাছ থেকে ছুটি নিতে হয়না।তোমার দরখাস্ত লাগবে না।তুমি দুই দিন শুধু নয়, যে কয়দিন সময় লাগে যাও।হিরাকে যদি রাজি করাতে পার নিয়ে আসবে। সেও এখানে আমাদের সাথে থাকবে। সামনের দোতলা ঘরটি আমি নজিরকে দিয়ে পরিস্কার করে রাখবো। ঘরটি সহ বাড়ীর অর্ধেক অংশ আমি দান করে দিব বলিও। তাঁকে আমার স্নেহাশীষ দিও, তাঁকে বলো আজকে থেকে সেও আমার মেয়ে।আমি তাঁকে বাবার বাড়িতে আসতে বলেছি বলিও। এই কয়টি কথা বলে মাতব্বর আসন ছেড়ে অন্দরে চলে এসেছে।

    বদর সব কিছু গুছিয়ে দেশের পথে রংপুরের কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়নের কালিখামার বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। বদর মাগরেবের নামাজের পর আপন নিবাসে পৌঁছে প্রানপ্রিয়া হিরামণি, ভালবাসার একমাত্র প্রতিক সোনিয়াকে দেখে আবেগ সংবরন করতে পারে না। বদরের চোখের পানির সাগরে হিরামণি তো ডুব দিলই কলিজা ছেঁড়া সোনিয়াকেও ভিজিয়ে দিল উভয়ের ভালবাসার অশ্রুজলে। দীর্ঘ ভ্রমনে বদর শারিরীক দুর্বলতার কারনে সকাল সকাল খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে।হিরামণি রাত জেগে শুধু চেয়েই রইলেন বদরের মুখ মোবারকের প্রতি। হিরামণির চোখে যেন বদরের ঘুমন্ত মূখখানি নিস্পাপ শিশুর চেয়েও পবিত্র লাগছিল। গত দুই বছরের মধ্যে আরো বার কয়েক বদর বাড়ীতে এসেছিল বটে কিন্তু এবারের মত করে আর কখনও খেয়াল করে দেখেনি, তাঁর প্রানের চেয়ে প্রিয় বদরকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে কেমন লাগে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মানষিকতাও জাগেনি কখনও।আজ তাঁর প্রানেশ্বরকে যতই দেখছে কেবলই দেখতে মন চাইছে। কেন আজ এমন মনে হচ্ছে হিরামণি নিজের মনকে বহুবার প্রশ্ন করেও তাঁর উত্তর পায়না।

       মধ্যরাতে ছয়মাসের সোনিয়ার ক্রন্দনে ঘুম ভেঙ্গেযায় বদরের।চোখ মেলে দেখে হিরামণি না ঘুমিয়ে কুঁপি জ্বালিয়ে তাঁর মাথার পাশে বসে আছে। হিরামণির দুই চোখ বেয়ে লোনাজল অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে।হিরামণিও বুঝতে পারেনি তাঁর চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে এবং বদর ঘুম থেকে জেগে হিরামণিকে ক্রন্দনরত: অবস্থায় অনেকক্ষন আগে থেকেই দেখছে। বদর কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে কি ব্যাপার প্রানের হিরা, প্রানপ্রিয় আমার প্রিয়তমা, তুমি কাঁদছো কেন? আমি কি কখনও আমার মনের অজান্তে তোমার মনে আঘাত দিয়ে ফেলেছি? আদরের  সোনিয়া কাঁদছে তুমিও কাঁদছো--ব্যাপার কি খুলে বল প্রিয়া। হিরামণির এতক্ষনে সম্বিত ফিরে আসে এবং তাড়াতাড়ি চোখের  পানি মূছে সোনিয়াকে কোলে তুলে নেয়। তড়িগড়ি দুধ বের করে সোনিয়াকে খেতে দেয়।বদর আবার বলে, তুমি কি আজ একটুও ঘুমাওনি, বসে আছ কেন, কাঁদছিলেই বা কেন? হিরামণি বলে আমার ঘুম আসছিল না, এমনিতেই বসে ছিলাম। তোমার চোখে পানি কেন? কই না তো, আমি তো খেয়াল করিনি, চোখে পানি এসেছিল!

     বদর আর হিরামণির ভালবাসা স্বর্গীয় ভালবাসা, তাঁদের দুইজনের মনের অন্তরঙ্গতাই আগাম আশংকার খবর জানিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে। বদরের হঠাৎ  বাড়ীতে আসা হিরামণিকে আশংকিত করে তোলে। হৃদয়ের থরথর কাঁপুনির নি:স্বরিত রস, চোখের পানির ফোঁটা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে, হিরামণির চোখ বেয়ে। ভালবাসার মানুষটি কখন কি অবস্থায় থাকে, কি করে, কেমন আছে, হৃদয়ের অনূভূতি মনেরভাব হয়ে প্রকাশ হয়ে যায়। ইহাই প্রকৃত ভালবাসার ধর্ম মনে হয়। তাইতো দেখা যায়, যুগে যুগে ভালবাসার জয় হয়েছে। অজানা আশংকা একে অপরকে কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। বিপদমূহুর্তে একে অন্যের পাশে কখন যে দাঁড়িয়ে গেছে, কেউই বুঝতে পারেনি কোনদিন।প্রকৃত ভাল বাসার ধর্মই মনে হয়--সমূহ সর্বনাশের খবর  মন আগেভাগেই দেয়--"অসহায়ত্বের বেদনা, মনের ব্যাকুলতা চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে ভালবাসার পৃথিবীতে।"

     কাকডাকা ভোরে হিরামণি কক্ষ থেকে বের হয়ে প্রাত:কর্ম সম্পাদনের পর বদরের নাস্তা তৈরির কাজে লেগে পড়েছে।বদর ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে চলে যায়।মসজিদ থেকে আসার পর হিরামণি বদরের নাস্তা নিয়ে এসে নিজেও পাশে বসে পড়ে। এইসময়ে বদরের বাড়ীতে আসার কারন বলবে কি বলবেনা ইত:স্তত করছিল। হিরামণি তাঁর মনের ভাব টের পেয়ে হাসিমূখে জিজ্ঞাসা করে, কিছু বলবে মনে হচ্ছে? বদর বলে, না তেমন কিছুনা। না, তুমি গতকাল কাঁদছিলে কেন, তাই--! হিরামণি ঠাঠ্রাচ্ছলে বলে, তুমি কিছু বলছনা তাই, অন্যকিছুনা! বদর এবার আরো ঘাবড়ে যায়---হিরামণি কি জেনে কি গেছে? বিস্মিত চোখে বদর বলে, তোমাকে কি বলি নাই, তুমি কি জান, আমি কিছু বলব? না জানিনা। তোমার চোখ, মূখ বলছিল কিছু বলবে, অথছ না বলে ঘুমিয়ে গেলে। এমনিতর হাসিঠাট্রার মধ্যে সকাল পার হয়ে দুপুর, বিকেল, রাত গড়িয়ে গেল। বদর বাড়ীতে আসার কারন কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছিলনা।

       এদিকে দুইদিন থাকবে বলে মাতব্বরকে বলে এসেছিল, অদ্য বলা না গেলে হিরামণির মনের ভাব জানার সময়ও পাওয়া যাবেনা।বলার জন্যে মনের ভেতরে ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেলেও বদর মূখ ফুটে বলতে না পেরে বারে বারে আনমনা হয়ে পড়ে।হিরামনির কয়েকবার ডাকার পরও বদর সম্বিত ফিরে পায় না।হিরামণি এবার নিজ থেকেই বলে উঠে কি ব্যাপার, তুমি কোনদিনও এমন ছিলেনা। আজ কেন এমন আচরন করছ।বার বার আনমনা হয়ে যাচ্ছ কেন? প্রতিটি কাজে ভুল করছ, আমার নাম পয্যন্ত ভুলে গেছ! তুমিতো একবারও আমাকে নাম ধরে ডাকনি। তুমি কি জাননা--তোমার পবিত্র মুখে আমার নাম ধরে ডাক শুনতে না পেলে, আমি যে পাগল হয়ে যাই।কি হয়েছে তোমার প্রিয়--খুলে  বল  আমাকে, দোহাই লাগে তোমার।তুমি তোমার মনের অব্যাক্ত বেদনা খুলে না বললে, আমার যে ঘুম, নাওয়া, খাওয়া কিছুই হবেনা প্রানপ্রিয়। তোমাকে কি তোমার মালিক খারাপ কিছু বলেছে? তুমি কি চাকুরি ছেড়ে দিয়েছ? বদরের মুখে কোন উত্তর আসেনা।

       বদরের চাকুরি হওয়ার পর মাসে মাসে যে টাকা হিরামণির জন্যে পাঠিয়েছে, ঐ টাকায় সুন্দরভাবে হিরামণি জীবনযাপন করছিল।বদরের পাঠানো টাকা থেকে যে পরিমাণ টাকা মাসে মাসে বেছে গেছে ঐ টাকার পরিমাণও কেবল কম নয়। কমপক্ষে আরো একবছর অভাবহীন জীবনযাপন সম্ভব হবে।হিরামণির মনে বদ্ধমূল ধারনা জম্মে, বদর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে।যার ফলে বদর মানষিক ভাবে অস্থিরতায় ভুগছে এবং বিড় বিড় করে আনমনে কি যেন বকছে। হিরামণি বিভিন্নভাবে বদরকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করেও তেমন ফলোদয় হলনা।বদরের এমনতর নীরবতায় হিরামণির মনের মধ্যে তুফান উঠেছে, কি হল তাঁর প্রাণেশ্বরের।দিন গড়িয়ে রাত হল---বদরের তেমন কোন পরিবর্তন হলনা।রাতের খাওয়া দাওয়ার পর যথারীতি ঘুমুতে যায় দুইজন।ঘুমতো কারও চোখেই আসেনা।হিরামণি বদরকে স্বাভাবিক করার চেষ্টার কোনরুপ ত্রুটি করেনি অথছ বদর তাঁর আনমনা আচরন করেই যাচ্ছে।কবিরাজ এনে ঝাড়ফোঁকও করিয়েছে আলগা কোন হাওয়ার আছড় লেগেছে সন্দেহে।তাবিজ কবজ নিতেও ভুল করেনি কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা।

   বদরের মনের একটিই চিন্তা, সে ওয়াদা করেছে মাতব্বর চাচার নিকট, জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা রক্ষা করবে, কিন্তু কিভাবে?  হিরামণিকে যে সে তাঁর জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসে।কোন স্ত্রী কি চায়, তাঁর স্বামী অন্য আর একজন মেয়েকে বিয়ে করুক বা অন্য নারীর প্রতি কোনরুপ আসক্ত হোক। বদর হিরামণিকে বললে সেকি কি মেনে নেবে? হিরামণি না মানলে তাঁর ওয়াদার কি হবে? ইত্যকার চিন্তায় বদর অস্থির, স্বাভাবিক জীবন চলার পথে বারবার ভুল করে অন্যদিকে তার মন চলে যাচ্ছে।এদিকে আগামী কাল সকালে উঠে সে চলে যেতে হবে নোয়াখালী তাঁর কর্মস্থলে।হিরামণিকে এখনও তাঁর মনের কথাই বলা হয়নি। মধ্যরাতের পর মনে সাহষ সঞ্চয় করে বদর।না তাঁকে যে বলতেই হবে, এখন না বলতে পারলে তাঁর জীবন যে সারাজীবনের জন্যে দুর্বিসহ হয়ে উঠবে।

      অত:পর এই কথা, সেই কথার পর বদর সম্পূর্ণ ঘটনা সবিস্তারে বলার প্রস্তুতি নিয়ে হিরামণিকে প্রথমে বলে---"মাতব্বর তোমাকে তাঁর মেয়ে বানিয়েছে প্রান, আমাকে পাঠিয়েছে তোমাকে নেয়ার জন্যে সকালে"।হিরামণি যেন আকাশ থেকে পড়েছে, আমাকে তো কোনদিন দেখেইনি মাতব্বর, মেয়ে বানাতে যাবে কেন? আমাকে মেয়ে বানিয়েছে ভাল কথা বদর কেন কথাটা দুইদিন পার হওয়ার পর বলছে।মেয়ে বানানোর সাথে বদরের আনমনা হওয়ার সম্পর্কই বা কি? ইত্যকার চিন্তার সাগরে ডুবে গেল হিরামণি।কোন কথাই তাঁর মূখ ফুটে বের হচ্ছেনা।হিরামণির প্রতিক্রিয়া ছাড়া পরবর্তি কথায় যেতেও পারছেনা বদর।এদিকে রাতও আর বেশি বাকি নেই, কথাও বলা হয়নি।ফজরের নামাজ পড়ে রওয়ানা দিতে হবে কর্মস্থলে।হিরামণিকে না জানিয়ে বদরের পক্ষে কিছু করা, আদৌ সম্ভবও হবেনা। এদিকে তাঁর ওয়াদা ও রক্ষা করতে হবে।নিরুপায় বদর হতাশার স্বরে হিরামণির প্রতি চোখ রেখে বলে---"তুমি কি যাবে আমার সাথে হিরা?"

       হিরামণি বুঝতে অসুবিধা হয়নি---''মাতব্বর সাহেবের মেয়ে ডাকার পিছনে গূঢ কোন রহস্য লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই''।তাঁর বাবার সমুদয় সম্পত্তি হারানোর এতবড় বিপদেও তাঁর প্রানের স্বামী ভেঙ্গে পড়েনি কোনদিন। যেহেতু বদরের আচার আচরণ, চলাফেরায় কোনপ্রকার ভারসাম্য রাখতে পারছেনা, সেহেতু পাতানো এই সম্পর্কের পিছনে সর্বনাশের বীজ নিশ্চয়ই রয়ে গেছে। বদর কেন তাঁকে কিছুই খুলে না বলে এত অস্থীরতায় ভুগছে, ইহাই বড় প্রশ্ন হয়ে হিরামনির মনকে দুমড়ে মূছড়ে খান খান করে  দিচ্ছে।
    স্বভাবত: মঙ্গাপীড়িত বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বরিশাল, ফরিদপুর অঞ্চলের পুরুষ মানুষদের ক্ষেত্রে একাধিক বিয়ে করা, প্রয়োজনে ত্যাগ করা, তাঁদের জন্যে কোন ব্যাপারই নয়।অতীত থেকেই বহুবিবাহ প্রথা কারনে অকারনে অত্রাঞ্চলে গেড়ে বসেছে। মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে নারীরা পুরুষদের একপ্রকার দাসি হয়ে জীবনযাপন করার সামাজিক পরিবেশ গড়ে উঠেছে আবহমানকাল আগে থেকে। উক্ত রীতি বদরের ক্ষেত্রে তাঁর একাগ্রতা, সততা, হিরামণির ভালবাসার প্রতি একনিষ্টতা, বদর হিরামণির একে অপরের প্রতি অগাদ বিশ্বাসের কারনে, বদরকে কোনরুপ স্পর্ষ করতে পারেনি।

    হিরামণি তাঁর স্বামীর অনভিপ্রেত আচরন স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে এবং তাঁর গভীর প্রেমের বহি:প্রকাশ হেতু অনমনেই বলে উঠে-ওগো প্রানেশ্বর, তোমার জীবন চলার পথে সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনের জন্যে, তুমি আমাকে যাই করার জন্যে বলবে, আমি তাই করব।আমি জানি,আমার মন বলে তুমি আমাকে তোমার প্রানের চেয়েও বেশি ভালবাস।তোমার সুখের জন্যে আমি আমার জীবন বিলিয়ে দেব, তারপরও তুমি  চিন্তা মুক্ত থাকার চেষ্টা কর।

    হিরামণির এইটুকু কথা শুনার পর বদরের মনে সিংহের মতই জোর অনুভুত হতে থাকে।তাঁর বিশ্বাস জম্মে, সে মাতব্বরকে দেয়া  তাঁর ওয়াদা রক্ষা করতে পারবে।বদর কিছুক্ষন চুপ থেকে--হিরামণির প্রতি ভালবাসার সর্বচ্ছ প্রকাশ ঘটিয়ে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এবং সাহষ করে সবিস্তারে তাঁর সকল অ-ব্যাক্ত বেদনা বিদুর ঘটনা সমূহ বলতে থাকে। হিরা কিছুক্ষন আগেও লক্ষ করেছে তাঁর স্বামী তাঁকে মনের কথা বলতে না পেরে কি অ-স্বাভাবিকতায় ভুগছিল। এমতবস্থায় তাঁর না সূচক মন্তব্যে বা মূখবয়ের সামান্য নেতিবাচক পরিবর্তনে তাঁর স্বামীর জীবন হয়তোবা রক্ষা করাই সংকট হ'তে পারে।সুতারাং যতটুকু ধৈয্যশক্তি মহান আল্লাহ তাঁর জন্যে বরাদ্ধ রেখেছেন বা বর্তমানেও আছে--সবধৈয্য যেন মহান আল্লাহ এই মহুর্তে তাঁর উপর বর্ষিত করে, মনে মনে শুধু এই কামনাই করতে থাকে। মনের সকল শক্তি দিয়ে হিরামণি সহজ, ভাবলেশহীন থাকার আপ্রান চেষ্টা অব্যাহত রাখে। বদরের সব কথা শেষ হলে শুধু একটি কথাই হিরামণি উচ্চারণ করে-"যখন যা হবে তখন তা দেখা যাবে, আগেভাগে তুমি এমন করে ভেঙ্গে পড়েছ কেন?

    ইতিমধ্যে ফজর নামাজের আযান বদরের কানে ভেসে উঠে।বিছানা ছেড়ে প্রাত:ক্রিয়া সমাপনান্তে মসজিদে জামায়াতের সহিত নামাজ আদায় করে মহান আল্লাহর নিকট কায়মনে শোকর গুজরান করে বাড়ীতে ফিরে আসে। হিরামণি ততক্ষনে বদরের যাওয়ার সকল প্রস্তুতি সমাপনান্তে নাস্তাপানি নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। স্বামী স্ত্রী উভয়ে খুশিমনে নাস্তা সমাপনের পর রওয়ানা দেয়ার মহুর্তে বদর তাঁর ভালবাসার অকৃত্তিম বন্ধন সোনিয়াকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে, প্রানপ্রীয় হিরামণির নিকট থেকে বিদায় গ্রহন করে।

      মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে বদর তাঁর কর্মস্থলে সন্ধার আগেই পৌঁছে যায়। মাতব্বর গত দুই দিন তাঁর প্রতিক্ষায় তীর্থের কাকের ন্যায় তাকিয়েছিল। যদিও বা বদরের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের  বিন্দু পরিমান ঘাটতি অবশিষ্ট ছিলনা।সকলের সাথে কৌশল বিনিময়ের পর স্ব-স্বকাজে সবাই সেদিনের মত কাজে লেগে যায়। এমনি করে সাত সাতটি দিন কেটে যাওয়ার পর মাতব্বরের মনের অস্থীরতা দিনকে দিন বাড়তে থাকে।অবশেষে শুভদিনে এক বিকেল বেলায় একাকি বদরকে মাতব্বরের বৈঠক খানায় ডেকে বসে। বদর আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল এবং মাতব্বরের ডাকের অপেক্ষায়ই ছিল। এই দিক, সেদিক কিছুক্ষন কথার পর মূলকথায় আসে  মাতব্বর এবং বদরের নিকট অনাথ চাওনিতে কি খবর জানতে চায়।বদর কোনপ্রকার ভূমিকা গ্রহন না করেই হ্যাঁ সুচক উত্তর দেয়।,ইহার জন্যই মনে হয় মাতব্বর যুগের পর যুগ অপেক্ষায় ছিলেন।মাতব্বর কি যে আনন্দিত হলেন তা আর ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়।জমিদারি নয়, তিন তিনটা ছেলের আগমনি বার্তাও নয়, কোটি টাকার লটারিও নয়। যেন আকাশের চাঁদ তাঁর হাতের মূঠোর মধ্যেই, নেড়েছেড়ে দেখছেন কি অপার মহিমায় মহান আল্লাহ এই চাঁদকে বানিয়েছেন।

    শুভকাজে দেরী করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, মাতব্বর গত ৭/৮দিনের মধ্যে বদরকে করা ওয়াদা অনুযায়ি জমির সকল কাগজপত্র প্রস্তুত করে রেখেছেন।সকালে ঘুম থেকে উঠেই গাড়োয়ানকে ডেকে আজ একাই সদরে চলে গেছেন।হিরামনি নামে মাতব্বরের পুর্ব ঘর সহ বাড়ীর অর্ধেকাংশ জায়গা রেজি: করেছেন প্রথমেই, তারপর বদরকে ওয়াদা মোতাবেক জমি রেজি: দিয়ে কাগজ নিয়ে বাড়ীতে এলেন।শুক্রুবার শুভদিন দেখে জুলেখা ও বদরের শুভ নিকাহ সম্পন্ন করেছেন সাত গরু জবাই দিয়ে, সাত গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়াইয়ে মহা ধুমধামের মাধ্যমে।বদর কে বিয়ের উপহার হিসেবে বাড়ীর দলিল ও ৫একর চাষযোগ্য ভূমির দলিল হাতে তুলে দিলেন। তাঁদের সুখের সংসার সুন্দর, সাবলীলতা কামনায় মাতব্বর তাঁর মনের যত আবেগ ছিল, সকল আবেগ ঢেলে নবদম্পতির জন্যে করুনা ভিক্ষা চাইলেন মহান আল্লাহর দরবারে।
         
                                   পর্ব---(চার)

জমিদার সেকান্দর আলী প্রতিষ্ঠিত চারটি মসজিদের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং মোঘল কারুকায্য খচিত জমিদার বাড়ীর সামনের মসজিদ। প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ে উক্ত মসজিদের তিনি নিজেই নামকরন করেছিলেন সেকান্দার আলী বায়াতুল আসমী জামে মসজিদ।এখানে তাঁর নামের শেষে আসমী যুক্ত করে তাঁর পুর্ব পুরুষদের জম্মস্থানকে সম্মানীত করেছেন বলে এলাকাবাসি মনে করেন।

      উক্ত মসজিদের ইমাম সাহেবের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন ইমামতি করার কোন মৌলভি ছিলনা।মাতব্বর তাঁর বড় ছেলেকে ঢাকায় চিঠি লিখে একজন অভিজ্ঞ,ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন ইমাম, ঢাকার যে কোন মাদ্রাসা থেকে পাঠানোর জন্য বলেন।বড়ছেলে জনাব জুনায়েদ আহম্মেদ ধর্মকর্মে অত্যান্ত পরহেজগার ব্যাক্তি। তাঁর সঙ্গে সর্বস্তরের ওলামা সমাজের উঠাবসা রয়েছে।বাবার ছিঠি পেয়ে তিনি তাঁর গুলশানের বাসা সংলগ্ন মসজিদের ইমামের সাথে দেখা করে, একজন খাঁটি ইমানদার ইমাম দেয়ার অনুরুধ করেন। গুলশান মসজিদের ইমাম সাহেব, তার পরের দিনই ফজরের নামাজের পর বর্তমান ইমাম সাহেবকে নিয়ে জুনায়েদ আহম্মদ সাহেবের বাসায় যান।জুনায়েদ সাহেবের হুজুরকে পছন্দ হওয়ায় তৎক্ষনাৎ নীজের গাড়ী দিয়ে হুজুরকে তাঁর দেশের বাড়ী সোনাগাজীতে পাঠিয়ে দেন।

          এমনিতে মসজিদের নতুন ইমাম, বুজর্গ আলেম, সারাক্ষন খুব বড়সড় হাজী গামছায় ঘোমটা দিয়ে থাকে। দুর থেকে মনে হয় যেন কোন পরহেজগার মহিলা লজ্জাবনত: হয়ে মসজিদের বারান্দায় গুনগুন করে কোরান তেলাওয়াতে মগ্ন। হুজুরের কারো প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।কত মানুষ মসজিদের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করে, কত হাজারো বে-গানা মেয়ে মানুষ মসজিদের পাশ দিয়ে শুধু উড়না দিয়ে মাথা ঢেকে হুজুরকে একটুখানি সম্মান দিয়ে পাশ ঘেঁষে চলে যায়। হুজুরের নজর কারো প্রতি পড়ে না, হুজুর তাঁর ধ্যানেই মশগুল। কে যায় আর কে আসে, খবর নেয়ার দরকারও মনে করেনা।দুপুরের ভাত পালা করে সমাজের গৃহস্ত বাড়ী থেকে আসার কানুন মসজিদের কমিটি করে দিয়েছে। রাতে হুজুর আটার রুটি, সামান্য মাংশের ঝোল দিয়ে খাওয়ার অভ্যেস।দুপুরে যে গৃহস্ত বাড়ী থেকে খাওয়ার আসবে রাতের আটারুটি, মাংশের ঝোলও সেই গৃহস্তের বাড়ী থেকে আসার নিয়ম করে দিয়েছে মসজিদ কমিটি।পান, সুপারী সাদাপাতা, আতর, গোলাপ,সুগন্ধি, তৈল, সাবান যাই কিছু হুজুরের নিত্য প্রয়োজন মসজিদ কমিটির সভাপতি সাহেবের দায়িত্ব ।

    সাত জনমেও এতবড় কামেল বুজর্গ হুজুর তাঁদের মসজিদে আর কখনই আসেনি। আল্লাহর অশেষ রহমতে এইবছর নামাজ,কলমার প্রতি অনাগ্রহি পশ্চাদপদ সমাজে বুজর্গ হুজুরের আগমন ঘটেছে।বেতনপাতিও খুব বেশি নয়, বছরের শেষে মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা, তাও রোজার ঈদে চাঁদনী রাতে দিতে হবে।বয়স্ক হুজুর, বাড়ী অনেকদুর, সিলেটের সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকায়।বছরে একবারই তিনি বাড়ীতে যাওয়ার কথা বলেছেন।বাড়ীতে বউ, বাচ্চা সবাই ভালমতই আছেন।সবাই স্কুল কলেজে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে।

   হুজুর দেশের বাড়ীতে অবস্থাপন্ন পরিবার, জম্মসুত্রে ভুস্বামী বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে, সম্পত্তি কেবল কম পাননি।মাত্র দু' হাজার একর হাওড় ভুমি, তাও আবার কয়েক গরীব গৃহস্তকে রায়ত রেখে হুজুরের বাবাজানই চাষাবাদের বন্দোবস্ত করে দিয়ে গেছেন। হুজুরকে এইসব নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন হয়না।

   হুজুর  বাপজান বেঁছে থাকতে সুনামগঞ্জ শহরের বড় হুজুরের নতুন প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থেকে পাঁছ জামায়াত পাস দিয়েছিলেন।বাপজানের হঠাৎ মৃত্যুতে আর বেশিদুর এগুতে পারেননি।বড় হুজুরের নিষেদ অমান্য করে কাঁথাকাপড়, কিতাবপত্র যাই ছিল, সব গুছিয়ে একদিন পায়ে হেঁটে চলে এলেন বাড়ীতে।অল্প বয়সেই সংসার রক্ষার তাগিদে বিয়ে শাদি করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, নিজের আপন মামাতো বোনের সাথে শুভদিনে বিয়েটাও হয়ে গেল,কোন প্রকার ঝড় ঝাপ্টা ছাড়া। মামাদের অবশ্য আগেই এই রকম একটা খেয়াল ছিল।নিজের বোনকে বিয়ে দিয়েছিলেন ভূ-স্বামী জামাই দেখে নানাজান। নানাজান তৎকালিন সময়ের বৃটিশ সরকারের বড় অফিসার ছিলেন,সরকারের নেজারতে চাকুরী নিয়ে কলকাতায় মেজিষ্ট্রেট পদে যোগদান করেছিলেন। ভারত বর্ষের বিভিন্ন জেলা শহরে চাকুরী করেছেন।মালদহের জেলা মেজিষ্ট্রেট হয়ে সুনামের সঙ্গে অবসর নিয়েছেন।ব্যাক্তি জীবনে সৎ অফিসার হিসেবে বৃটিশ সরকারের অনেক গুলী পদক পেয়েছেন।অনেক পুরানো হলেও এখনও বাড়ীর শোকেসে রেখে দিয়েছেন ছোটমামা।ছেলে মেয়েদেরও তিনি মানুষ করেছেন।পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পদে তিন ছেলেই সুনামের সহিত চাকুরি করে অবসর নিয়েছেন।সরকারি কর্মকর্তাদের দেয়া সরকারি বরাদ্দের একখন্ড জমি পেয়েছিলেন ছোটমামা। পেনশানে আসার পর এককালিন কিছু টাকায় সেখানে একটি  দ্বিতল বাড়ী বানিয়েছিলেন। এই ছাড়া ছোট মামার ঢাকা শহরে তেমন কিছুই নেই।

   বড় দুই মামা অনেক আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। তাঁদের ছেলে মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত, সবাই আমেরিকার নাগরিক।দেশের বাড়ী সিলেটের বাহুবলে আসার প্রয়োজন মনে করেনা।ছোট মামার দুই ছেলে একমেয়ের মধ্যে, ছেলে দুইজনই আমেরিকায় থাকেন।মামাজান, মামী মা আর মামাতো বোন জান্নাতুল গ্রামের বাড়ীতেই থাকেন। সারা জীবন সৎ জীবন যাপন করার কারনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মিথ্যা একেবারেই পছন্দ করেন না, ছোট মামা। গ্রামের মানুষ খুব ইজ্জত করে,ছোট সাহেব ডাকে।  জেলাব্যাপি ছোট মামার বেশ পরিচিতি রয়েছে। অভাব অনটনের কারনে নয়, চাকুরী জীবনে মিতব্যায়ি জীবন যাপনের কারনে তেমন বিলাসিতা এখনও পছন্দ করেন না। আমেরিকা প্রবাসি দুইছেলে বাবার জন্যে মাঝে মধ্যে কিছু টাকা পাঠালেও, সেই টাকা তিনি কখনও গ্রহন করেন না।পেনসনের যে কয়টি টাকা পাওয়া যায়, তাই দিয়ে  দুইজন কাজের লোক সহ পাঁছ জনের সংসার সুন্দর ভাবেই কেটে যায়।ঢাকার দ্বিতল বাড়ীর নীছতলায় দুটি ফ্লোর ভাড়ায় থেকে যে টাকা মাসে মাসে পাওয়া যায়, সবগুলী টাকাই ব্যাংকে জমা পড়ে থাকে। উপরের তলার দুটি প্লট ভাড়া দেননি, যদি কখনও ছেলেরা আসে, থাকবে কোথায়।

    আপন বোন এবং বোনের জামাই মারা যাওয়ার পর সুনামগঞ্জ আর যাওয়া হয়নি ছোট সাহেবের।বোন মারা যাওয়ার আগে একবার ছিঠি লিখেছিল কলকাতার জেলা মেজেট্রেসিতে চাকুরিকালিন।একমাত্র ভাগিনাকে সুনামগঞ্জ শহরের বড় হুজুরের মাদ্রাসায় ভত্তি করে দিয়েছে। বোনের বিয়ের পর প্রায় বিশবছর কোন সন্তান সন্ততি জম্ম নেয়নি। কত ফকির দরবেশ, কত পানি পড়া, তৈল পড়া খেয়েছে, কত হাজারবার মানৎ করেছে একমাত্র বোনটি তাঁর কোন ইয়ত্তা নেই। কলকাতার বড় বড় ডাক্তারের কাছেও কয়েকবার নিয়ে গেছে ভগ্নিপতি, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।যে যেখানে বলেছে সেখানেই গেছে, তাবিজ- কবজে বাম হাত, কোমর, গলা ভর্তি হয়ে গেছে, আল্লাহর মেহেরবাণী হয়না। অবশেষে নোয়াখালীর এক দরবেশের কেরামতিতে ভাগিনার জম্ম হয়েছে।জম্মের পর বোন শয্যশায়ী থাকতেই  নিয়ত করেছিলেন ছেলেকে আল্লার রাস্তায় দিবেন।বোনের নিয়ত অনুযায়ী যথারীতি সাতবছর বয়সে সুনাম গঞ্জের বিখ্যাত বড় হুজুরের মাদ্রাসায় দিয়ে এসেছিলেন ভগ্নিপতি। একমাত্র ভাগিনাকে মাদ্রাসা বোডিং এ রেখে আসার পর বোন, ভগ্নিপতির কান্না আর ধরেনা। বিশবছর ব্যাপি আরাধনার সন্তান চোখের সামনে নেই। আদর করে খাওয়াতে পরাতে পারছেননা।আল্লাহ এবং তার রাসুলকে সাক্ষী রেখে বোন  নিয়ত করেছিলেন সেই নিয়ত কখনই ভাঙ্গা যাবেনা।মনকে প্রবোধ দেয়ার একমাত্র সুত্র খোঁজে নেন বোন এবং ভগ্নিপতি ঐ আল্লহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে করা কসম স্মরণ করে।

     বিবিজান মাসা'ল্লাহ খুবই সুন্দরী, যত্ন আত্তিও খুবই করেন হুজুরকে। বাংলায় লেখাপড়া করা বিবি, বাবার চাকুরি সুত্রে বড় বড় শহর গুলিতে থাকার সুযোগ হয়েছিল জানাতুলের। বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে শৈশবে। জান্নাতুলের বাবা বড় সরকারি কর্মকর্তার সুবাদে আদর যত্মও পেয়েছে যথেষ্ট। শিক্ষিতা, আধুনিকা হলে কি হবে আল্লাহ ভক্তিও কেবল কম নয়। হুজুরের নির্দেশের প্রয়োজন হয়না,বরঞ্চ হুজুরকেই ফজরের নামাজ পড়ার জন্যে ডাকাডাকি করলেও উঠেনা। প্রত্যহ সকাল বেলার ঘুম নষ্ট করার বিরক্তি ছাড়া শিক্ষিতা জান্নাতুলের অন্যান্ন আচার আচরন হুজুরের কাছে কেবল খারাপ লাগেনা।দেখতে দেখতে দশটি বছর কেটে গেছে,  ইতিমধ্যে একছেলে একমেয়ে প্রাইমারি পার হয়ে হাইস্কুলে যাতায়ত শুরু করেছে। হুজুরের নামাজ কলমা পড়ার প্রতি তেমন আগ্রহ মাদ্রাসা ছেড়ে আসার পর থেকেই ছিলনা। হুজুরের কেতাদুরস্ত পোষাক আশাক,পাগড়ি, মেছওয়াক ঠিকই নিয়মিত রয়ে গেছে। বয়স যদিও খুব বেশি না হয়, মূখ ভর্তি দাঁড়ির কারনে বয়স্কই মনে হয়। হুজুরের অনিয়মিত নামাজ পড়া নিয়ে সমাজের মসজিদে অনেক কথাই কানাঘুষা হয়, কিন্তু কেউ মুখ ফুটে কিছু বলার সাহষ কেউ কোনদিন পায়নি।

ইদানিং হুজুরের মধ্যে কেমন যেন একটু পরিবর্তন এসেছে, নামাজে কলেমায় আগের মত গাফেলতি চোখে পড়েনা।এদিকে বিবির সৌন্দয্যেও ভাটা পড়েছে, আগের মত হুজুরকে বিবি তেমন আর আকর্শন করেনা। আধুনিক বিবি, তার উপর মামাতো বোন, মামাজি অর্থ্যাৎ শশুরজিও এখনও জীবিত।দ্বিতীয় বার শা'দী করার ইচ্ছা থাকলেও আধুনিকা বিবির ভয়ে, প্রকাশ করার কোন উপায়ও নেই। বিবির ইচ্ছাতেই সব কয়টি ছেলেমেয়েকে বাংলা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন হুজুর। ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা, সংসারের যাবতীয় ঝামেলা বিবি একাই সামাল দেন, সময়ে সময়ে শহর বন্দরেও বিবিজানের আসা যাওয়া আছে। বিভিন্ন ঈদ, পালা পার্বনে শহর থেকে বিবিজানই বাজার সওদা করে নিয়ে আসার অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।সাংসারিক, সামাজিক ধর্মীয়কাজে দীর্ঘ অনুপস্থীতির কারনে চৌধুরী পরিবারে একজন সদস্য জীবিত আছেন এবং তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে মৌলভি হয়েছেন, সবাই যেন ভুলেই গেছেন।কোন কাজে হুজুরের প্রয়োজনীয়তা সমাজের কেউ কখনও অনূভব করে না।


                                পর্ব----(পাঁছ)

   দিন যায়, মাস যায়, দেখতে দেখতে ছয়মাস কেটে গেছে।বদরের মন উচাটন, তাঁর হিরামণি না জানি কি করছে,তাঁর ভালবাসার প্রতিক সোনিয়াই বা কত বড় হয়েছে।সোনিয়া নিশ্চয়ই এখন হাসে, তাঁর বয়স এক বছর পার করেছে। বদর তাঁর দেশের বাড়ী যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহন করে, যথারীতি একদিন সকালে হিরামণির উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।বাড়ীতে পৌঁছে সোনিয়াকে বুকে নিয়ে কত যে হাজারো কথা বলছে বদর তাঁর কোন ইয়াত্তা নেই।হিরামণি মুছকি হাসি উপহার দিয়ে বদরের আবেগ প্রকাশ করার ছেলেমি, প্রানভরে উপভোগ করে। হিরামণির আচার আচরনে কোন প্রকার পরিবর্তন না দেখে বদর মনে মনে মহান আল্লাহকে লাখো ধন্যবাদ জানাতে থাকে। বদর বাড়ী যাওয়ার প্রাক্কালে বিয়ের উপহার হিসেবে পাওয়া জমির দলিল গুলিও সাথে নিয়ে যায়। রাতে হিরামণিকে কথাচ্ছলে দলিল হাতে দিয়ে বদর জানতে চায়, প্রানের হিরা---তুমি কি এখানে থাকবে, নাকি ওখানে থাকবে? তুমি যেখানেই থাকনা কেন---"আমার ভালবাসা তোমার সাথেই থাকবে"। তারপরও হিরামণির মনের কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে বদরের মনে হলনা, তবে কি হিরামণি সহজেই মেনে নিয়েছে জুলেখাকে---?

    হিরামণির ছাঁইচাপা শোকগাঁথা এতদিনে পাথর হয়ে চোখের জল চুষে নিয়েছিল। ইচ্ছা করেও চোখের একফোঁটা পানি আনতে পারেনি। বদরের কথার কোন উত্তর না দেয়াকেই এই মহুর্তে শ্রেয় মনে করে শুধু শুনেই গেছে, বলেনি কিছুই। সাতদিন অতিবাহিত করে বদর রওয়ানা দেয় তাঁর কর্মস্থলে।যথারীতি আগের মতই স্বাভাবিক ভাবে বদরকে বিদায় সম্ভাষন জানিয়ে হিরামণি সাতদিনের জমানো তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ব্যাথার জল সারাদিন রাত ঢালতে থাকে। তারপরেও যেন ব্যাথার সাগরের জল আর  শেষ হয়না।

    কর্মব্যাস্ততায় কখন যে মাস গিয়ে বছর ঠেকেছে বদরের বোধদ্বয় নেই।এরই মধ্যে জুলেখার ঘরে জম্ম নিয়েছে ফুটফুটে এক  মেয়ে সন্তান।দাদা বিশ গরু জবাই দিয়ে বিশ গ্রামের মানুষকে খাইয়ে  নাম রেখেছে তাঁর কলিজার টুকরা নাতিনের আছিয়া খাতুন।একইদিনে উৎসবের আমেজে বদরের কল্পনায় হিরা আর তাঁর ভালবাসা, কলিজার টুকরা সোনিয়ার চেহারা ভেসে উঠে। আরতো দেরী সয়না। মাতব্বর ও জুলেখাকে বলে বদর তৎক্ষনাৎ রওয়ানা দিয়েছে হিরামনি আর সোনিয়ার উদ্দেশ্যে। আসার সময় জুলেখাকে বলে এসেছে এবার আসতে  হিরামনিকেও নিয়ে আসবে।৪/৫ দিনের মধ্যে সে ফিরে আসবে, কোন চিন্তা যেন জুলেখা  না করে। মাতব্বর বাড়ীর পুর্ব পাড়ের হিরামনকে দেয়া ঘরখানি ধুয়ে মূছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে অপেক্ষা করতে লাগলেন, কখন আসবে বদর এবং তাঁর মেয়ে হিরামণি, নাতনি সোনিয়াকে নিয়ে।

    দিন যায়, মাস যায়, বদরতো আসেনা।এদিকে বদর বাড়ীতে গিয়ে হিরামণিকে যখনই আসতে বলেছে তখনই অনুভবে আসে ভাগ্যদেবতা বুঝি তাঁর সুখের প্রতি চেয়ে চেয়ে আগেই অট্রহাসি দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিল।প্রথম প্রথম ছয় সাতদিন কোনপ্রকার মন্তব্য না করলেও হিরামণির আরেকটি রুপ ততদিনে চাঁইচাপার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে।এদিকে কর্মস্থলে আসার প্রয়োজন অনুভবে বদরের মন চটপট করছে, অন্যদিকে হিরামনির নির্লিপ্ততা তাঁকে দিনে দিনে আশংকিত করে তুলছে। যে কুলে যায় সেই কুল যেন তলিয়ে যায় অভাগা বদরের।হিরামণি বদরের পিড়াপিড়িতে একদিন সাফ বলেই বসে---"আমি কারো জমি, বাড়ীর লালায়িত নই, আমার বাবার বাড়ী ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা।" তুমি বিয়ে করেছ, তোমার সংসার হয়েছে, তুমি যেতে পার।এখানে আসলে আসিও, না আসলেও আমি তোমার মঙ্গল কামনা করেই যাব। তৎক্ষনাৎ বদরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। সহজ সরল ভাষার এই ক্ষোভের বহি:প্রকাশের মর্মাথ্য বুঝতে বদরের বাকি রইলনা। সদা চঞ্চল, সদালাপি বদর নিমিষেই চঞ্চলতা হারিয়ে মূক হয়ে যায়। দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম, বদর নোয়াখালী তাঁর কর্মস্থলে আসার নাম উচ্ছারন করেনা, তার বিবাহিত স্ত্রী,আদরের কন্যা আছিয়ার নাম মুখেও আনেনা। হিরামণিও বদরকে কর্মস্থলে যাওয়ার ব্যাপারে আগের মত তেমন  কোন তাগাদা দেয়না।

    গেল কয়মাসে হিরামণি বেশ মনযোগ দিয়ে লক্ষ করেছে তাঁর প্রতি বদরের প্রেম, ভালবাসায় কোনপ্রকার ছেদ পড়েছে কিনা। হিরামনির মনে হচ্ছে--বদর যদি তাঁকে অধিক ভাল না বাসতো, তাহলে সে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে একবার হলেও যাওয়ার কথা বলতো।যেহেতু প্রায় একবছরের কাছাকাছি সময় পয্যন্ত বদর আর কোন কথাই এই বিষয়ে আলোচনা করেনি, সুতারাং হিরামণির দৃড বিশ্বাস জম্মে, যেখানে থাকুক যে অবস্থায় থাকুক বদর তাঁরই ছিল, তারই  থাকবে। অহেতুক দ্বিতীয় স্ত্রী থেকে বদরকে বঞ্চিত করে হিরামণি বদরের উপর অন্যায়ই করছে।জুলেখাও তাঁর স্ত্রী, তাঁরও বদরের উপর অংশিদারিত্ব রয়েছে।জুলেখার উপরেও হিরামণি জুলুমই করছে বলে বোধদ্বয় হচ্ছে। হিরামণি গভীরভাবেই চিন্তা করে দেখে-- জুলেখার তো এখানে কোন দোষ নেই। জুলেখা হয়তো বা জানেও না বদরের আগের একটি সংসার আছে এবং সেখানে তাঁর একটি মেয়েও আছে।

     বদর কাজশেষে রাতে বাড়ী ফিরে এসেছে, যথারীতি সোনিয়াকে কোলে নিয়ে আদর যত্নের পর রাতে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে ঘুমিয়ে পড়বে। সোনিয়া ইদানিং তাঁর বাবা বাড়ী আসাব্দি ঘুমায় না।বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়া তাঁর অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। সোনিয়াকে নিয়ে বদর বিছানায় খেলা করছিল,হিরামণি আচমকা বলে উঠে, তোমার আছিয়াকে নিয়ে কে খেলা করছে,তাঁর কথা কি ভুলে গেলে নাকি? বদর হিরার মূখে এই ধরনের কোন কথা শুনার জন্যে কখনই প্রস্তুত ছিলনা।কখনও বলতে পারে বা বলবে তাও ভাবেনি।আচমকা হিরার মূখ থেকে কথাটি শুনার পর বদর ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় বসেই রইল। হিরামণির মুখে আছিয়ার নাম শুনে বদরের মনে ধীরে ধীরে উদয় হতে লাগলো জুলেখা, আছিয়া, মাতব্বর চাচার স্মৃতি, না জানি তাঁরা কেমন আছে।চাচা বেঁচে আছেন কিনা,আছিয়া হাসতে পারে কিনা ইত্যাদি নানাহ কল্পনা বদরকে পেয়ে বসে।হিরামনি বদরকে কথাটা বলে ভাবলক্ষন বুঝার অপেক্ষায় বদরের মূখের দিকে চেয়ে রইল। বদর কিছুটা আনমনা হয়ে বালিশের উপর উপোড় হয়ে শুয়ে পড়েছে।সোনিয়া বাবার মূখ দেখতে না পেরে তাঁর পিঠের উপর উঠে গড়াগড়ি খেতে লাগল।বদরের পিঠে সোনিয়া নাকি হাতি নাকি মশা সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। উপোড়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি জাগ্রত স্বপ্নে বিভোর রইল, টের করতে না পেরেছে  বদর না পেরেছে হিরামণি।

    কাকডাকা ভোরে বদরকে ডেকে উঠিয়ে দেয় নিত্য নামাজ পড়ে কাজে বের হওয়ার জন্যে।আজ আর কারো খবর নেই ঘুম থেকে উঠার,সোনিয়া সুয্য উঠার সাথে সাথেই জেগে যায়,সে যথারীতি ঘুম থেকে জেগে বিছানার উপর বসে বসে একবার মা,একবার বাবার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আর নীজে নিজেই হাসছিল।সোনিয়ার খলখলিয়ে হাসিতে হিরামণির ঘুম ভেঙ্গে যায়, বাহিরে তাকিয়ে দেখে সুয্য উঁকি দিয়েছে পূর্বাকাশে।ধড়পড়িয়ে বিছানা ছাড়তে ছাড়তেই বদরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতে থাকে। এই উঠ উঠ সুয্য উঠে গেছে, কাজে যাবে কতক্ষনে।বদর ধড়পড়িয়ে উঠে দেখে অনেক বেলা হয়ে গেছে,নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে রেখেই চলে গেছে।বাহির থেকে ঘুরে এসে বদর আবার দপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।হিরামণি তাঁর যাওয়ার বেলায় পান্তাভাত আর দুটি শুকনো পোঁড়া মরিচ দিয়ে রেডি করে সামনের দরজার ধারে রেখে বদর কোথায় গেল দেখতে থাকে।পায়খানায় তো এতক্ষন থাকার কথা নয়,নাকি ভাত নেয়া ছাড়াই তড়িগড়ি চলে গেল, এমনি চিন্তার মধ্যে ঘরের ভিতরে সোনিয়ার খিলখিলিয়ে হাসি শুনে ঘরে গিয়ে দেখে, বদর যায়নি শুয়ে আছে।হিরামণি বদরকে যাবে, নাকি না যাবে কিছু না জিজ্ঞেস করে, পিছনের দিকে চলে আসে। পিছনে  এসে বাহিরে তার পড়ে থাকা অন্যান্ন কাজের প্রতি মনযোগী হয়ে পড়ে। সোনিয়া হাসি কান্নার বহু অভিনয় করেও বাবাকে তুলতে না পেরে বিফল মনরথ হয়ে গম্ভীর চেহারায় ঘর থেকে বের হয়ে আসে।সোনিয়া হিরামণির দিকে বা অন্য কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা তাঁর দাদা ভাই যে কক্ষে ঘুমাতেন, সেই কক্ষের দরজায় গিয়ে মাথা নিছু করে বসে বসে মাটির সাথে খেলায় মত্ত রইল।হিরামণি কয়েকবার ডাকার পরও সোনিয়া সেদিকে কোন খেয়ালই করছেনা।পরিমণি আনতে গেলে সোনিয়া পরিমণির নিকট ধরা দিতেও রাজী নয়।ভিষন রাগ করেছে সোনিয়া খুকি, তাঁর বাবা আজ তাঁর খেলায় সাথী হয়নি।

    এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল বদর এখনও ঘুম থেকেই উঠেনি।হিরামণি কক্ষে গিয়ে বদরকে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে আসার জন্যে বলে গেছে দুই তিনবার, বদর এপাশ ওপাশ করে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। দুপুরও প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছে--এমত: বস্থায় হিরামণি রাগত: স্বরে বদরকে ডেকে দিয়ে বলে তোমার কি হয়েছে আজকে, ঘুম থেকে উঠ না কেন? এবার বদর বিছানা ছেড়ে উঠে দেখে, আসলেই তো তাই--প্রায় বিকেল হয়ে গেল, আমি এতক্ষন ঘুমিয়েছিলাম! তাড়াতাড়ি গোসল সেরে সোনিকে ডেকে খাওয়ার জন্যে টেবিলে যাবে এমনি সময়ে লক্ষ করে সোনিয়া অন্যদিকে মূখ করে বসে আছে।আবারও ডাক দিলে আড়চোখে তাকিয়ে শুধু দেখেছে কোন সাড়াশব্দটিও করতে রাজি নাই।এতটুকুন মেয়ে, রাগ অভিমানের কি বুঝে! বদর কাছে গিয়ে কোলে নিতে চাইলেও সোনিয়া শক্ত হয়ে থাকে,কি হয়েছে মা,তোমার কি হয়েছে,আম্মু মেরেছে? সোনিয়ার এবং বদর বাপ বেটির অভিনয় মা হিরামণি ও খালা পরিমণি দূর থেকে দেখছিল আর মিটি মিটি হাসছিল।

  অদ্য যেহেতু বদর কাজে যায়নি, সকাল থেকে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে, সুতারাং আজকে বিকেল থেকে রাতব্দি হিরামণি বদরের সঙ্গে একটি সমঝোতামূলক আলোচনা করার সিন্ধান্ত নেয়।সেই মোতাবেক দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর বদরকে ভাত দিয়ে পাশে বসে আলোচনা করার পরিবেশ তৈরি করা যায় কিনা, হিরামণি বদরের মনমানষিকতা বুঝার চেষ্টা করছিল। ইনিয়ে বিনিয়ে নানাহ কথা বলে বদরকে পরিক্ষা করে নিচ্ছিল, সে তাঁর কথাগুলি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবে কি, পারবেনা। বদর হিরামণির প্রত্যেক কথার উত্তর চোখের ভালবাসায় গ্রহন করে নিচ্ছিল, মূখে কোন জবাবই দিচ্ছিল না। ভালবাসার লোভাতুর হিরামণি স্বামীর এহেন আচরণে মনে মনে খুব খুশি। আরো পেতে কথার ফুলঝুরি চুটিয়েছে মূখে।বদর খাওয়া শেষে নিজ বিছানায় শুয়ে পড়েছে সোনিয়াকে নিয়ে, হিরামণিও সোনিয়ার উছিলায় বদরের পাশে এসে বসে। উভয়ে সোনিয়াকে নিয়ে খেলার ফাঁকে ফাঁকে চোখের দৃষ্টি বিনিময়ে মিষ্টি হাসিতে ভালবাসার নিয্যাস তুলে নিতে ব্যাস্ত সময় পার করছে।বদরের বার বার কেন জানি মনে হচ্ছিল অনেকদিন পর তাঁর প্রেয়সি হিরামণি ভালবাসার সব নিয্যাস আজ ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করছে।হিরামণিরও একই অনুভূতি মনের মধ্যে। উভয়ের মনে তখন শুধু একটাই কামনা--'এই একান্ত সময়টুকু যদি জীবনে কোন দিন শেষ না হত, তবে না কতই সুখি হতাম।'

    ভালবাসার চরম মূহুর্তেও হিরামণি ভুলে যায়নি, সে কি কথা বদরের সঙ্গে একান্তে আলাপ করার মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিল।উপযুক্ত সময়ে হিরামণির মূখ থেকে সেই কাংখিত বাক্যটি বের হয়ে আসে।বদর এবার কোন অবস্থায় অ-প্রস্তুত নয়, গতকাল সন্ধায়ও হিরামণি তদ্রুপ কথাই বলেছিল।বদর ভাবলেশহীন চিত্তে সোনিয়াকে নিয়েই ব্যাস্ত, হিরামণি কি বলেছে, বদর যেন একেবারেই শুনেনি। হিরামণি বুঝতে পেরেছে, বদর ইচ্ছা করে ব্যাপারটি তার সাথে আলোচনা করতে চাইছেনা, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হিরামণি তাঁর এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষন দেখে বুঝতে  পেয়েছে, প্রায় একবছর তাঁর বদরের অন্তর জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।তবুও মূখ ফোটে হিরামণিকে কিছুই বলেনি, হিরামণিকে বুঝতেই দেয়নি সোনিয়ার মতই তাঁর মেয়ে আছিয়ার জন্যেও মনটা একই ভাবে কাঁদে।যদিও হিরামণির ভালবাসার বিনিময়ে যতটুকু ত্যাগ করা সম্ভব হবে জুলেখার জন্যে ঠিক ততটা ত্যাগ তাঁর সম্ভব হয়ত বা হবেনা। কিন্তু আছিয়া তো তাঁরই ওরশের সন্তান, তাঁরই রক্তের নিয্যাসে জম্মেছে, ঠিক যেমনটি সোনিয়ার জম্ম হয়েছে।সোনিয়া থেকে কোন অংশেই আছিয়াকে কম ভাল বাসে না বদর।সোনিয়ার প্রতি তাঁর অন্তরের ভালবাসার বহি:প্রকাশ স্বাভাবিক অন্যদিকে আছিয়ার প্রতি তাঁর ভালবাসার বহি:প্রকাশ গুমড়িয়ে গুমড়িয়ে কেঁদে কেঁদে পাথর হয়ে বুকে চাপ দিয়ে বসে আছে।

  বদরের শুনেও না শুনার তাৎপয্য হিরামণি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে অসুবিধা হয়নি।তাঁরপ্রতি প্রগাড় ভালবাসায় কোনপ্রকার ছেদ পড়ুক বদরের কাম্য নয়। তাই বদর আছিয়ার ব্যাপারটিকে হিরামণির নিকট থেকে বারবার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।এহেন প্রেমানূভূতি টের পেয়ে হিরামণি আবেগে আপ্লুত হয়ে  বদরকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে---"এই তুমি আমার কথা কি শুনছনা?" বদর স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দেয় হুম শুনছিতো। হিরামণি জিজ্ঞেস করে তবে কথা বলছনা যে।বদর নিছের দিকে তাকিয়ে বলে আমি  কি বলব--'তুমি বলছো, আমি আর কি বলব।হিরামণি এবার সুযোগ পেয়ে  বলে--আগামীকাল সকালে যাও, আছিয়াকে দেখে আস--যাবে?এবার বদর কাত হয়ে হিরামণির দিকে ফিরে চোখে চোখ রেখে আশ্চায্যের সুরে বলে উঠে, কি বলছ তুমি! হিরামণি বদরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, আমি অন্তর থেকেই বলছি,তুমি সকালে যাও,কয়দিন নোয়াখালীতে থেকে আস, মেয়েটাকে দেখে আস। প্রায় একবছর হয়ে গেল, মেয়েটা তোমার সঙ্গ পায়নি।নিশ্চয়ই জুলেখাও তোমার হঠাৎ অন্তধানে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।তুমি যদি যাও আমার মনে কোন ব্যাথা লাগবে না বরঞ্চ আমি অনেক বেশি খুশিই হব।
    বদর কিছুক্ষন চুপ থেকে কি যেন চিন্তা করে, তাঁরপর চোখ দুটি নামিয়ে নিছুস্বরে বলে---আমি আসার সময় আছিয়াকে কথা দিয়ে এসেছি তোমাকে নিয়ে যাব।একবছর পর আমি একা কেন যাব? আমিতো ওয়াদা ভঙ্গ করি না, তুমি জান।আমি একা যদি যাই,আমার ওয়াদা ভঙ্গ হবে।তুমিও যদি আমার সাথে যাবে বল--পরিমণি,সোনিয়া সবাই মিলে যাব।হিরামণি বলে--আমি সহ চলে গেলে বাড়ীটা দেখবে কে, মামলা চালাবে কে? বদর বলে আগে সিদ্ধান্ত নাও, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।গত কিছুদিন যাবৎ হিরামণি মনে মনে চিন্তা করছিল তাঁর সতীনকে একনজর দেখে আসা যায় কিভাবে। এবারে বদরের তাঁর যাওয়ার প্রশ্নে অনমনীয় মনোভাব দেখে হিরামণি সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাইলনা। হিরামণি অনেকক্ষন চিন্তা ভাবনা করে বলে, তাহলে ঠিক আছে আমরা আগামী বৃহস্পতিবারেই যাই। তুমি সদরে গিয়ে উকিল সাহেবের সাথে কথা বলে আস, অনুপস্থীতিতে মামলা চালানো যাবে কিনা।বদর হ্যা সুচক জবাব দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বাহিরে উঠানে পা দেয়।

    বাহিরের খোলা আকাশটা আজ বিকেলে বদরের নিকট খুবই অন্যরকমই লাগছে।দক্ষিনা হাওয়া চুলগুলি বার বার এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে।বিকালের নিলাভ আকাশটা যেন আজ বড্ড উদার হয়ে পৃথিবীর আলোটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে।বাড়ীর চতুপাশে হাঁটাহাঁটি করতে আজ যেন অন্য এক অনুভূতি টের পাচ্ছে।মাগরেবের আজান কানে আসতে চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে ধীরলয়ে গৃহে প্রবেশ করে, জামাটা টেনে গায়ে জড়িয়ে মসজিদের দিকে পা বাড়াল বদর।

    সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে প্রাত:কর্মাদি সমপনান্তে বদর সদরের পথে রওয়ানা হয়। সবকিছু ঠিক ঠাক করে দুপুরে বাড়ী ফিরে আসে বদর।দুপুরের ভাত খেয়ে কিছুক্ষন বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে বসে। হিরামণিকে ডাক দিয়ে কাছে নিয়ে আসে।সোনিয়াকে হিরামণির কাছ থেকে কোলে তুলে নিয়ে কিছুক্ষন খেলা করার পর বলে---হিরামণি, যাবে যখন আর দেরি কেন, কাল সকালেই চলনা।হিরামণি বুঝতে পারে বদরের আর তর সইছেনা।তাঁর মন চঞ্চল হয়ে পড়েছে।হিরামণি উকিল সাহেব কি বলেছে জানতে চাইল।বদর সবিস্তারে উকিলের পরামর্শ বুঝিয়ে বলার পর হিরামণি সায় দিয়ে বলে, তাহলে ঠিক আছে কালই যাওয়া যাক।


                              পর্ব----(ছয়)


    জমিদার সেকান্দর আলী প্রতিষ্ঠিত চারটি মসজিদের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং মোঘল কারুকায্য খচিত জমিদার বাড়ীর সামনের মসজিদ। প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ে উক্ত মসজিদের তিনি নিজেই নামকরন করেছিলেন সেকান্দার আলী বায়াতুল আসমী জামে মসজিদ।এখানে তাঁর নামের শেষে আসমী যুক্ত করে তাঁর পুর্ব পুরুষদের জম্মস্থানকে সম্মানীত করেছেন বলে এলাকাবাসি মনে করেন।

           উক্ত মসজিদের ইমাম সাহেবের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন ইমামতি করার কোন মৌলভি ছিলনা।মাতব্বর তাঁর বড় ছেলেকে ঢাকায় চিঠি লিখে একজন অভিজ্ঞ,ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন ইমাম, ঢাকার যে কোন মাদ্রাসা থেকে পাঠানোর জন্য বলেন। বড়ছেলে জনাব জুনায়েদ আহম্মেদ ধর্মকর্মে অত্যান্ত পরহেজগার ব্যাক্তি। তাঁর সঙ্গে সর্বস্তরের ওলামা সমাজের উঠাবসা রয়েছে।বাবার ছিঠি পেয়ে তিনি তাঁর গুলশানের বাসা সংলগ্ন মসজিদের ইমামের সাথে দেখা করে, একজন খাঁটি ইমানদার ইমাম দেয়ার অনুরুধ করেন।
 সামাজিক অবহেলা, আপন মামাতো বোন বিবিজান তাঁর প্রতি অ-মনযোগীতা, আপন ছেলেদের অ-শ্রদ্ধা,অবহেলায় মৌলবি সাহেবের নিজের জীবনের প্রতি চরম অনিহা এসে যায়। অনিহা অবহেলা একসময়ে হতাশায় পরিণত হয়ে সংসার ধর্মের প্রতি ঘৃনার জম্ম দেয়।  একমাত্র ওয়ারিশ হিসেবে পাওয়া বিশাল ভূসম্পদ, হাওড়-বাওড়, বিশাল বাড়ীঘর মৌলবি সাহেবের ভোগ বিলাসে কাজে না লেগে,  বোঝা হয়ে জগদ্দল পাথরসম ভারী হয়ে তাঁর বুকের উপর যেন চেপে বসেছে।একাকি জীবন তাঁর নিকট তুচ্ছ মনে হতে থাকে, নিস্কর্মা অবহেলিত জীবন নিয়ে আর যেন চলা যায় না।

    বড় হুজুরের মাদ্রাসায় পাঠ্যবস্থায় ভুস্বামীর একমাত্র পুত্র হিসেবে খুবই আদর যত্ম পেয়েছিলেন। তাঁর পিতা জনাব গালিব উল্লাহ চৌধুরী জীবিতবস্থায় বড় হুজুরের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকালিন সবছেয়ে বড় অনুদান দাতা ছিলেন। একজন নিবেদিত মাদ্রাসার দাতা পুত্র এবং অঢেল ধন সম্পদের মালিকের ছেলে হিসেবে বড় হুজুর এবং তাঁর সহপাঠি বন্ধু, বান্ধবেরাও সম্মান, শ্রদ্ধা করেই কথা বলতেন।হয়তো বা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারনে 'কোরান ও  হাদিসের উপর জ্ঞান অর্জন করার জন্যে আল্লাহ তাঁকে কবুল করেনি।প্রাথমিক পাঠ গ্রহন অবস্থায় প্রতাপশালী পিতার অকাল  মৃত্যুতে রাতারাতি বিশাল সম্পদের একচ্ছত্র মালিকানা প্রাপ্তি অহমিকায় অথবা মনের অন্য এক  ভীমরতির কারনে মাদ্রাসা ছেড়ে  চলে এসেছিলেন। এমতবস্থায়  না হল তাঁর কোরান ও হাদিসের উপর জ্ঞানার্জন, না হল সামাজিকতার মাধ্যমে জমিদারীত্বের প্রভাবে সমাজকে প্রভাবাম্বিত করার জ্ঞান।সামাজিক কূটচালের মাধ্যমে সাধারন মানুষকে বশ্যতায় নিয়ে আসা কঠিন একটি কাজ বটে।, সামাজিকতা রক্ষার কূটচাল শিক্ষা নি:সন্দেহে একটি বড় শিক্ষা, সেই চর্চা করা যায়নি অধিকতর শিক্ষিত, আধুনিক বিবিজানের প্রভাবের নিছে চাপা পড়ে।

       এমতবস্থায় বেশভূষায় বড় আলেম,বুজর্গান হিসেবে একাধিবার বিব্রতকর পরিস্থীতির শিকার হয়ে অপমান অপদস্ততাও মেনে নিতে হয়েছে অবলিলায়। বড় আলেম  মনে করে মসজিদের সাধারন মসুল্লিগন  ইমামতি করার জন্যে ঠেলে দেয় সামনে।দীর্ঘ বছর আগে মাদ্রাসা ছেড়ে এসেছে, যা কিছু অর্জন ছিল  অন-ভ্যাসে ইতিমধ্যে  তাও বিস্মৃত প্রায়।ভূলে ভরা সূরা কেরাৎ দিয়ে তো আর নামাজ পড়ানো যায় না।ছোট বেলা থেকে পরিধানে অভ্যস্ত সুন্নতি বেশ ভূসাও চটজলদি ফেলে দেয়া যায়নি। মাদ্রাসা ছেড়ে সূন্নতি পরিধেয় বস্ত্র ফেলে দিলে তাহলেও এতদিনে  হয়তো বা সমাজ, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব ভূলেই যেতেন তিনি মাদ্রাসায় পড়ুয়া কিঞ্চিত ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন মৌলবি ছিলেন।

      সর্বদিক থেকে অবহেলা, অনাদরে বাড়ীতেই বসেই কোরান হাদিছের উপর জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করেও কোন অগ্রগতি লক্ষ করতে পারেননি তিনি। এমত:বস্থায় বাড়ী ঘর, বিবি বাচ্ছা, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার পোঁকা ঢুকে যায়  মাথায়। মাথায় ঢুকে যাওয়া পোঁকার কিলবিলে আর অপেক্ষার তর সয়না।একদিন মধ্যরাতে জমিদার মোলবি সবকিছু ছেড়ে ছঁড়ে বের হয়ে গেলেন। রাতভর হেঁটে বড় রাস্তার পাশে এক মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে চেপে বসেন ঢাকাগামী বাসে।ঢাকায় নেমে এদিক সেদিক ঘুরেফিরে কোথাও নীজেকে কয়দিন লুকিয়ে রাখার জায়গার ব্যবস্থা করতে পারলেন না।অগত্যা মসজিদেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢুকে গেলেন এক মসজিদে।মৌলবি সাহেব  তাঁর বাড়ী ছেড়ে আসার উদ্দেশ্য সাধনে ব্রতি হন। সহজে সবকিছু আয়ত্ব করার জন্যে একজন ভাল আলেমের সাহচায্য এই মহুর্তে তাঁর খুবই প্রয়োজন মনে হতে লাগলো। ঢাকা শহরে তেমন পরিচিত কোন মাওলানা বহু চেষ্টা করেও তিনি খুঁজে পেলেননা। পরিচিত জনদের নিকট থেকে লুকানোর জায়গা  খুঁজতে খুঁজতে  একসময়ে গুলশানের বহুতল মসজিদে রাত্রি যাপনের সুযোগ দেখতে পান।

      ঐ মসজিদে এশার নামাজের সময়ে ইমামের ঠিক পেছনে বসে তিনি নামাজ আদায় করেন।   সবাই নামাজ শেষে বের হয়ে গেলেও তিনি  আর মসজিদ থেকে বের হলেন না।ইমাম সাহেব মসজিদে নামাজ পড়িয়ে পাশের বাসস্থানে ঘুমাতে যাবেন--এমন সময়ে আগুন্তুক  মৌলবি ইশারত উল্যা চৌধুরী তাঁর শরনাপন্ন হয়ে কিঞ্চিত সহযোগিতার আবেদন জানান। তাঁকে পুর্বাপর বিস্তারীত বলার আগে পরিচিতি চাইলে দেখা যায় দুই জনই একসময় একই মাদ্রাসার বড় হুজুরের ছাত্র ছিলেন।মসজিদের ইমাম সাহেব ঢাকা গুলশান মসজিদে এসে মুপ্তি মাওলানা সাঈদুর রহমান (র: কু:অ:) গোলবাগী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। মোলবি ইশারত উল্যা ছাহেব এই নামে চিনতে তাঁকে কিছুটা গোলক ধাঁ ধাঁয় পড়ে গেলেন। গোলবাগী ছাহেব কিন্তু আগুন্তুক মোলবি জমিদার পুত্রকে ঠিকই চিনে গেছেন এবং জমিদার পুত্র হিসেবে সম্মানের সহিত মসজিদের পাশে একটি খালি কক্ষে তিনি তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।

      সকালে ফজর নামাজের পর গোলবাগী ছাহেব মৌলবি ছাহেবকে তাঁর মসজিদ সংলগ্ন কক্ষে নিয়ে নাস্তার ফাঁকে ফাঁকে উভয়ের জীবন নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন।আলোচনার একপয্যায় মৌলবি ইশারত ধর্মীয় জ্ঞানে তাঁর দৈন্যতা এবং অন্যান্ন দুর্বলতা সমূহ গোলবাগী ছাহেবের নিকট অকপটে প্রকাশ করেন। তিনি নির্দিদ্বায় মত প্রকাশ করে বলেন যে--'শুধুমাত্র জীবন জীবিকার গ্যারান্টি পেলেই হবে, তাঁর কোন প্রকার টাকা পয়সা বা অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। এর আগে বিশেষ অনূরুধ করে বলেন মাওলানা ছাহেব যেন দয়া করে তাঁর কোরান পড়া শুদ্ধ করে দেন। মাওলানা মুফতি গোলবাগী ছাহেব খুবই বিচক্ষন, ধুরন্ধর প্রকৃতির মাওলানা ছিলেন। তিনি আঁছ করেন যে নিশয়ই জমিদার পুত্র ইশারত উল্যা ছাহেব সদাশয় একজন  সরল প্রকৃতির মানুষ।সরলতার কারনে আপাদমস্তক সুন্নতি পোশাকে আবৃত থেকে নিজের ধর্মজ্ঞানের দৈন্যতা অকপটে স্বীকার করে বলে দিয়েছেন।
      গোলবাগী ছাহেব মনে মনে ভাবতে থাকেন, আমিও ইশারত উল্যা ছাহেবের মতই সনদহীন, মাত্র পাঁছ জমাত পড়ুয়া মৌলবি।জীবন জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বেরিয়ে নামের আগে পরে টাইটেল সংযুক্ত করেছি এবং ঢাকা শহরে বহু কাঠখড় পুঁড়িয়ে অবশেষে গুলশান মসজিদে চাকুরি পেয়েছি। আমার ব্যাক্তিগত জীবন ধারার আমূল পরিবর্তনের কারনে স্থানীয় মসজিদে নামাজ পড়ুয়া মসুল্লিদের মধ্যে,  আজও কেউ টের করতে পারেনি---'আমি মুফতি বা অন্য কিছু আদৌ নই'। আল্লাহর অশেষ রহমতে  দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছি এবং লক্ষ লক্ষ টাকাও পরিবারের জন্যে রুজিরোজগার করে চলেছি।সুতারাং ইশারত উল্যা ছাহেবকে কিছুটা সহযোগীতা দিতে পারলে হয়তো বা তাঁর জীবনের চাকাও সে নিজ থেকে ঘুরিয়ে নিতে পারবে। গোলবাগী ছাহেব ইশারত উল্যাহকে তাঁর নিকট রেখে সুরা কেরাতের কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং চলাফেরার কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ ট্রিপস দিয়ে একখানা মসজিদের ইমাম বা মোয়াজ্জিন পদে চাকুরী দেয়ার মওকার অপেক্ষায় রইলেন। বেশিদিন অপেক্ষার প্রয়োজন হয়নি--একদিন আছরের নামাজের পর তাঁরই পিছনে নিয়মিত নামাজ আদায়কারি সরকারি বড় চাকুরিজীবি জনাব জুনায়েদ আহম্মদ সাহেব আসেন এবং তাঁর দেশের বাড়ী নোয়াখালির জন্যে একজন খাঁটি ইমাম দেয়ার অনূরুধ করেন।

   রাতে এশার নামাজের পর মুফতি মাওলানা  গোলবাগী ছাহেব মৌলবি ইশারত উল্যা ছাহেবকে জুনায়েদ সাহেবের দেয়া প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন এবং প্রত্যন্ত গ্রামে চাকুরি করার মনমানষিকতা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করেন।মৌলবি ইশারত উল্যা ঠিক যেন এই ধরনের প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে পরিচিত জনের আওতার বাহিরে কোথাও নিজেকে লুকানোর জায়গাই খুঁজছিলেন মনে মনে এতদিন।মৌলবি ইশারত উল্যা হ্যা সূচক জবাব দিলে গুলশান মসজিদের ইমাম সাহেব, তার পরের দিনই ফজরের নামাজের পর বর্তমান ইমাম ইশারত উল্যা সাহেবকে নিয়ে জুনায়েদ আহম্মদ সাহেবের বাসায় যান।জুনায়েদ সাহেব হুজুরকে প্রথম দর্শেনেই পছন্দ হওয়ায় তৎক্ষনাৎ নীজের গাড়ী দিয়ে বুজর্গান হুজুরকে তাঁর দেশের বাড়ী সোনাগাজীর চর জব্বারিয়ায় জমিদার বাড়ীতে তাঁর বাবার নিকট পাঠিয়ে দেন।

          জুনায়েদ সাহেব কতৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে হাওড়ের জমিদার পুত্র মৌলবি ইশারত উল্যা চৌধুরী নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান মুফতি মাওলানা ইশারৎ উল্যা চৌধুরী (র: আ:) মাদানী ছাহেব। গ্রামে পদার্পন করেই প্রথম প্রথম দুই তিন দিন তেমন কোন বুজর্গপনা না করলেও গ্রামের কে কেমন খোঁজখবর নিয়েছেন। হুজুরের নিয়োগ কর্তা মাতব্বর সাহেবের ঘরে সুন্দরী জুলেখা বেগমকেও তিনি লক্ষ করেছেন অন্তদৃষ্টি দিয়ে।দু:খী মেয়েটার প্রতি নজর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হুজুরের অন্তর আত্মা কেঁদে উঠে।কৌশলী হুজুর জুলেখা বেগমের মূল পরিচিতি সংগ্রহ করতে বেশী সময় লাগেনি।

            আছিয়ার মায়ের দুইকুলে কেউ আর জীবিত নেই, বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে রংপুরের এক মধ্য বয়সি যুবকের সাথে।তিনি এসেছিলেন জমিদার বাড়ীর কেয়ারটেকার হয়ে।মাতব্বর চাচা তাঁর সততার গুনে তাঁর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন বড় শখ করে ধুমধামের সহিত। স্বামী বেচারা যে কয়দিন ছিল, সুখেই কেটেছিল দিনকাল।আছিয়ার জম্মের পর স্বামী তাঁকে রেখে নিরুদ্দেশ।এতিম মেয়ে, কি আর করা।গ্রামের অনেকের কাছেই ছুটাছুটি করেছে, স্বামীর খোঁজখবর নিতে, স্বামীর দেশের বাড়ী রংপুর। বিয়ের সময়ে যে ঠিকানা দিয়েছিল সেই ঠিকানায় রংপুর জেলার গাইবান্ধা থানা লেখা ছিল। অনেক দুরের পথ, আসা যাওয়ায় অনেক টাকা পয়সা খরছ পাতির দরকার।গেল রমজানে আছিয়াকে দেয়া মাতব্বর সাহেবের বেশ কিছু  টাকা হাতে এসেছিল।সব কয়টি টাকা আঁছলে গিট্রু দিয়ে বেঁধে রেখেছিল অনেকদিন।গ্রাম শুদ্ধ হন্যে হয়ে খোঁজেও কাউকে পেলনা, সঙ্গি হিসেবে নেয়া যায়।যার কাছেই যায় সে যেন লোভাতুর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। যুবক ছেলে অনেকেই আছে কিন্তু সাহষে কূলায়না, কাউকে সঙ্গে নিতে।পাছে সমাজ কি মনে করে বসে।

    এমনিতে মসজিদের নতুন ইমাম, বুজর্গ আলেম, সারাক্ষন খুব বড়সড় হাজী গামছায় ঘোমটা দিয়ে থাকে। দুর থেকে মনে হয় যেন কোন পরহেজগার মহিলা লজ্জাবনত: হয়ে মসজিদের বারান্দায় গুনগুন করে কোরান তেলাওয়াতে মগ্ন। হুজুরের কারো প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।কত মানুষ মসজিদের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করে, কত হাজারো বে-গানা মেয়ে মানুষ মসজিদের পাশ দিয়ে শুধু উড়না দিয়ে মাথা ঢেকে হুজুরকে একটুখানি সম্মান দিয়ে পাশ ঘেঁষে চলে যায়। হুজুরের নজর কারো প্রতি পড়ে না, হুজুর তাঁর ধ্যানেই মশগুল। কে যায় আর কে আসে, খবর নেয়ার দরকারও মনে করেনা।দুপুরের ভাত পালা করে সমাজের গৃহস্ত বাড়ী থেকে আসার কানুন মসজিদের কমিটি করে দিয়েছে। রাতে হুজুর আটার রুটি, সামান্য মাংশের ঝোল দিয়ে খাওয়ার অভ্যেস।দুপুরে যে গৃহস্ত বাড়ী থেকে খাওয়ার আসবে রাতের আটারুটি, মাংশের ঝোলও সেই গৃহস্তের বাড়ী থেকে আসার নিয়ম করে দিয়েছে মসজিদ কমিটি।পান, সুপারী সাদাপাতা, আতর, গোলাপ,সুগন্ধি, তৈল, সাবান যাই কিছু হুজুরের নিত্য প্রয়োজন মসজিদ কমিটির সভাপতি সাহেবের দায়িত্ব ।

  জুলেখার স্বামী বদর তাঁর দেশের বাড়ী যাওয়ার প্রাক্কালে বলে গিয়েছিল ৫/৭ দিনের মধ্যে তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু প্রায় একবছর তাঁর কোন খোঁজ খবর না পাওয়ায় জুলেখা একরকম প্রায় নিশ্চিত যে বদর আর কখনও ফিরে আসবেনা।প্রতিবেশি সকলেই জুলেখার মতই মনে করে বদর আর আসবেনা না।বদর তাঁর রংপুর দেশের বাড়ী যাওয়ার ২/৩মাসের মধ্যেই পাঁড়ার উঠতি বয়সের ছেলে ছোঁকড়াদের নজর জুলেখার প্রতি তীক্ষন হতে থাকে। প্রতিবেশী নজির,সুলেমান তাঁরাও লক্ষ রাখে জুলেখার গতিবিধি, কার সাথে কথা বলে,কার বাড়ীতে যায়।

   এদিকে জুলেখার একমাত্র অবলম্বন মাতব্বরের শারীরিক অবস্থাও দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছে।মাতব্বরের বয়সও কেবল কম হয়নি।মাতব্বর জীবিত থাকাবস্থায় বদরের খোঁজপাতি করার দরকার মনে করে জুলেখা গ্রামের কাউকে সঙ্গে নিয়ে বদরের দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করে।অনেকের নিকট ধর্ণা দিয়ে তেমন কাউকে না পেয়ে হতাশা গ্রস্ত জুলেখা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে নিজকর্মে মনযোগী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।এমন সময়ে নতুন উপদ্রব মসজিদের নতুন নিয়োগ পাওয়া বুজর্গান হুজুরের দৃষ্টিপাত তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে।যদিও  এইরুপ ঘটনা কারো সঙ্গে আলোচনা করা আদৌ সমূচিন নয় বলেই মনে করে জুলেখা।তথাপি একটা সাধারন প্রস্তুতি মনে মনে ঠিক করে রাখা উচিৎ ভেবে প্রাথমিক অবস্থায় আপন কাউকে বিষয়টি জানিয়ে রাখলে কেমন হবে তাই নিয়ে ভাবছিল।

          হুজুর ইনিয়ে বিনিয়ে বহু চেষ্টা করার পরও যখন জুলেখার তেমন কোন সাড়া পায়না তখন বিকল্প চিন্তা নিয়ে ভাবতে লাগলো। হুজুর অনেক চিন্তা ভাবনা করে জুলেখাকে শাদী করার মনস্থীর করে। কাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠানো যায় মাতব্বরের নিকট,জুলেখা কি রাজী হবে? অনেক বার এদিক সেদিক চিন্তা করে হুজুর গ্রামের নজিরকে মনে মনে ঠিক করে,নজির মাঝে মাঝে মসজিদে মোয়াজ্বিনের দায়িত্ব পালন করে, তাঁকে দিয়েই প্রস্তাব পাঠানো যায় কিনা ভেবে নিলেন। চোরাপথে সম্পর্ক করতে ব্যার্থ হয়ে হুজুর এবার শা'দীর ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ গ্রহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।যেহেতু গত তিনমাসেরও অধিক আপ্রান চেষ্টার পরেও হুজুরের দৃষ্টিতে জুলেখা ধরা দেয়নি, এবার শাদীর প্রস্তাবে যেন কোন অবস্থায় ফেল না করে, সেই দিকেই হুজুরের খেয়াল বেশি রেখেছেন।কারন বিয়ের প্রাস্তাবের ব্যার্থতার অর্থই হবে, হুজুর এই মসজিদ  থেকে চাকুরি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে অন্যকোথাও চলে যাওয়া।

          গত ছয় সাত মাসে ঝাড় ফোঁক, তাবিজ তুরমার, নিয়ত বরকতে বেশ কিছুটাকা হুজুরের তহবিলে জমা পড়েছে। সেখান থেকে নজিরকে দশ হাজার টাকা হাতে দিয়ে হুজুর মনের বাসনা সবিস্তারে বর্ণনা করে তাকে মাধ্যম হিসেবে মাতব্বরের নিকট যাওয়ার অনুরুধ করেন।নজির অত্যান্ত গরীব, অনেকগুলী ছেলে সন্তান নিয়ে কোনমতে সংসার পরিচালনা করেন।দশ হাজার টাকা একত্রে পাওয়ার অর্থই হচ্ছে নজীরের হাতে স্বর্গ পাওয়া।এমনিতে বাচাল হলে কি হবে, ইনিয়ে বিনিয়ে, যুক্তি দিয়ে, যে কোন মানুষকে নজির নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা রাখেন।সৎ, নামাজি ব্যাক্তি হিসেবে গরীব হলেও নজীরকে সমাজের সবাই শ্রদ্ধার চোখেই দেখেন।মাতব্বরের অনুপস্থীতিতে নজীরই সমাজের ছোটখাট সমস্যা দেখা দিলে সমাধান করে দেন।হুজুরের অনুপস্থীতিতে বা অসুস্থ্যতায় নজীর ইমামতির দায়িত্বও অনেক সময় পালন করেন।মাতব্বরও নজীরের কথাবার্তার যথেষ্ট মুল্যায়ন করেন।হুজুর নজীরের হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দিয়ে সফল হলে আরো বিশ হাজার টাকা দিবেন মসজিদেই ওয়াদা দিয়েছেন।

    নজীর বাড়ীতে এসে রাতে চিন্তা ভাবনা করতে লাগলেন, কি ভাবে মাতব্বরকে হুজুরের শাদীর প্রস্তাবটা দেয়া যেতে পারে।মাতব্বরের একরোখা মনোভাব সম্পর্কে নজিরের আগেই ধারনা আছে, যাকে যা দিবেন বলেন তাক মাতব্বরের দুর্বল মহুর্তে ছাড়া এই প্রস্তাব উত্থাপন করা সমীচিন হবে না,বরং হীতে বিপরীত হতে পারে। নজীর সিদ্ধান্ত গ্রহন করে যে জুলেখা সম্মন্ধে বর্তমানে মাতব্বরের কি চিন্তাধারা আগে জেনে নেয়া উত্তম হবে, যদি ইতিবাচক হয় অর্থাৎ আবারো বিয়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা সামান্যতম করেন, তাহলে কেবল দুর্বলতম মহুর্তে প্রস্তাবটি উত্থাপন যুক্তিযুক্ত হবে। নজীর চিন্তা করে যে কোন ভাবেই তাঁকে সফল হতে হবে, সফলতার উপর বিশ হাজার টাকা পাওয়া না পাওয়া। মাতব্বরের অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে তাঁর নেয়া সিদ্ধান্ত ভাল হোক আর মন্দ হোক, কোন সিন্ধান্তই কেউ কোন দিনও পরিবর্তন করতে পারেনি। মাতব্বরের হাঁ--নাঁ দুটি শব্দের প্রথমটির উপরে নির্ভর করছে।বিশ হাজার টাকা পাওয়া, আর ঐ টাকার উপর নির্ভর করছে তাঁর বড় মেয়েটার বিয়ের ব্যাপারটি অন্তত নিশ্চিত হওয়া।সুতারাং এ কাজে বিফলতা অর্থ হবে বড় মেয়েটির বিয়ে দেয়ার ভবিষ্যত ইচ্ছা অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাওয়া।এই সব চিন্তায়  নজীরের রাতে আর ঘুম হয়নি। কাকডাকা ভোরে উঠে মসজিদের দিকে চলে যায় নজীর।তখনও হুজুর ঘুম থেকে উঠেননি।বদর ওজু করে আজান দেন এবং ফজরের নামাজ সমাজের সকলের সাথে আদায় করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে  মাতব্বরের পিছু পিছু  হাঁটতে থাকেন। পথিমধ্যে মাতব্বর পিছনে তাকিয়ে  নজীরকে দেখতে পান, সঙ্গতভাবে মাতব্বর নজিরকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করে কোথায় যায়। নজীর বলেন জিঁ মাতব্বর সাহেব, আপনার সাথে কিছু কথা বলব চিন্তা করে আপনার বাড়ীতেই যাচ্ছি। মাতব্বর খুশী হয়ে বলেন আস আস নজীর, তুমি তো আসনা, আজকে কি মনে করে--আমিতো বুঝতেছিনা।রাতের চিন্তা ধারা মোতাবেক নজীর মাতব্বরের বৈঠক খানায় সম্পূর্ণ বিষয়টিকে আবার মনে মনে সাজিয়ে নিলেন,বলতে গেলে যেন কোথাও কোন ভূল না হয়।

    মাতব্বর বৈঠক খানায় বসে জুলেখাকে নাস্তাপানি আনার জন্যে বলে। জুলেখা নাস্তা নিয়ে এলে নজীরের কথা বলার সুযোগ আরো প্রসস্ত হয়।নজীর জুলেখাকে ভালরকম লক্ষ করে আগে দেখে নিলেন, জুলেখা যাওয়ার পরে নজীর মাতব্বরের উদ্দেশ্যে আনমনে বলে উঠেন--"আহা মেয়েটার বুঝি কোন গতি হলনা,  মাতব্বর সাহেব। কপাল খারপ মেয়েটার, চাঁদের মত স্বামী পেয়েও বুঝি হারাল।"

    এই কথা বলে মাতব্বরের মুখায়বের দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রতিক্রিয়ার আশায়।মাতব্বর কিছুটা বিমর্ষ হয়ে একটা বড় নি:শ্বাস ছেড়ে বলেন-- হ নজীর, চেষ্টাতো আমি কম করি নাই, তোরা  তো জানিস, বিশ একর সম্পত্তি আমি জুলেখার নামে লিখে দিয়েছি। জামাইকেও দশএকর লিখে দিলাম এবং কি তাঁর আগের সংসারের বউকেও বাড়ীতে বিশ শতাংশ জায়গা সহ পুর্ব দিকের দালান ঘরটি লিখে দিয়েছি।এত কিছুর পরও বদরকে ধরে রাখতে পারিনি, তার মন পাইনি। ছেলেটা গেল ভালকথা, কিন্তু কোন খবরও দিলনা কেন?  আছে নাকি মরে গেছে তাও তো  বুঝতেছিনা। একবছর গত হয়ে গেছে ছেলেটা একবার এসেও খোঁজ খবর নিলনা। কেন আসে না, আসবে কি না আসবে,আমি তো কিছুই বুঝতে পারতেছিনা নজীর। এই মহুর্তে কি করা তাও আমার মাথায় আসছেনা। এদিকে আমার শরীরটাও বড্ড বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে দিন দিন। ছেলেরা বার বার চিঠি লিখতেছে ঢাকায় চলে যেতে, ডাক্তার দেখাবে।এই অবস্থায় মেয়েটিকে রেখে আমি কি ভাবে ঢাকায় যাই বলতো নজীর? মেয়েটাকে যদি ঢাকায় নিয়ে যাই--বাড়ীটা দেখবে কে? বড্ড পেরেশানীতে আছি-রে 'নজীর---'।

    নজির কিছুক্ষন নিছের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন ভাব দেখিয়ে বলে--হুম মাতব্বর সাহেব, চিন্তারই কথা। বদর মনে হয় আসবেনা মাতব্বর সাহেব- শুনেছি বদরের শুশুর ঐ এলাকার বিশাল জমিদার ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর গ্রামের আসেপাশের জোতদার মহাজনেরা জোর করে সব সম্পত্তি নিয়ে গেছে।এই ব্যাপারে আদালতে নাকি মামলা মোকদ্দমাও হয়েছিল।মামলায় জিতে গেলে বদর ছাড়াতো বিশাল সম্পত্তি দেখার আর কেউ নেই।তাই হয়ত এদিকের অল্প স্বল্প সম্পত্তির দিকে নজর না দিয়ে শুশুরের সম্পত্তি উদ্ধার করার চেষ্টা করছে, বা উদ্ধার করেছে। আমার যতটুকু ধারনা--বদর বাবাজি আর আসবেনা মাতব্বর সাহেব।আপনি বেঁচে থাকতে  জুলেখাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিন মাতব্বর সাহেব।

    নজীরের কথা শুনে মাতব্বর বেশ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছেন, মনে মনে ভাবছেন, নজীর আসলে মন্দ বলেনি।আমিও শুনেছি--তাঁর আগের সংসারের শুশুর তিন, চার হাজার একর জমি রেখে মৃত্যু বরন করেছেন।তিনভাগের একভাগ সম্পত্তি উদ্ধার হলেও বদরের এদিকে আসার দরকার পড়েনা। আবার মনে মনে চিন্তা করে-- এখানে তো বদরের সন্তান আছে, জমির লালসা না থাকতে পারে কিন্তু তাঁর সন্তানের লালসা না থেকে পারেনা। স্ত্রী সন্তান রেখে পালিয়ে যাওয়ার মত ছেলে নয় বদর, নিশ্চয়ই তাঁর কোন বড় অসুবিধা হয়েছে। সাত পাঁছ ভাবতে ভাবতে অনেক সময় কেটে যায়।নজীর অনেকক্ষন অপেক্ষা করে বলে উঠে মাতব্বর সাহেব আমি তা হলে এখন উঠি।মাতব্বর বলে ও হ্যা তুমি না কি বলতে এসেছ? নজীর বলে না থাক আজকে আর বলবনা, আর একদিন এসে বলা যাবে।আজকে আপনার মনটা বড্ড বেশি খারাপ  হয়ে গেছে, কথাটা আজকে মনে হয় না বললেই ভাল হবে। মাতব্বর বলেন--নজীর, আমি বৃদ্ধ মানুষ, স্মরণ শক্তিও কমে গেছে,মেয়েটার চিন্তায় এমনিতে আমি বড় ফেরেশানীতে আছি। তুমিও একটু চিন্তা করে দেখ ভাই---কোন পথে গেলে ভাল হবে, আমিতো আজ আছি কাল নেই, তোমরাই তো তাঁর দায়িত্ব নিতে হবে, একুল ওকুল যাই বল, এই গ্রামবাসি ছাড়া তো আর তাঁর কেউ নেই।

    মাতব্বর সাহেবের শেষের কথাটি নজীরের বুকে শেলের মত বিঁধেছে। একটা রায়তের মেয়ের জন্যে মাতব্বরের মানবিকতায় নজীর বিমুগ্ধ হয়ে গেছে।নজীর আজকেই মাতব্বরের মূখে প্রথমবারের মতই শুনেছে-জুলেখার নামে বিশ একর সম্পত্তি মাতব্বর দান করেছেন।এতবড় দানের কথা শুনে নজীর স্তম্ভিত, আশ্চায্য, যারপরনাই বিস্মিত হয়ে যান।নজীর শুধুমাত্র প্রথম শুনেছে তাই নয়, গ্রামের একটি পিঁপড়াও জানেনা জুলেখার নামে মাতব্বর বিশ একর সম্পত্তি দান করেছেন। নজীর মনে মনে হিসেব করে দেখেছে, জুলেখা গ্রামের মধ্যে  জমির দিক থেকে মাতব্বরের পরের স্থানেই তার অবস্থান।গ্রামের মধ্যে কারো নিকট এত সম্পত্তি নেই। অধিকাংশ মানুষ মাতব্বরের জমি বর্গাচাষ করে কোন রকমে জীবন নির্বাহ করে। শুধুমাত্র নজীরের গ্রামে নয়, আশপাশের তিন চার গ্রামের কোন সচ্ছল গৃহস্তের কাছেও  ৫/৭ একরের বেশি জমি নেই। সেখানে জুলেখার নিকট একাই বিশ একর সম্পত্তি,  এটা কি চারটি খানি কথা!!

    বিষয়টি নজীর শুনতে সময় লেগেছে বটে, ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। আশপাসের সাতগ্রামে বিদ্যুৎ বেগে কথাটি ছড়িয়ে পড়েছে নিমিষেই। কথাটি ছড়িয়ে পড়ার পর গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেদের মাঝেও ব্যাপক সাড়া জাগে। আগে যে সমস্ত ছেলেরা বাড়ীর আশপাসে ঘুরে ঘুরে জুলেখার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাইতো, তাঁদের মধ্যেও পরিবর্তন এসে গেছে। তাঁরাও সমীহের চোখে দেখতে লাগলো জুলেখাকে।পাড়ার মধ্য বয়সী সোলেমান, আকবর, আলম যাঁরা লোভাতুর দৃষ্টিতে জুলেখার প্রতি নজর দিতেন, তাঁদের নজরও নিছের দিকে নেমে গেছে।জুলেখা এখন পাঁড়ার সবার নিকট শ্রদ্ধার জুলেখা আপু হিসেবে অধিষ্টিত হয়ে গেছে।সবার চোখের কু-স্বপ্ন দুরীভূত হয়ে  সু-স্বপ্ন জম্ম নিতে লাগলো। জুলেখা গ্রামবাসির মধ্যমণি,তাঁকে নিয়ে এখন গ্রামবাসি নতুন করে আগামীদিনের স্বপ্ন বুনা শুরু করেছে।

     গ্রামবাসির হঠাৎ এই পরিবর্তন জুলেখাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।গ্রামবাসির হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারন জুলেখা চিন্তা করে কোন কুল পায়না। কেন তাঁকে সবাই হঠাৎ করে সমীহ করে কথা বলা শুরু করেছে! জুলেখা নিজেও জানেনা--মাতব্বর তাঁর নামে এত  সম্পত্তি দান করে রেখেছে।এ ও জানেনা তাঁর স্বামী বদরকেও দশ একর এবং  তাঁর সতীন হিরামণিকেও দশ শতাংশ সহ পুর্বের দালান ঘরটি দান করে দিয়েছেন।জুলেখার পানিপ্রার্থী মসজিদের বুজর্গান হুজুরও জানেনা--জুলেখা এত সম্পত্তির মালিক। জুলেখার সম্পত্তির কথা মাতব্বর সাহেবের নিজমূখে শুনে নজীরের মনে ব্যাপক  পরিবর্তন এসে গেছে।

    পরের দিন ফজরের নামাযে আসার সময় নজীর হুজুরের দেয়া দশ হাজার টাকা কোমরের প্যাচে করে নিয়ে আসেন। নামাজ শেষে সবাই যার যেমন বাড়ীতে চলে গেলে, নজীর টাকাটা বের করে হুজুরকে দিয়ে দেন। হুজুর তাঁর দিকে তাঁকিয়ে বলেন--'নজীর আমি তোমাকে টাকা দিয়েছি, ফেরৎ নেয়ার জন্যে নয়।' টাকাটা তুমি রেখে দাও, আমার টাকার কোন প্রয়োজন নেই। তোমাকে যে বিশ হাজার টাকা দেব বলেছিলাম সেটিও এখন আমি তোমাকে দিতে চাই।এই নাও, তোমাকে আমি আরো বিশ হাজার টাকা দিলাম। এই টাকা দিয়ে তুমি তোমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও।আমার অনেক আছে,আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন।তুমি টাকাটা কেন ফেরৎ দিতে এসেছ আমি তা বুঝেছি।সত্যিকার অর্থেই তুমি সৎ এবং বুদ্ধিমান। আমি যে প্রস্তাবটি তোমাকে দিয়েছিলাম তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি, যদি তোমাদের সমাজবাসি ভাল মনে করে, আমার শাদী তোমরা করিয়ে দিও। আমি তোমার নিকট আল্লাহর মসজিদে বসে ওয়াদা দিচ্ছি---"আমার হবু বিবিকে একশত একর জমি পণ দিয়ে, শা'দী করে ঘরে তুলে নেব"।জুলেখা ধনাঢ্য মহিলা, বর্তমান স্বামী যদিও তাঁকে ত্যাগ করে, বহু  শিক্ষিত যুবক তাঁকে বিয়ে করার জন্যে এগিয়ে আসবে। আমার মত বৃদ্ধকে শা'দী করার তাঁর কোন প্রয়োজন নেই।

         ইতিমধ্যে জুলেখা হঠাৎ করে তাঁকে সবাই সমীহ করে কথা বলার কারন উৎঘাটনে নেমে পড়েছে। গ্রামের যে সোলায়মান, আলম লোভাতুর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতো সেই সোলায়মান, আলমেরা যেহেতু শ্রদ্ধা সম্মান, সমীহ সহ মাথা নিছু করে কথা বলতে শুরু করেছে নিশ্চয়ই এর পিছনে কোন বড় তাৎপয্য নিহিত আছে।অনেক চেষ্টা করেও জুলেখা এর হেতু বের করতে পারেনা, কাউকে সরাসরি জিজ্ঞাসাও করতে পারেনা। এদিকে শিক্ষিত ধনাঢ্য পরিবারের অবিবাহীত যুবকদের পিতারা তাঁদের ছেলেদেরকে বিয়ে করানোর প্রস্তাব নিয়ে মাতব্বরের বাড়ীতে লাইন ধরেছে। জুলেখা একা একা প্রত্যহ নাস্তা তৈরি করতে করতে একরকম হাঁপিয়ে উঠেছে।জুলেখা বুঝতে পারছেনা হঠাৎ করে বাড়ীতে এত নতুন নতুন মেহমানের আগমন কেন, কোত্থেকে ঘটছে। কম করে হলেও বিশ বাইশটি বছর তো এই বাড়ীতেই কাটিয়ে দিয়েছে জুলেখা, কখনই দেখেনি এত মানুষের সমাগম হতে দিনে রাতে।

    মসজিদের বুজর্গান হুজুরের কথাটি শুক্রুবার জুম্মা মসজিদে আলোচনার পর থেকে এলাকাময় ছড়িয়ে পড়েছে।নজীর শুক্রুবার জুম্মার নামাজ শেষে দাঁড়িয়ে হুজুরের ইচ্ছার কথাটি সমাজবাসির নিকট তুলে ধরেন। সমাজবাসি হুজুরের ইচ্ছাকে ইতিবাচক হিসেবেই গন্য করেছেন।মনে মনে অবিবাহিত,স্বামী পরিত্যাক্তা, তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের পিতারা হুজুরের নিকট তাঁদের মেয়েদের বিবাহ দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। হুজুরের আদর আপ্যায়ন তুলনামূলক হঠাৎ করে সমাজ বাসি অনেকের নিকট বেড়ে গেছে। নজীরও মনে মনে স্বপ্নে দেখা শুরু করেছে তাঁর বড় মেয়েকে হুজুরের নিকট শা'দী দেয়ার মতলবে। গোপনে গোপনে তাঁদের মেয়েকে মসজিদের সামনে বিভিন্ন উছিলায় হুজুরের নিকটে নিয়ে দেখিয়ে নিয়েছে। হুজুর অবশ্য বুঝেও না বুঝার ভান করে কাউকে তেমন ভাবে পাত্তা দিচ্ছেনা।জুলেখাকে কামনা করে যেহেতু পায়নি সেহেতু জুলেখার মতই সুন্দরী নজীরের বড়মেয়ের প্রতি হুজুরের দৃষ্টি আগে থেকেই ছিল। জুলেখার মন গলাতে ব্যার্থ্ হলে নজীরের মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছেন।  অবস্থায় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হুজুরের  প্রস্তাব নিয়ে নজিরের নিকট যাওয়ার কোন লোক  খুঁজে পাচ্ছেনা, সবাই তাঁদের মেয়েকে বিয়ে দিতে প্রস্তুত, হুজুর বলবে কাকে?

    ইতিমধ্যে এলাকাবাসির কেউ কেউ হুজুরের দেশের বাড়ীর খবরাখবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন, হুজুর মূলত: জমিদার।পারিবারিক যেকোন ঝামেলার কারনে বাড়ী ছেড়ে এসে এখানে ইমামতির দায়িত্ব নিয়েছেন।নজির এবং নজিরের বড় মেয়ের কানেও কথাটি চলে গেছে। হুজুর ১০০ একর নয়, ইচ্ছা করলে আরও বেশি পণ দিয়েই বিয়ে করতে পারবে।তবে সকলেই সন্দিহান ছিলেন যে জমি ঠিকই দিতে পারবেন, কিন্তু বিবিকে তিনি বাড়ীতে নিতে পারবেন? গ্রামের অভিজ্ঞ কিছু কিছু লোকের ধারনা--এখন যদিও তাঁর বিবিকে নিয়ে নিজগৃহে যেতে না পারে, সময়ে কেউ আটকিয়েও রাখতে পারবেনা।কারন জমি এবং বাড়ীর মালিক আইনত: হুজুরই বটে।আগের সংসার যতই গন্ডগোল করতে থাকবে ততই তাঁদের কপালই ভাঙ্গতে থাকবে, মাঝখানে পরের সংসারই লাভবান হবে।

     গ্রামবাসি এই কয়দিন মসজিদের ইমাম সাহেবের বিয়ে নিয়ে মাতামাতিতে ব্যাস্ত। চর এলাকার ভূমিহীন পরিবারের যুবতি মেয়েদের বিয়েশা'দী সময়মত দেয়া একপ্রকার বড়ই ভাগ্যের ব্যাপার। প্রত্যেক মা বাবার কামনা থাকে তাঁর মেয়েকে অন্তত: একটা কর্মঠ ছেলের হাতে তুলে দিতে। তদ্রুপ কর্মঠ ছেলে পেতে হলে ছেলের বাবার নগদ দাবী পূরণ অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।  বিয়ের টাকা জমানো কোনমতে সম্ভব হয়ে উঠেনা, ছেলের বাবার আবদার কিভাবে পূরণ করবে? আর্থিক দুরাবস্থার কারনে অনেক মেয়েই আটপৌড় হয়ে মা বাবার বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।যেনতেন ভাবে বিয়ে দিলেও মেয়ে ঘরে চলে আসার সম্ভাবনা থাকে। মসজিদের ইমাম জমিদার, যদি কোন রকমে মেয়েকে গছিয়ে দেয়া যায়, অন্তত: চারটা ভাত তো খেতে পারবে। গ্রামের প্রায় আটপৌড় মেয়ের বাবার কামনার বিষয়ে পরিণত হয় ইমাম।    
   
       অবশেষে মসজিদের ইমাম সাহেবের প্রতি আল্লাহ চোখ তুলে তাকিয়েছেন। নজিরের নিকট কেউ আর, তাঁর মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।নজির নিজেই তাঁর মেয়ের গুনগান হুজুরের নিকট বয়ান সাপেক্ষে তাঁর মতামত চাইলেন।হুজুর আলহামদুলিল্লাহ বলে সম্মতি দেয়ায় নজির খুশীমনে বাড়ীতে এসে তাঁর সহধর্মীনিকে প্রথমে  সুখবরটি জানালেন এবং মেয়ের মতামত কি জানার জন্যে বললেন।এমনিতে নজির গরীব, গরীব হলেও মেয়ের মতামত নেয়ার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব কি, এই সাধারন জ্ঞান তাঁর ভিতরে যথেষ্ট আছে।

     আছিয়া এবং নজিরের মেয়ে হালেমা দুইজনই সমবয়সি। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে দুইজন একই ক্লাসে পড়ার কারনে, বাল্যকালে তাঁদের দুই জনের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই সম্পর্কের মধ্যে কখনও চিড় ধরেনি। প্রায়শ: ছোটবেলা থেকে বিকেল বেলায় দুই বান্ধবী গ্রামের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে একে অপরের সঙ্গে মনের ভাব বিনিময় করার অভ্যেস অষ্টাদর্শী যুবতী হওয়ার পরেও অটুট রয়ে গেছে। আছিয়ার প্রতি হুজুরের বিশেষ নজরের ব্যাপারটি অন্তদৃষ্টিতে আছিয়া বুঝতে পেরেছিল।  ব্যাপারটি নিয়ে তাঁরা দুই বান্ধবী অনেক সময়ে হাঁসি ঠাঠ্রা করে সময় কাটিয়ে দিয়েছে। ভাব বিনিময়ের একপয্যায় হালিমা তাঁর ছোট বেলার সহপাঠিনীর আছিয়ার মনেরভাব বুঝতে অসুবিধা হয়নি।হুজুরের প্রতি তাঁর বান্ধবীর মনের মণিকোঠায় একচিলতে জায়গা মনের অজান্তে তাঁর বান্ধবীর মনে মণিকোঠায়ও যে ইতিমধ্যে হুজুর বাসা বেঁধেছে, বান্ধবী হয়তো বা  টের করতে পারেনি। হালেমাকে শুধু হুজুরের কায়দাপূর্ণ প্রেমের দুর্বলতা প্রকাশ  সম্পর্কে বললে কি হবে? আছিয়াও যে হুজুরের নিবেদনে সাড়া দিতে একপায়ে খাড়া ছিল---'সেই কথাটি ঘুনাক্ষরে না বললেও হালেমা ঠিকই বুঝতে পেরেছে'। আছিয়া সরাসরি সাড়া না দেয়ার সবচেয়ে বড় বাধা কোথায় হালেমা তাও মনে মনে আঁচ করে নিয়েছে। মাতব্বরের সম্মানহানীর ভয়ে আছিয়া, প্রকাশ্য হুজুরের প্রতি কোনরুপ তাঁর মনের দুর্বলতা, তৎক্ষনাৎ প্রকাশ করার সাহষ করেনি। বিচক্ষন হালেমা বান্ধবীর মনের উত্থাল পাতাল সম্পর্কে মুখ ভেঙ্গে আছিয়াকে কিছুই বলেনি, শুধু অনূভব করেছে।অনূভব করার কারন আছিয়া বিবাহীতা এবং এক কন্যা সন্তানের জননী। হালেমার কোন প্রকার ইঙ্গিতপূর্ণ সাহষ পেলে, তাঁর প্রিয় বান্ধবী আছিয়ার সুখের সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাবে। হালেমা জানে আছিয়া তাঁকে জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসে--তাঁর সামান্য মৌন সমর্থন আছিয়ার মনের গতি বাঘিনীর চেয়েও ক্ষিপ্রতায় শক্তি সঞ্চয় করে বড় রকমের অঘটন ঘটিয়ে পেলবে।

    হালেমা আগে আগে বদর সম্পর্কে আছিয়ার বিভিন্ন সময়ে করা উক্তি সমূহ মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিল। বদর সম্পর্কে উক্ত বিভিন্ন উক্তি সমূহ হালেমা হৃদয় দিয়ে অনূভব করেছিল।  হালেমা স্থীর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, তাঁর বান্ধবীর সংসার অত্যান্ত সুখের সংসার এবং তাঁরা আদর্শ স্বামী স্ত্রী। তাঁদের দুই জনের মধ্যে  দাম্পত্য জীবনের সকল গুনাবলী বহাল ছিল এবং উভয়ের ভালবাসার মধ্যে কোন প্রকার কৃত্তিমতা ছিলনা। তাঁর বান্ধবীর স্বামী বদর অবশ্যই ফিরে আসবে, অন্য সকলের তুলনায় হালেমা আরো বেশি দৃডভাবে বিশ্বাস করে। গ্রামের অন্যসকলের বিশ্বাস ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়লেও হালেমার বিশ্বাস তখনও অটুট ছিল। মাস শেষে বছর গড়ানোর সাথে পাল্লা দিয়ে হালেমার বিশ্বাসেও ক্রমান্বয়ে কিছুটা চিড় ধরা শুরু করে।হালেমা দ্বিধায় ভুগতে থাকে এই ভেবে---'একটা শক্ত সামথ্য পুরুষ দীর্ঘদিন একেবারে নিরুদ্দেশ কিভাবে সম্ভব হয়' ! নিশ্চয়ই তাঁর বড় কোন বিপদ হয়েছে, হয়তো বা তাঁর মৃত্যুও হতে পারে! আছিয়ার  স্বামী জীবিতবস্থায়  নিরুদ্দেশ থাকতে পারেনা। এমনিতে আছিয়ার কচি বয়স, সুঠাম স্বাস্থ্য, অতুলনীয় সুন্দরী বান্ধবী স্বামীহীন  কোন অবস্থায় হালেমা মেনে নিতে পারেনা।

      হালেমার মা, ইনিয়ে বিনিয়ে হুজুরের বিয়ের প্রস্তাব সম্পর্কে মেয়েকে অবশ্য কয়েকবার বলেছে।হালেমা প্রথম প্রথম মায়ের কথায় রা করেনি। শেষাবদী যখন হালেমা বুঝতে পেরেছে, তাঁর মৌনতা বিয়ের পরিণতিতে রুপ লাভ করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।তখন চুপ থাকাটা বান্ধবীর প্রতি চরম অন্যায় এবং বেঈমানী হবে চিন্তা করে হালেমা তাঁর মাকে সম্পূর্ণ ঘটনা বলার প্রস্তুতি গ্রহন করে। এমনিতে গ্রামের মেয়েদের বিয়ে সম্পর্কে মন্তব্য করার তেমন রেওয়াজ নেই,এক্ষেত্রে চুপ থাকাটা তাঁর প্রিয় বান্ধবীর জীবনে চরম ক্ষতির লক্ষন অনূভবে কথা না  বলেও পারছেনা। হালেমা তাঁর মা'কে সাহষ করে বলেই পেলে যে---'সে বৃদ্ধ হুজুরকে বিয়ে করবেনা।' মেয়ের মূখে এই কথা শুনে হালেমার মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। এই টুকু মেয়ে বলে কি ! তোর বাপজান শুনলে আস্ত কবর দিয়ে দিবে, তোর জীবনে আর কোন সম্মন্ধ আসবে না-- ইত্যাদি বলে মেয়েকে কব্জায় নিয়ে আসার প্রানান্তকর চেষ্টা চালাতে থাকে। মায়ের একতরফা বকায় অতিষ্ট হয়ে শেষ পয্যন্ত বলেই পেলে যে, হুজুর আছিয়াকে ভালবাসে। তোমরা আছিয়ার কথা না বলে আমার কথা কেন বলছ? বাপজান হুজুরের নিকট থেকে টাকা নিয়ে এসেছে আছিয়ার বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্যে।
    মা' মেয়ের একান্ত ঘরের ভিতরের আলোচনা বাহিরে প্রকাশ পেতে দেরী হয়নি। গ্রামময় হুজুরের এমন মনোভাব প্রকাশ হওয়ার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সত্যাসত্য জানার জন্যে সবাই নজীরকে প্রশ্ন করতে থাকে, নজীর মিথ্যে বলার লোক নয়।প্রথম প্রথম চুপ থাকলেও শুক্রবারের জু'মা নামাজের মসজিদে নামাজ শেষে যখন কথাটি মনির উত্থাপন করে নজীরের প্রতি ইঙ্গিত করে, সত্যতা যাছাই করার নিমিত্তে প্রস্তাব উত্থাপন করে, উৎসুক গ্রামবাসি কেউ আর মনিরের কথায় দ্বিমত করেনি। নজির এমনিতেই সত্যবাদি হিসেবে গ্রামে পরিচিত, গ্রামের সবাই গরীব হলেও নজীরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাছাড়া মসজিদে উত্থাপিত ঘটনা এড়িয়ে যাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এই মহুর্তে মহাবিপদে পড়েছে নজির--একদিকে বজুর্গান হুজুরের মানইজ্জত নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে তাঁকে হুজুরের কথিত মনোবাসনাকে অস্বীকার করা একান্ত বাঞ্চনীয়। অপরদিকে হুজুরের ইজ্জত বাঁচাতে হলে তাঁকে মসজিদে বসে  মিথ্যা বলতে হবে। এমন কঠিন বিপদে নজীর, এর আগে তাঁর জীবনে আর কখনও পড়েনি।

                               পর্ব---(সাত)

     এদিকে মৌলভী ইশারত উল্যা সাহেবের হঠাৎ অন্তধানে গোটা  সিলেট জেলা জুড়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তাঁর বাংলায় উচ্চ শিক্ষিত স্ত্রী, ছেলে মেয়েরা তন্ন তন্ন করে কোন খোঁজ করতে না পেরে, অবশেষে থানার আশ্রয় গ্রহন করে। জমিদার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারীর এইভাবে অন্তধান এলাকাব্যাপি শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্ত্রী, পুত্র কন্যা,আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কান্নার রোল পড়েছে।দিন যায় মাস যায় কেউ কোথাও তাঁর ছায়া পয্যন্ত দেখেছে, এমন কোন খবর মেলাতে না পেরে, অবশেষে সবাই ধরেই নিয়েছেন তিনি গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। হুজুরের পুত্রকন্যারা পারিবারিক আঙ্গিনায় যৎসামান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শোক ভূলার চেষ্টায় ব্রতি হয়ে পড়েন।অসময়ে মুরুব্বিহারা হয়ে বাড়ীর সকলেই কঠিন ব্যাথা বুকে নিয়ে--যার যার কাজে  মনযোগ দিয়েছেন। হুজুরের স্ত্রী ইতিমধ্যে ইসলাম ধর্মের নির্দেশীত পথে আচার অনুষ্ঠান সেরে সাদা কাপড়ে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছেন।

   এমন সময় জমিদার বাড়ীর প্রধান ফটকে এক মূসাফির বাড়ীর তত্বাবধায়কের হাতে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।বাড়ীর তত্বাবধায়ক কাগজটির তেমন মূল্য না দিয়ে, তাঁর শোবার ঘরের বিছানার নীছে রেখে দিয়েছেন। কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন তাঁর মনে হয়, মূসাফির ঐদিন তাঁকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়েছিলেন,কাগজটিতো কারো কাছে পড়তে দেননি। আচ্ছা ঠিক আছে, কেউ যদি  আজ লেখা পড়া জানা লোক এদিকে আসে,তাঁকে দিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। তত্ববধায়কের চিন্তায় মগ্ন থাকাবস্থায় হুজুরের বিবি বাড়ীর ফটকে এসেছেন দেখার জন্যে সবাই কাজে যোগ দিয়েছেন কিনা। বাড়ীর তত্বাবধায়ক বাহিরে বসে তখনও চিন্তায় মগ্ন। বিবিজানকে বাড়ীর ফটকে দাঁড়ানো দেখে তত্বাবধায়ক তড়িগড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বেগমক সাহেবাকে সালান্তে তাঁর থাকার ঘরে ছুটে গেলেন। তিনি মুসাফিরের কাগজের টুকরাটি হাতে করে এনে বেগম সাহেবার হাতে দিলেন।

     কাগজের টুকরাটি খুলে চোখ বুলাতেই হুজুরের বিবি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। চোখ ধীরে ধীরে বড় হয়ে দুলতে থাকে। বাড়ীর তত্ববধায়ক  বেগমকে ধরার ইচ্ছা থাকলেও ভয়ে না ধরে চিৎকার করতে থাকে।বাড়ীর সকলেই দৌঁড়ে এসে বেগমকে ধরে কোলে তোলে অন্দর মহলে নিয়ে যায়।কাগজের টুকরাটি যেখানে বেগম সাহেবা মূর্চ্ছা হয়ে পড়েছিল; সেখানেই রয়ে যায়।ছোট কাগজের টুকরার উপর তেমন ভাবে কারো চোখ পড়েনি। হুজুরের বিবির কেন এমন হল! পাড়া শুদ্ধ সবাই যার যার মত করে কারন নির্ণয়ের চেষ্টা করছে। বাড়ীর তত্বাহধায়ক ঐ মূহুর্তে কাউকে কাগজের টুকরা দেখে মুর্ছা যাওয়ার কথা ঘুনাক্ষরেও প্রকাশ করছিল না। পাছে যদি কিছু হয়ে যায়, তাঁর উপর বিপদ আসার ভয়ে। এমনিতে সবাই কম বেশী তাঁকেই সন্দেহের তালিকায় এক নম্ভরে রেখেছে। কারন তাঁর সামনেই বেগম সাহেবা বেঁহুশ হয়ে পড়ে গেছে। নিশ্চয়ই তাঁর কোন আচরনের কারনে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
 
 শেষাবদি নজির সিদ্ধান্ত নেয়, সব কিছু সমাজকে সে খুলে বলবে। সমাজ যেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করে, সেই সিদ্ধান্তই মেনে নিবে। সেদিন মসজিদে মাতব্বর সাহেব কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কারনে মসজিদে উপস্থীত ছিলেন না।এই সুযোগটি সবার সামনে নজিরকে সত্য বলতে অনেকাংশে সাহায্য করেছে। সবার কথা বলা শেষ হলে নজির অত্যান্ত ধীর ভাবে আসামীর জবানবন্দি দেয়ার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে আদোপান্ত সব ঘটনা মসজিদের ভিতরে  খুলে বলেন। নজিরের বয়ান শুনে উপস্থীত মুসল্লিয়ান যারপরনাই হতভম্ব, ক্ষুব্দ, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। উপস্থীত যুবক মুসল্লিদের মধ্যে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাঁরা মসজিদের ভিতরেই ইমাম সাহেবকে বিভিন্ন কটুক্তি, তিরস্কার চেঁচামেছি  শুরু করে। সমাজের মুরুব্বিগন পরিস্থীতি শান্ত রাখার উদ্দেশ্যে সবাইকে মসজিদের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলে-আপনারা মসজিদের বাহিরে সবাই শান্ত হয়ে বসেন। মুরুব্বিদের কথানুযায়ী সবাই বাহিরে এসে বিচারের অপক্ষায় বসে পড়ে। মুরুব্বিগন কিছুক্ষন মসজিদে হুজুরের সাথে উদ্ভোত পরিস্থীতি ও করনীয় সম্পর্কে পরামর্শ করতে বসেন। হুজুর অত্যান্ত ঠান্ডা মেজাজে মুরুব্বিদের আশ্বস্থ করে বলেন-- তিনি  সমাজ বাসির যে কোন সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিবেন।হুজুরের প্রতিশ্রুতি নিয়ে মুরুব্বিগন বাহিরে এসে সবার নিকট তা ব্যাক্ত করেন এবং  মাতব্বর সাহেব আসাব্দি ধৈয্য ধারন করার জন্য সবার নিকট অনূরুধ জানান। সবাই মুরুব্বিদেরকে সম্মান প্রদর্শন করে সভা ত্যাগ করেন।

        ঐদিন বিকেলেই মাতব্বর বাড়ীতে এসে পৌঁছেন। মাগরীবের নামাজের পর মুরুব্বিগন মাতব্বর সাহেবকে অদ্য দুপুরে জুম্মা নামাজের সময় মসজিদে ঘটিত ঘটনার বিবরন তুলে ধরেন। মাতব্বর ঘটনার আদোপান্ত শুনে হতবাক হয়ে পড়েন। এর আগে জুলেখার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা বেশ কয়েকটি পরিবারের খোঁজ খবর নেয়ার জন্যে মাতব্বর বাড়ী থেকে বের হয়ে পাশ্ববর্তী উপজেলার  আঁধার মানিক গ্রামের এক দুরসম্পর্কীয় আত্মীয় বাড়ীতে গিয়েছিলেন।উচ্চশিক্ষিত এক ছেলের সঙ্গে জুলেখার বিয়ের ব্যাপারে সেখানে আংশিক কথাবার্তাও বলে এসেছেন। মাতব্বর নিজ থেকে জুলেখাকে স্বচক্ষে দেখার জন্যে তাঁদেরকে আসার আমন্ত্রনও জানিয়ে এসেছেন।আগামী শুক্রুবার তাঁরা আসবেন এবং জুলেখাকে পছন্দ হলে পাকাপাকি কথও হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

     এমন সময়ে মসজিদে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে মাতব্বর কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন।তিনি এশার নামাজের পর সমাজবাসীকে নিয়ে তাঁর বৈঠক খানায় বসার কথা বলে সেখান থেকে স্থান ত্যাগ করেন। এশার নামাজের পর মাতব্বরের বৈঠক খানা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। মাতব্বর গ্রামের মুরুব্বিদের নিয়ে বৈঠক খানায় আসেন। অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুর্বাপর ঘটনার বিবরন জানার জন্যে আবারও ইমাম সাহেব ও নজিরকে জমিদার মাতব্বর সাহেব গ্রামবাসীর অনুরুধে বৈঠকে উপস্থীত হওয়ার জন্যে  খবর পাঠান। মাতব্বরের ডাক শুনে উভয়েই বৈঠকে উপস্থীত হলে প্রথমে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।মাতব্বর সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলেন- ইমাম সাহেবের এই বৃদ্ধ বয়সে আবারও শা'দী করার এহেন ন্যাক্কারজনক তৎপরতায় ঘৃনা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। নজির গ্রামের বয়োজৈষ্ঠ এবং বিচক্ষন ব্যাক্তি।তাঁর বিচক্ষনতায় গ্রামবাসি আমরা সকলেই আজকের এই দিনে-- গ্রামের মধ্যে  বড় একটি অঘটন ঘটার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পেয়েছি।

     আমরা সকলেই জানি--ইসলামে একাধিক বিবাহের অনুমতি রয়েছে সত্য তবে একত্রে চার বিবির উপরে রাখার বিধান নেই। তবে উল্লেখিত সুবিধা সমূহ কেবলমাত্র সচ্ছল ব্যাক্তিদের ক্ষেত্রে প্রজোজ্য। ইসলামী আইনের সাথে রাষ্ট্রীয় আইনকেও আমাদের মেনে চলতে হবে।রাষ্ট্রীয় আইনে বলা আছে--প্রথম স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করা যাবে। এক্ষেত্রে ইমাম সাহেব তাঁর প্রথম বিবির অনুমতি এনেছেন বা আনতে পারবেন কিনা; আমাদের আগে জানার প্রয়োজন আছে--কি বলেন আপনারা সবাই? সকলেই জমিদারের উল্লেখিত কথায় সায় দেয়। জমিদার ইমাম সাহেবকে উদ্দেশ্য করে কথাটি দ্বিতীয়বার উল্লেখ করেন। ইমাম সাহেব না সূচক জবাব দিলে মাতব্বর কিছুটা রাগাম্বিত স্বরে বলেন--তাহলে আপনি কেন শা"দীর প্রস্তাব দিলেন?  ইমাম সাহেব মাতব্বরের কথার উত্তরে বলেন--"বিষয়টি আমার জানা ছিলনা।" মাতব্বর সাহেব বিষয়টি সম্মন্ধে করণীয় নির্ধারনে গ্রামের মূরুব্বিদের কয়েকজনকে দায়িত্ব প্রদান পূর্বক, আগামী শুক্রবার জুমা নামাজের পর আবারো বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত ঘোষনা করে আজকের সভার সমাপ্তি ঘোষনা করেন।

      এদিকে বুজর্গান হুজুরের বিবি, ছেলে মেয়েরা কাগজের টুকরায় হুজুরের বর্তমান ঠিকানা পেয়ে যারপরনাই সবাই মানষিকভাবে চঞ্চলতায় ভুগছিল। তাঁরা কখন, কত তাড়াতাড়ি হুজুর বাবা,এ স্বামীকে পাকড়াও করতে পারবে, চিন্তায় বিভোর। পরিবারের সকলেই তাঁদের প্রীয় জনকে কাছে পাওয়ার আকুলতায় নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাঁরা সবাই সিদ্ধান্ত গ্রহন করে আগামী বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পর নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে তাঁরা স্ব-পরিবার সিলেট ত্যাগ করবে। সময়মত সেই দিনই যদি  ফেরৎ আসা যায় চলে আসবে, না আসতে পারলে কোথাও রাত্রী যাপন করে পরদিন তাঁদের বাবাকে নিয়ে চলে আসবে।সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় খাবার, পানি, কাপড় চোপড় নিয়ে তাঁরা  নিজেদের সদ্যকেনা নতুন মার্সিডিজ গাড়ীতে উঠে বসে।

       সন্ধা নামার কিছু আগে ঠিকানানুযায়ী পৌঁছে দেখে--তাঁদের বাবা মসজিদে বসে কোরানপাক তেলোয়াতে ব্যাস্ত রয়েছে। হুজুরের বিবি--ছেলে মেয়ের সামনে কোনরকমে আবেগ সংবরন করতে পারলেও মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদাকাটি শুরু করে। বাহিরে হৈচৈ কাঁদাকাটির আওয়াজ শুনেও হুজুর মসজিদের ভেতর থেকে বাহিরে আসেননি, কোনপ্রকার ভ্রুক্ষেপও করেননি। গ্রামের মসজিদের সামনে নতুন গাড়ী সহ  অ-পরিচিত মহিলা এবং পূরুষের এমন অ-স্বাভাবিক আচরনে আশপাশের সকলেই ছুটে আসে। নজিরও মাগরেবের আজানের সময় হওয়ায় ততক্ষনে এসে গেছে। নজির এসেই অনুমান করে নিয়েছেন আগুন্তুক মেহমানগন নিশ্চয়ই  হুজুরের নিকটতম আপনজন। নজির তাঁর স্বভাবগত ভদ্রতায় তাঁদেরকে সামান্য অদূরে মসজিদের পাশেই হুজুরের থাকার কক্ষে নিয়ে যান এবং বসতে দেন। মেহমানদেরকে নামাজ শেষ হওয়া পয্যন্ত সবিনয় অপেক্ষা করার অনূরুধ জানিয়ে সে মসজিদের পাকা ঘটে আযু করতে যান। নজির যথারীতি আযান শেষে মসজিদে প্রবেশ করে হুজুরের পাশে বসে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে।  এই মহুর্তে হুজুরকে তাঁর স্বজন আসার খবর বলবে কি বলবে না। এখনই যদি বলে হুজুর হয়তো বা চঞ্চলতায় ভূগতে পারেন। এতে নামাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা হুজুর তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে নামাজের দেরী হতে পারে।

      মাগরেবের আযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে মসুল্লিরা সবাই এসে পড়ে, সময়ও কম পাওয়া যায়।এরই মধ্যে প্রায় লোক চলে এসেছে, মাতব্বরও মসজিদে প্রবেশ করেছেন। নজির তখনই হুজুরকে কিছু না বলে আকামত দিতে উঠে দাঁড়ায়। হুজুরের দুই ছেলেও ওজু করে মসজিদে প্রবেশ করেছে। হুজুরের মেয়ে এবং বিবি তাঁর থাকার কক্ষে বসে চোখের পানি ঝেড়ে নিজেদেরকে কিছুটা হালকা করে নেয়ার প্রানান্তকর চেষ্টায় ব্রতি। নামাজের নিয়তের বাধার আগে এক ফাঁকে ইশারায় মাতব্বরকে নজির মেহমানদের মুল পরিচয় পাশের ছেলে দুইজনকে দেখিয়ে বলে রাখে। নামাজ শেষে হুজুরকে বলার জন্য নজির মসজিদের ভেতরে থাকাবস্থায় দুই ছেলে তাঁদের বাবাকে পাগলের মত ঝাঁপটে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।মসজিদের ভেতরে কান্নার রোল শুনে, বাহিরে মেয়ে এবং তাঁর বিবিও গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে। আচমকা এমন পরিস্থীতিতে হুজুর কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে স্থীর পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকক্ষন পর নজিরের ডাক শুনে হুজুর নড়েচড়ে ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরে বাহিরে বিবি এবং মেয়ের কাছে আসতেই  চোখের পলকে মেয়েটি তাঁর বাবাকে ঝাঁপটে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

    এমতবস্থায় নরম মনের অধিকারী মাতব্বর, নজির সহ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের চোখের পানিতে সয়লাব হতে থাকে মসজিদ প্রাঙ্গন। একপয্যায় মাতব্বর এগিয়ে তাঁদের আবেগের জটলায় ডুকে পড়ে এবং ছেলেদের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।সবাইকে মাতব্বর তাঁর সাথে বাড়ীতে আসতে অনুরুধ করতে থাকে। এতক্ষনে সবার মাঝে কিছুটা সম্বিৎ ফিরে এসেছে। সবাই আগোছালো কাপড় চোপড় ঠিকঠাক করে একটু একটু দুরত্ব সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে পড়ে।হুজুর তাঁর বিবি, ছেলে, মেয়েকে মাতব্বর সাহেবের আতিথ্য গ্রহন করার ইঙ্গিত দেন। সবাই হুজুরের ইশারানুযায়ী মাতব্বরের দিকে চোখ তুলে দেখে--"মাতব্বরও তাঁদের বাবার মতই অভিজাত এক মহান পুরুষ।"
    মসজিদের ইমাম সাহেব সহ সকলকে নিয়ে মাতব্বর মসজিদের পাশে তাঁর বাড়ীতে আসেন।জুলেখা সোনিয়াকে নিয়ে ছবি আঁকা বই নিয়ে খেলা করছিল। মেহমানদের দেখে সোনিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে কিছুটা পেছনে সরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পরিচিতি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। মাতব্বরের ডাকে তাও আর সম্ভব হয়নি। মাতব্বর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে মহিলাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বিছানাপত্র ঠিকঠাক ও খাবার প্রস্তুত করার নির্দেশ দেয়। পাশের বাড়ীর আম্বিয়াকে জুলেখার কাজে সাহায্য করার জন্যে ঢেকে আনতে নজিরকে ঈশারা করে। নজির আম্বিয়ার বাড়ীর দরজায় পৌঁছার আগে এক অভিনব ঘটনার সৃষ্টি হয় জমিদার মাতব্বরের বাড়ীতে। মহুর্তে জমিদার বাড়ীর আনন্দাশ্রুর শিহরণ গ্রাম ছাড়িয়ে আশপাশের দশগ্রামকেও নাড়াতে থাকে।এই মহুর্তটি যেন জমিদার মাতব্বর বাড়ীতে  অদ্ভূত কিমাকার এক আভেগীয় ভূকম্পনের দোলাচলে নাচন তুলেছে।   কোথায় জুলেখা, কোথায় সোনিয়া, কোথায় মাতব্বর,  কোথায় মেহমান। এই যেন স্বর্গ থেকে স্বয়ং দেবদূত নেমে এসে তাঁর অমর, অকৃত্তিম, স্বর্গীয় বাণীর অমোঘ ধ্বনিতে জমিদার বাড়ী সমেত স্বর্গালোকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।দেবদূতের সঙ্গে দেবী, দেবীপুত্রী, সহযোগী যোদ্ধাবোনের মন্ত্রপাঠে বিমূগ্ধ করে রেখেছে জমিদার বাড়ী সহ আশপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে। স্বপ্নের দেবতা দরজায় এসে হুমড়ি খাবে আবছা আবছা অন্ধকারে--কেউ যেন স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন। জমিদার মাতব্বরের হুঁশ কিছুটা ফিরে এলে, তিনি প্রথমেই দেবীকে ঝাঁপটে ধরে আনন্দাশ্রুর শ্রোতস্বীনি তিস্তার বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের পানিতে জমিদার বাড়ী শুদ্ধ নিমিষেই ডুবিয়ে দিলেন। দেবতা তাঁর সোনিয়াকে  বুকের পাঁজরে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছেন--"স্বয়ং দেবীও তাঁর খোঁজ পাবে কিনা একমাত্র ভগবান ব্যাতীত আর কারো পক্ষেই তৎমহুর্তে বলা সম্ভব নয়। জুলেখা সেতো হতবিহব্বল, দিশেহারা, পাগলীনি, বেহুঁশ। তাঁর চোখে মূখে, কানে-নাকে--'ষড় ইন্দ্রীয় শুধুই অণূরণনের অনুভূতি বারংবার শিহরন তোলে সারাটি বঁধন কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে জাগরীত করে দিয়ে যাচ্ছিল। জমিদার বাড়ীময় ক্ষনে ক্ষনে বেহেস্তি সুগন্ধি যুক্ত ফুলের কূড়ির অবিরত: বৃষ্টির রেণুতে প্লাবিত। বিশাল বাড়ীর আঙ্গিনায় ততক্ষনে শুরু হয়েছে বেহেস্তি হুরের বিরামহীন নাচন। সেই নাচনের ঝংকারে দশগ্রামের মানুষের শ্রোত নিয়ন্তর বহতা নদীর ঢেউয়ের কোমর দোলায় আকাশ বাতাস, পাহাড় নদী, পশুপাখী ভেসে ভেসে আঁছড়ে পড়ছে জমিদার বাড়ীর অন্দর মহলে। আছিয়া, সোনিয়া শুধুই আগলে আগলে ভরে  নিচ্ছে তাঁদের স্বপ্নের নানুর বংশ হাজার বছর বেঁচে থাকার সঞ্চয়।

                                   ♣♣শেষ♣♣
   

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

মুখস্ত বিদ্যার অর্থই হল, জোর করে গেলানো---- লিখেছেন--Nipa Das ________________________________________________ দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রমথ চৌধুরীর " বই পড়া " নামক একটা প্রবন্ধ রয়েছে ! প্রবন্ধ টিতে মুখস্থ বিদ্যার কুফল তুলে ধরা হয়েছিল , সেখানে বলা হয়েছিল , পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , পাঠ্যবই মুখস্থ করে পাস করে শিক্ষিত হওয়া যায় না , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে ! আমি সবসময় এই প্রবন্ধটা পড়তাম ! এই প্রবন্ধটি আমার প্রিয় ছিল কারণ এতে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করা ছিল ! মুখস্থ বিদ্যা সম্পর্কে আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই -- মুখস্থ বিদ্যা মানে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানো হয় , তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর না পারুক ! এর ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শক্তি হীন হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ! উদাহরণ :: আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার ও বলবৃদ্ধির উপায় মনে করেন ! কিন্তু দুধের উপকারিতা যে ভোক্তার হজম করবার শক্তির ওপর নির্ভর করে তা মা জননীরা বুঝতে নারাজ ! তাদের বিশ্বাস দুধ পেটে গেলেই উপকার হবে ! তা হজম হোক আর না হোক ! আর যদি শিশু দুধ গিলতে আপত্তি করে তাহলে ঐ শিশু বেয়াদব , সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ! আমাদের স্কুল - কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঠিক এরকম , শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা হজম করতে পারুক আর না পারুক , কিন্তু শিক্ষক তা গেলাবেই ! তবে মাতা এবং শিক্ষক দুজনের উদ্দেশ্যেই কিন্তু সাধু , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ! সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দিতে ব্যস্ত , পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা জেনেও , শিক্ষার্থীদের তা অর্জনে উৎসাহিত করে না , কারণ পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষা অর্থ অর্জনে সাহায্য করে না , তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের শিক্ষার গুরুত্ব নেই ! শুধু পাঠ্যবই পড়ে কেবল একের পর এক ক্লাস পাস করে যাওয়াই শিক্ষা না ! আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাশ হচ্ছে তত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে ! পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয় , এ সত্য স্বীকার করতে আমরা কুণ্ঠিত হই ! বিঃদ্রঃ মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিকের জিপিএ ফাইভ নিয়ে প্রতিবেদনের সাথে আমার পোস্টের কোনো সম্পর্ক নেই ! http://maguratimes.com/wp-content/uploads/2016/02/12743837_831291133666492_4253143191499283089_n-600x330.jpg

ছবি

মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জাতির জনকের কন্যার সরকার মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যাতত্ব দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস ঐতিহ্যে বিতর্ক উত্থাপনের অভিযোগে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়েরের অনুমতি দিয়েছেন।মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে বসবাস করে,মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার মত দৃষ্টতা দেখিয়ে নি:সন্দেহে তিনি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন। এহেন গর্হিত বক্তব্য প্রদানকারী বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোন অধিকার রাখতে পারেননা।মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত অঙ্গিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া কোন দল বা জোটের রাজনীতি করারঅধিকার নীতিগতভাবেই থাকতে পারেনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি সকল রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করে সর্বচ্ছ আদালতের রায় অনুযায়ী '৭২এর সংবিধান অবিকল বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবী।বাংলাদেশেরজনগন চায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে যাক,মুক্তিযুদ্ধে সাগরসম রক্ত ঢেলে সেই অঙ্গিকারের প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেছিল।স্বাধীন বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বসবাসকরে,পরাধীনতার গান শুনতে দেশ স্বাধীন করেনি বাংলার জনগন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৩ বছরের বিরামহীন সংগ্রামের ফসল মুক্তিযুদ্ধ।সেইযুদ্ধে উপনিবেশিক পাকিস্তানের আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালীরা পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিল।সেই স্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশেপরাজিত শক্তির দোষর,তাঁদের প্রেতাত্বাদের রাজনীতি করার কোন নৈতিক অধিকার নেই।জাতির জনক তাঁদের রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত করেছিলেন। বাংলাদেশের জনগন জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলায় রাজাকারের কোন স্থান দিতে চায়না। তাই খালেদা জিয়ার ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টার দৃষ্টান্তমুলক সাজার আশা পোষন করে।কোন রাজনৈতিক সমঝোতার ফাঁদে যেন এই মামলা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়,তাঁর গ্যারান্টিও সরকারের নিকট বাংলাদেশের জনগন চায়। জয় বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু Ruhul Amin ------------------------------ খালেদা জিয়াকে সমাবেশের অনুমতি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আশাহত----04 /01 / 0016 ইং পোষ্ট -==================================প্রখ্যাত দার্শনিক,চিন্তাবিদ সক্রেটিসকে কম বেশি আমরা সবাই জানি।সক্রেটিস কোন যুগে জম্মগ্রহন করে মানব সেবায় ব্রতি হয়ে আজও দেশে দেশে অনুকরনীয় অনুসরনীয় হয়ে আছেন তাও আমরা জানি।নিশ্চয়ই তখনকার সময় থেকে বর্তমানের সমাজ, রাষ্ট্রব্যাবস্থাপনা আরো শত গুন উন্নত,সমৃদ্ধ,সভ্য।সক্রেটিস ছুতোর, কামার ইত্যাদি প্রসঙ্গে এসে প্রশ্ন করতেন, 'তাহলে রাষ্ট্র নামক জাহাজটি বিগড়োলে কাকে দিয়ে সারাইয়ের কাজ করাবো'হাসান আজিজুল হক (সক্রেটিস) পৃ : ১৬ সক্রেটিসের এ বিখ্যাত কথপোকথন কারো অজানা নয়। আদর্শবান ন্যায়নীতিভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করবার জন্য সক্রেটিসকে হেমলক পান করতে দেয়া হয়েছিল(বিষ), তারপরও তিনি আইনের প্রতি অটুট শ্রদ্ধা জানিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন- এটাও ছিল তার নির্ভীক বিদ্রোহ। তাকে বাঁচবার সুযোগ দেয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি আইনঅবজ্ঞা করেননি, আইনে যদি তার মৃত্যুদন্ড হয় তবে তিনি অবশ্যই তা মানতে রাজি। এখানেও তার সমস্ত জীবনকর্মের অনেক গভীর দর্শন কাজ করেছে। তার উপর মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছিল একথা তিনি ও এথেন্সবাসী জানতেন। কিন্তু যে আইনে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলো- তিনি সে আইনকে শ্রদ্ধা জানালেন এ অর্থে মানুষকে আইনের প্রতি অনুগত থাকতে বললেন। সেই আইন কারা তৈরি করছে তা তিনি জানতেন তাতে তো আর আইন নামক বিষয়টিকে জীবন থেকে বিতাড়িত করা যায় না।"পবিত্র কোরানে পাকে ও উল্লেখ করা হয়েছে, বিধর্মী কতৃক শাষিত রাষ্ট্র ও সরকার সমুহের আইন মেনে ধর্ম কর্ম করার।এই রুপ রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় শুক্রবারের খতবায় বিশেষ আয়াৎ সংযুক্ত আছে এবং নিয়মিত নামাজের সাথে আর ও কয় রাকাত নামাজ আদায় করার নির্দেশনা দেয়া আছে।পরিতাপের বিষয়টি হচ্ছে,গত কয়েক বছর থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে একশ্রেনীর মানুষ রাষ্ট্রীয় আইন রীতি নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সর্ব উচ্চ আদালতের রায়কে ও অমান্য করে হরতাল অবরোধ,প্রকাশ্য আদালতের সমালোচনা করতে।শুধু তাই নয় আন্দোলনের নামেপ্রকাশ্য দিবালোকে যাত্রীভর্তি চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়ে জীবন্ত মানবকে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিতে।উল্লেখ করা প্রয়োজন যারা এই সমস্ত আদালত অবমাননাকর বক্তব্য দিলেন,এবং প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন যে আদালতের বিরুদ্ধেও কর্মসূচি দেয়া যায়,বক্তব্য দেয়া যায়,তাঁরা কখনই কোন অপরাধীর বিচার কায্য সম্পাদন করেছেন তদ্রুপ কোন উদাহরন নেই। যেমন আমি প্রথমেই বলতে চাই ১৫ই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করেছেন রাতের অন্ধকারে।বঙ্গবন্ধুর অপরাধের বিচার কি করা যেতনা? পৃথীবিপৃষ্টের সব চাইতে নিরাপদ স্থান জেলখানা।সেখানে রাতের অন্ধকারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করাহল,তাঁরা বন্দি ছিলেন, তারপর ও তাঁদের অপরাধের বিচার কি করা যেতনা? মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে বুদ্ধিজীবিদের বাসা থেকেতুলে নিয়ে জ্যান্ত মানুষকে হত্যা করা হল, তাঁদের অপরাধ কি বিচার করে মিমাংসা করা যেতনা? খালেদ মোশারফ., কর্নেল তাহেরসহ অসংখ্য মুক্তি যুদ্ধা সেনা অফিসারকে মেজর জিয়ার নির্দেশে নির্মম নির্দয় ভাবে হত্যা করা হল, অনেককে গুলী করার পর প্রান পাখী উড়াল দেয়ার আগেই জ্যান্ত মাটি চাপা দেয়া হল, তাঁদের বিচার কি প্রচলিত সেনা আইনে করা যেতনা? অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধা,আওয়ামী লীগের নেতা,মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারি,ব্লগার,প্রকাশক,লেখক সাহিত্যিক,সাংবাদিক হত্যা করা হল,তাঁদের অপরাধ কি আইনের আওতায় এনে বিচার করা যেতনা?আন্দোলনের নামে ঘোষনা দিয়ে মানুষ হত্যা করা,সম্পদ নষ্ট করা,লুটপাট করা কি মানবতা বিরুধী অপরাধের আওতায় পড়েনা?মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ হত্যা লুটপাট,অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি মানবতা বিরুধী অপরাধের বিচার হতে পারে,যুদ্ধাবস্থা ব্যাতিরেকে ঘোষনা দিয়ে তদ্রুপ কর্মে জড়িতদের এবং হুকুমদাতার বিচার কেন হবেনা? নগদ অপরাধের ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচার করা কি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব নয়? নাগরীকদের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া কি রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যে পড়েনা? যারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন তাঁরা কি বিচার পাওয়ার সাংবিধানীক অধিকারের মধ্যে পড়েনা?সেই যুগের সক্রেটিস যদি নীজের উপর আনীত মিথ্যা অভিযোগ জেনে শুনে মেনে নিতে পারেন,সভ্যতার চরম শীখরে দাঁড়িয়ে যারা এই যুগে আইনকে, রাষ্ট্রীয় রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে প্রকাশ্য আন্দোলনের নামে মানুষ খুন করেছেন,সম্পদের হানী ঘটিয়েছেন তাঁরা কি সক্রেটিস যুগের আগের অধিবাসি মনে করেন নীজেদের? তাঁরা নীজেরা নিজেদের মনে করুন কিন্তু মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে কোন যুগে ফিরিয়ে নিতে চান?তাঁদের যদি এতই অসহ্য লাগে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিশেষ কিছু আদর্শের প্রতিপালনের অঙ্গিকারের ভিত্তিতে ৩০লক্ষ শহিদের আত্মদান,পৌনে চারলাখ মাবোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস- তবে জনগনকে সংঘটিত করে আর একটি গনবিপ্লব ঘটিয়ে তাঁদের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে স্বাধীনতার পক্ষের কোন মানুষ বাধাতো দিচ্ছেনা। যাদের নেতৃত্বে, যাদের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করা হল, তাঁরাতো ক্ষমতায় আছে,তাঁদের কেন জোর পুর্বক,ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে খমতা থেকে নামাতে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে,আইন শৃংখলার অবনতি ঘটিয়ে জনজীবন দুর্বিসহ করে তোলার চক্রান্ত করতে দেয়া হবে।এই সেই দিন মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে যিনি বিতর্ক উত্থাপনের বৃথা চেষ্টা করে জনরোষের আওতার মধ্যে এখনও রয়েছেন,তাঁর সৌখিন বাসভবন পাহারায় আপনার সরকার অতিরীক্ত পুলিশ মোতায়েন করতে বাধ্য হয়েছে,তিনি কি ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে সমাবেশ করার প্রসাশনিক অনুমতি পায়। বর্তমান গনতান্ত্রিক বিশ্বের একটি দেশের উদাহরন কি কেউ দিতে পারবেন,স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা সেই দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে?একটি দেশকি কেউ দেখাতে পারবে যে,সেই দেশের কোনমীমাংসিত এবং প্রতিষ্ঠিত কোন সত্যকে ৩০/৪০ বছর পর আবার জনসমক্ষে উত্থাপন করে লক্ষ লক্ষ শহিদ পরিবারের অন্তরের আগুনে"ঘি "ঢেলে দেয়ার চেষ্টা, কোন প্রতিষ্ঠিত দল বা তাঁর নেতা করেছেন? কেন এই পয্যন্ত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা না করে উলটো সমাবেশ করে তাঁর মতবাদ প্রচারের অনুমতি দেয়া হল??তাঁরা নীজেদের এত ক্ষমতাবান মনে করেন কিভাবে? তাঁরা কি করে আবার জাতির নিকট ক্ষমা চাওয়া ছাড়াই প্রকাশ্য সভা সমাবেশ করার অধিকার পায়?কেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী সংসদে ঘোষনা দিয়েও এখন পয্যন্ত আগুন সন্ত্রাসের বিচারে ট্রাইবুনাল গঠন করছেন না? মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জাতির জনকের কন্যাকে স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আপনার আশ্বাস বাংলার মানুষ অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে।সুতারাং জনগনকে দেয়া প্রতিশ্রুতি আগুন সন্ত্রাসের বিচারে ট্রাইবুনাল গঠন কল্পে তড়িৎ ব্যাবস্থা গ্রহনকরবেন, জনগনের এই আস্থা বিশ্বাস এখন ও অটুট রয়েছে।মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, জাতির জনকের কন্যা দেশরত্ম শেখ হাসিনাকে স্মরন করিয়ে দিতে চাই,শাপলা চত্বরের সেই দিনের ষড় যন্ত্র মোতাবেক যদি খালেদা জিয়ার ডাকে ঢাকার মানুষ রাজপথে নেমে আসতেন,পরিকল্পনাঅনুযায়ী সেনা বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়েআপনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারতো,আপনাকে কি জীবিত বাঁচতে দেয়া হত? আপনার পরিবারের কাওন সদস্যকে বাঁচতে দিত?আওয়ামী লীগের থানা উপজেলা পয্যায়ের কোন নেতা কি বাঁচতে দিত? তাঁরা কি সে দিন পরিকল্পনা অনুযায়ী ধর্ম বিদ্বেষী সরকার উৎখাত করে ধর্মধারি সরকার কায়েমের রাজনৈতিক শ্লোগানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নামক মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ধারক বাহক জননন্দিত এইসংগঠনটিকেও জ্যান্ত কবর দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল না?আমি আজ আরও একটি বিষয়ে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জাতির জনকের কন্যাকে স্মরন করিয়ে দিতে চাই,সম্পুর্ন নিষিদ্ধ ঘোষিত কোন চরমপন্থী নেতার অবিকল নকল করা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার--,গনতান্ত্রিকদেশে,গনতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে, গনতান্ত্রীক সংগঠনের,গনতন্ত্রের পুজারি মনে করা কোন নেতা, রাজপথে আন্দোলন না করে, সীমাবদ্ধ কক্ষে ৪১দিন অবস্থান করে, ৪২ জন মানুষকে পুড়িয়ে মেরে,পরবর্তিতে বিচারের সম্মুখ্যিন না হয়ে নিয়মাতান্ত্রীক আন্দোলনের সুযোগ কোন দেশের, কোন নেতা বা কোন রাজনৈতিক দল পেয়েছে, এমন উদাহরন কি কেউ দিতে পারবে?? ষড় যন্ত্রের জাল কোথায় বিস্তৃত ছিল তাঁর প্রমান সেই নেত্রী নীজেই তাঁর উষ্মায় প্রকাশ করে দম্ভস্বরে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে সুশৃংখল বাহিনীকে তাচ্ছিল্য করে বলে ছিল"সেনাবাহিনী বেঈমান"!!!এর পরও আপনার সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা আনায়ন না করে প্রকাশ্য সভার অনুমতি দেয়ায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবার গুলির মনে আগাত দেয়া হয়েছে আমি মনে করি। গত পৌর নির্বাচনে রায় দিয়েছে তাঁর বিচার করার,তাঁকে প্রত্যাখ্যান করার অর্থই হচ্ছে জনগনের ক্ষোভ তাঁর উপর থেকে এখনও কমেনি,বরঞ্চ কয়েক গুন বেড়ে জনরোষের পয্যায় পৌছে গেছে।আপনার সরকারের তাঁকে দেয়া বাড়তিনিরাপত্তাই তা প্রমান করে।সুতারাং দেশ ও জাতি এই রাজনৈতিক লাশের ভার বইবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা।দেশের এবং জাতির প্রয়োজন বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মত শিক্ষিত, বিজ্ঞান মনস্ক,প্রযুক্তিনির্ভর, উন্নত সমৃদ্ধ জাতি গঠনে জ্ঞানসমৃদ্ধ, আধুনিক সভ্য দুনিয়ার নেতৃত্ব গ্রহন করার মত গুনাবলি সমৃদ্ধ নেতার। কোন অবস্থায় সক্রেটিসের আগের যুগে জাতি ফেরৎ যেতে চায়না।পরিশেষে বলতে চাই,আর কোন সংগাত নয়,এবার চাই সমৃদ্ধি।আর নয় জঙ্গিপনা,এবার চাই ধর্মনিরপেক্ষতা।আর নয় সাম্প্রদায়ীকতা,এবার চাই অসম্প্রদায়ীক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।আর নয় পাকি ভাবধারা প্রতিষ্ঠা,এবার চাই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকারের সফল বাস্তবায়ন। জয় আমাদের হবেই হবে, অশুভ অপশক্তির পরাজয় অবশ্যাম্ভাবি। জয় বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু জয়তু দেশরত্ম শেখ হাসিনা